‘স্বর্গের’ উল্টো দিক থেকে উঠে আসা আকিল
আকিল হোসেইন তখনো জন্মশহর ল্যাভেনটাইল ছাড়েননি। ত্রিনিদাদ দলের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে একদিন একটি ভয়েস নোট পাঠালেন—অনুশীলনে আসতে পারবেন না। কেন আসতে পারবেন না, সেটি উল্লেখ করেননি। সেটার দরকারও ছিল না। তাঁর পাঠানো ভয়েস নোটেই পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল গুলির আওয়াজ। গ্রুপের বাকিদেরও বুঝে নিতে সমস্যা হয়নি—আকিল কেন অনুশীলনে আসতে পারবেন না।
ক্রিকেট অনুসারীদের একটা প্রজন্ম ত্রিনিদাদ নামটা হয়তো প্রথম শুনেছে ব্রায়ান লারার কারণে। অবশ্য ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর সাবেক অধিনায়ক ড্যারেন গঙ্গার ভাষায়, ১৫ লাখ মানুষের দেশটি হচ্ছে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ‘স্বর্গ’। সেখান থেকে উঠে আসা এ সংস্করণের তারকা ক্রিকেটারদের নামগুলো পড়লে গঙ্গার কথাকে অত্যুক্তি মনে হয় না মোটেও—ডোয়াইন ব্রাভো, কাইরন পোলার্ড, সুনীল নারাইন, স্যামুয়েল বদ্রি...।
এ প্রজন্মের নিকোলাস পুরান ও আকিলও সেই ত্রিনিদাদের। দ্বীপদেশটি টি-টোয়েন্টির স্বর্গ হতে পারে, তবে সেখানকার ল্যাভেনটাইল শহরের জীবনটা মোটেও সে রকম ছিল না। দেশের অন্যতম অপরাধপ্রবণ এলাকা। স্কুলে বাচ্চাকে ভর্তি করাতে বা চাকরির আবেদনে মানুষ নিজেদের ঠিকানা হিসেবে ল্যাভেনটাইল উল্লেখ করতে চাইত না। সাবেক ফাস্ট বোলার ও এখনকার জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার ইয়ান বিশপ ছোটবেলায় সেখানে কিছুদিন ছিলেন। সেখান থেকে আকিলের উঠে আসা আসলে কতটা সংগ্রামের, সেটি তিনিও ঠিক অল্প কথায় বোঝাতে পারেন না।
ক্রিকইনফোকে সম্প্রতি দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাঁহাতি স্পিনার আকিল নিজেই একটি ঘটনার কথা বলেছেন। তখন ‘শান্তি’র সময়। আকিল ফিরছেন স্কুল থেকে। হুট করে ‘শত্রু এলাকার’ বয়সে ও শারীরিকভাবে বেশ বড় একজন তাঁকে আটকে টাকা চাইলেন। সেটি দেওয়ার মতো সামর্থ্য ছিল না তাঁর। এল খুনের হুমকি। সেটা শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন আরেকজন ‘সিনিয়র’ গ্যাংস্টার, তিনিও আকিলের শত্রুপক্ষের। তবে তিনি সেই মাস্তানকে বললেন, ‘আরেকবার যদি লারার সঙ্গে উল্টাপাল্টা কিছু করেছিস!’
হ্যাঁ, এলাকায় লারা নামেই সবাই ডাকত আকিলকে। ল্যাভেনটাইলের সবাই জানত, তিনি ক্রিকেটার। আকিল ল্যাভেনটাইলের ওই জীবন থেকে বেরিয়েছেন মূলত ক্রিকেটকে সিঁড়ি হিসেবে পেয়েই। ২০১২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলেছেন, এক বছরের কম সময় পর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক, ২০১৪ সাল থেকে খেলেন ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (সিপিএলে)।
তবে জাতীয় দলে ডাক পেতে আকিলকে অপেক্ষা করতে হয়েছে অনেকটা সময়। সুযোগটা আসে ২০২১ সালে। করোনাভাইরাসের ওই সময়ে বেশ কয়েকজন সিনিয়র ক্রিকেটার বাংলাদেশ সফর থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন, ডাক পড়ে আকিলের। ‘সিদ্ধান্ত নিই, সামনে যদি তারা আমাকে বাদ দিতে চায়, তাহলে কাজটি অনেক কঠিন করে তুলব’—অভিষেকের দিকে পেছন ফিরে বলেন আকিল।
নিজের সে সংকল্প তিনি পূরণ করেছেন। অভিষেকের পর থেকে সাদা বলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে আকিলের চেয়ে বেশি উইকেট পাননি আর কেউ। বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত ২ ম্যাচে তাঁর অর্জন ৭ ওভারে ২০ রান দিয়ে ৬ উইকেট! হতে পারে প্রতিপক্ষ ছিল তুলনামূলক কম শক্তির পাপুয়া নিউগিনি ও উগান্ডা, তবে আকিলের এই বোলিং বাকি দলগুলোর জন্যও বার্তা।
মাঠে ও মাঠের বাইরে সুনীল নারাইনকে আদর্শ মনে করা আকিলও নিজের অন্যতম শক্তি মনে করেন ‘ড্রিফট’কে। তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে, কন্ডিশন বিবেচনায় নিজেকে বদলানোর কোনো বিকল্প দেখেন না তিনি। স্পিনার হয়ে পাওয়ারপ্লেতে বোলিংয়ের কঠিন কাজটি করেন। এবারের বিশ্বকাপেও প্রতিপক্ষের অন্যতম চ্যালেঞ্জ শুরুতে আকিলকে সামলানো। সর্বশেষ প্রভিডেন্সে উগান্ডাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন ৫ উইকেট নিয়ে, এর মধ্যে পাওয়ারপ্লেতেই ছিল ৩টি। সে ম্যাচের পর ল্যাভেনটাইল থেকে উঠে আসা প্রসঙ্গে আকিল বলেছিলেন, ‘যেখান থেকে উঠে এসেছি, কিসের মধ্য দিয়ে গেছি; এরপর বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রতিনিধিত্ব করা, নিজেদের দর্শকের সামনে এমন পারফরম্যান্স—অবশ্যই আমার কাছে অনেক বড় ব্যাপার।’
অবশ্য যত কঠিন জায়গাই হোক, আকিলের কাছে ল্যাভেনটাইলই হচ্ছে ঘর। সেখানকার মানুষ বেশ ভালো, আকিলের কাছে সেটিই মনে হয়। তবে ক্রিকেট না থাকলে আকিল কী করতেন, সেটি বিশপের মাথায় খেলে না। আকিল নিজে অবশ্য সেটি জানেন, ‘আমি সব সময়ই ফায়ারম্যান (অগ্নিনির্বাপণ কর্মী) হতে চেয়েছিলাম। জানতাম, একটা পাকাপাকি কাজ পেতে অনেক পরিশ্রম করতে হবে। তবু করতাম।’
আকিলকে সেটি করতে হয়নি। ‘লারা’ আকিল যে ক্রিকেট খেলেছেন!