এই দক্ষিণ আফ্রিকা মানে ‘সবে মিলে করি কাজ’

আজ প্রথমবারের মতো কোনো বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলতে নামবে দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দলআইসিসি

শুধু ক্রিকেটে সীমাবদ্ধ থাকবেন কেন, সীমানাটা বড় করে সব খেলাতেই ছড়িয়ে দিন না। দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দলের মতো কিছু পাবেন বলে মনে হয় না। খেলাধুলার ইতিহাসেই তো এত দিন এক বিস্ময় হয়ে ছিল এই দক্ষিণ আফ্রিকা। যারা সব পারে, শুধু বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল জিততে পারে না।

এটা বললে অবশ্য গত কিছুদিন মৃদু প্রতিবাদ আসত। আহা, নির্দিষ্ট করে দক্ষিণ আফ্রিকা পুরুষ ক্রিকেট দল বলুন প্লিজ। দক্ষিণ আফ্রিকার নারী ক্রিকেট দল তো ২০২৩ সালেই আইসিসি উইমেন্স টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছে। কথায় ফাঁক ধরা যাঁদের অভ্যাস, তাঁদের আরও কিছু বলার ছিল। ২০১৪ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ের কথাই বা ভুলে যান কীভাবে! সেটা কি দক্ষিণ আফ্রিকা দল ছিল না?

ওসব বলার জন্যই বলা। দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল-জুজু নিয়ে কথা বলার সময় কোন দলের কথা বলা হচ্ছে, কে না তা বুঝত! এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তাহলে খেলাধুলার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রহস্যটার অবসান হয়ে গেল। দক্ষিণ আফ্রিকার লক্ষ্য পূরণও।

যে দল কোনো দিন বিশ্বকাপের ফাইনালেই ওঠেনি, তাদের লক্ষ্য তো একটাই হতে পারে। বারবার যে সেমিফাইনাল নামের যে দুর্লঙ্ঘ্য দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে শেষ হয়ে গেছে বিশ্বকাপ, সেই দেয়াল টপকানো। কথাটা বলে দেখুন, দক্ষিণ আফ্রিকার এই দল থেকে তীব্র প্রতিবাদ উঠবে। সেমিফাইনাল জেতার পরই তো তাব্রেইজ শামসি বলে দিয়েছেন, ‘এই বিশ্বকাপে আমরা ফাইনালে ওঠার লক্ষ্য নিয়ে আসিনি। এসেছি ফাইনাল জিততে।’ অমন একটা ইতিহাস পেছনে নিয়ে কথাটা একটু ঔদ্ধত্যের মতো লাগতে পারে ভেবেই হয়তো যোগ করেছেন, ‘অন্য সব দলও তা-ই এসেছিল।’

দক্ষিণ আফ্রিকার এই দল যেন এক সুখী পরিবার
আইসিসি

না, সব দল ফাইনাল জেতার লক্ষ্য নিয়ে আসেনি। ওমান-পাপুয়া নিউ গিনি-উগান্ডার কথা বাদই দিন, বাংলাদেশই কি ফাইনাল জেতার কথা ভেবেছে নাকি! নইলে কি আর দৈবক্রমে জেগে ওঠা সেমিফাইনালের সম্ভাবনাটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করার সাহসও থাকে না!

দক্ষিণ আফ্রিকা যেহেতু ফাইনালে উঠেই গেছে, তাব্রেইজ শামসির কথাটা উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। তারা কী লক্ষ্য নিয়ে এসেছিল, দলে কী কথা হয়েছে—এসব তো আর কারও জানা থাকার কথা নয়।

আরও পড়ুন

দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য নতুন সূর্যোদয়ের এই বিশ্বকাপ অনেক দিক থেকেই আলাদা। এত বছর ধরে সেমিফাইনালের বাধা টপকাতে না পারা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রায় সব দলই একটা প্যাটার্ন মেনে চলেছে। নকআউটে বিদায় নেওয়ার আগে খেলেছে দুর্দান্ত দাপটে। যে কারণে হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়াটা আরও বেশি চোখে লেগেছে সবার। কে থামাবে দক্ষিণ আফ্রিকাকে—এই প্রশ্নের উত্তরে একটা সময় কেউ আর অন্য কোনো দলের নাম বলত না। সবাই জানতই, সেই কাজটা কোনো দলকে করতে হবে না। নকআউটই সে জন্য যথেষ্ট। বিশেষ করে সেমিফাইনাল।

এবার দক্ষিণ আফ্রিকা সেই বাধাও পেরিয়ে গেছে। জিতেছে টানা ৮ ম্যাচ। কিন্তু শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ আর সেমিফাইনাল বাদ দিলে অমন দাপুটে পারফরম্যান্স কই! ১ রান, ৪ রান, ৭ রানে তিনটি জয়। এখানে জয়ের ব্যবধানই বলে দিচ্ছে, একটু এদিক-ওদিক হলেই এগুলো দক্ষিণ আফ্রিকা হারতে পারত। ৩ উইকেট ও ৪ উইকেটের দুটি জয় হয়তো তা বলছে না। কিন্তু নেদারল্যান্ডস আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেই দুটি ম্যাচও খুব সহজ হয়নি।

ফাইনালে ওঠার পর তাব্রেইজ শামসি দক্ষিণ আফ্রিকার টিমওয়ার্কের মাহাত্ম্য বুঝিয়েছেন। নির্দিষ্ট কোনো ব্যাটসম্যান বা বোলারের মুখ চেয়ে থাকে না তাদের দল। একেক সময় একেকজন দাঁড়িয়ে যান। কথাটা খুবই সত্যি। সেভাবে বলার মতো ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সই তো নেই। কথাটা মনে হয় অ্যারিস্টটলেরই—দ্য হোল ইজ গ্রেটার দ্যান দ্য সাম অব ইটস পার্টস।

টানা ৮ ম্যাচ জিতে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছে গেছে দক্ষিণ আফ্রিকা
আইসিসি

দার্শনিক মানুষের কথা। তাই বলে দর্শনের আয়নায় দেখার দরকার নেই। কথাটাকে আক্ষরিক অর্থে নিলে কী হয়, তার উদাহরণ এই বিশ্বকাপের দক্ষিণ আফ্রিকা দল। টানা আট ম্যাচ জিতে যে দল ফাইনালে, সেই দলের ব্যাটসম্যানদের ফিফটি মাত্র ৩টি। যার দুটি আবার কুইন্টন ডি ককের। এই বিশ্বকাপ এমন সব উইকেটে খেলা হয়েছে, তাতে ৩০-৩৫ রানই হয়তো ফিফটির সমান। তবে তা তো সব দলের জন্যই। সবচেয়ে বেশি রান আর উইকেটের তালিকায় দক্ষিণ আফ্রিকানদের অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজতে হচ্ছে কেন?

সবচেয়ে বেশি রান করা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় যান। দক্ষিণ আফ্রিকার কাউকে প্রথম পাবেন ৮ নম্বরে গিয়ে। মাত্র ২০৪ রান নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে সবচেয়ে বেশি রান কুইন্টন ডি ককের। পরের নামটা ১৬ নম্বরে (ডেভিড মিলার), ২২ নম্বরে এর পরেরটা (হাইনরিখ ক্লাসেন), ২৩ নম্বরে ট্রিস্টান স্টাবস। প্রথম ২৫ জনে দক্ষিণ আফ্রিকার এই চারজনই।

আরও পড়ুন

বোলারদের এই বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি উইকেটের তালিকায়ও তো প্রথম পাঁচে দক্ষিণ আফ্রিকার কেউ নেই। প্রথম ১১ জনের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার মাত্র তিনজন। ১৩ উইকেট নিয়ে ৭ নম্বরে আনরিখ নর্কিয়া। টি-টোয়েন্টিতে রান বা উইকেটের চেয়েও হয়তো গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রাইকরেট ও ইকোনমি রেট। তা সেখানেই দক্ষিণ আফ্রিকানদের খুঁজে পাওয়া কঠিন। কমপক্ষে ২০ বল খেলেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের সেরা স্ট্রাইক রেটের তালিকায় কোনো দক্ষিণ আফ্রিকানের নাম প্রথম পাবেন ২২ নম্বরে (কুইন্টন ডি কক, ১৪৩.৬৬)। কমপক্ষে ২৪ বল করেছেন, এমন বোলারদের ওভারপ্রতি কিপটেমির তালিকায় ১২ নম্বরে ওটনিল বার্টম্যান (৪.৯৪)।

দক্ষিণ আফ্রিকার সমর্থকেরা আজ বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দে মেতে ওঠার অপেক্ষায়
আইসিসি

এই যে বলার মতো ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স ছাড়াই দক্ষিণ আফ্রিকা ফাইনালে উঠে গেল, কী বলবেন এটিকে? ওই যে অ্যারিস্টটলের কথাটা—টুকরা টুকরা পারফরম্যান্স মিলে যা হয়েছে, তা আসলে এসবের যোগফলের চেয়েও বেশি। ‘সবে মিলে করি কাজ’-এর আদর্শ উদাহরণও হয়তো।

আরও পড়ুন

ফাইনালেও যদি একক কোনো বড় পারফরম্যান্স ছাড়া জিতে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা, তাহলে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ নতুন কিছুই দেখবে। ঠিক দক্ষিণ আফ্রিকার ফাইনালে ওঠার মতো।