আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কি শেষশয্যায়

হুমকির মুখে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট?প্রথম আলো গ্রাফিকস
অর্থের প্রলোভনে নিজের দেশের হয়ে খেলার গৌরবকে বিসর্জন দেওয়ার ঘটনা ক্রিকেট ইতিহাসে অনেক পুরোনো। নতুন করে সেসব আলোচনায় আসছে ক্রিকেটের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের কারণে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে নতুন নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ। সেসব লিগের বেশির ভাগ দলের মালিকানা আবার আইপিএলের দলগুলোর হাতে। সব লিগে খেলাতে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো তাই ক্রিকেটারদের সঙ্গে পুরো বছরের সঙ্গে চুক্তি করতে চাইছে। শেষ পর্যন্ত তা হলে বদলে যাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। ক্রিকেটে দেশ বনাম অর্থের পুরোনো দ্বন্দ্বের ইতিহাস—

ধরুন, নিউজিল্যান্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে নাম সরিয়ে নিলেন কেইন উইলিয়ামসন। সিদ্ধান্ত নিলেন, এখন থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বাদ দিয়ে শুধু ফ্র্যাঞ্চাইজি বা কাউন্টি ক্রিকেট খেলবেন। একবার ভেবে দেখুন, নিউজিল্যান্ড দলের অবস্থা কেমন হবে! ১৯৩০ সালের দিকে স্টুই ডেম্পস্টার ছিলেন নিউজিল্যান্ডের তখনকার উইলিয়ামসন। ডেম্পস্টারকে বলতে পারেন নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের প্রথম ব্যাটিং তারকা। কমপক্ষে ১০ টেস্ট খেলেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে এখনো তাঁর চেয়ে বেশি ব্যাটিং গড় আছে মাত্র একজনেরই। সেটি কার, না বললেও হয়তো চলে। তারপরও বলাটা যেহেতু নিয়ম...হ্যাঁ, ডন ব্র্যাডম্যান। ৬৫.৭২ গড়ের ডেম্পস্টার ১৯৩৩ সালে দেশের হয়ে খেলা বাদ দিয়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমালেন। ক্রিকেটজীবন অবশ্য সেখানেই শেষ নয়। কাউন্টিতে তো খেলেছেনই, তার চেয়ে বেশি জার্মান-ইংলিশ ব্যবসায়ী জুলিয়ান কানের ব্যক্তিগত ক্রিকেট দলে।

হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। ক্রিকেটপাগল জুলিয়ান কান ছিলেন অনেক টাকার মালিক। ইংল্যান্ডের নটিংহামে নিজের বাড়িতেই ক্রিকেট মাঠ বানিয়ে নিয়েছিলেন। যেখানে ম্যাচ খেলতেন বিশ্বের সেরা ক্রিকেটাররা, খেলতেন তিনি নিজেও। শুধু নিজের আঙিনায় নয়, তাঁর দল ‘জুলিয়ান কান একাদশ’ ইংলিশ গ্রীষ্ম শেষ হলে নিয়মিত বিদেশ সফরে যেত। কানাডা, আর্জেন্টিনা, জ্যামাইকা, শ্রীলঙ্কা, নিউজিল্যান্ড, কিউবায় খেলা সেসব ম্যাচের গল্প এখনো প্রচলিত। ১৯২৩ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত জুলিয়ান কান একাদশ ৬২১টি ম্যাচ খেলে হেরেছে মাত্র ১৯টি! জি, ঠিকই পড়েছেন, সংখ্যাটা চোখ কপালে তোলার মতোই।

ডেম্পস্টারের মতো বিশ্বের সেরা ক্রিকেটারদের টাকা দিয়ে কিনে নিতেন কান। নিজের ব্যবসায় সেই ক্রিকেটারদের কাজে লাগাতেন। আর ডাক পড়লে তাঁদের ক্রিকেট খেলতে নামতে হতো কানের বাড়ির উঠানে। যেতে হতো বিশ্বসফরেও। বিভিন্ন সময়ে তাঁর বেতনভুক্ত ক্রিকেটারদের মধ্যে ছিলেন ইংল্যান্ডের তিন অধিনায়ক লর্ড টেনিসন, ওয়ালটার রবিনস ও আলটার কার। টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরিয়ান অ্যান্ড্রু স্যান্ডহামও ছিলেন জুলিয়ান কান একাদশের নিয়মিত সদস্য।

নিউজিল্যান্ড ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান স্টুই ডেম্পস্টার দেশের হয়ে মাত্র ১০ টেস্ট খেলেছেন।
সংগৃহীত

অস্ট্রেলিয়ার জ্যাক ওয়ালশ ও দক্ষিণ আফ্রিকার ডেনিস মরকেলও খেলেছেন এই দলে। বাঁহাতি রিস্ট স্পিনার ওয়ালশ ইংল্যান্ডে চলে গিয়েছিলেন কাউন্টি ক্রিকেট খেলতে। কিন্তু কানের দলে যোগ দেওয়ার পর কাউন্টি ম্যাচ খেলার জন্য তাঁকে ছুটি দেওয়া হতো না। মরকেল দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে ১৬ টেস্ট খেলেছিলেন। তারকাখ্যাতির দিক থেকে এর চেয়েও বড় বড় ক্রিকেটার কানের বাড়ির উঠানে খেলেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার তারকা অলরাউন্ডার অব্রি ফকনার দীর্ঘদিন কানের বেতনভুক্ত ক্রিকেটার ছিলেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে একমাত্র বোলার হিসেবে দুবার ৪ বলে ৪ উইকেট নেওয়া দক্ষিণ আফ্রিকার বব ক্রিসপও খেলেছেন সে দলে। নিউজিল্যান্ডের জেফ ভিভিয়েন, রজার ব্লান্টের নামও উল্লেখযোগ্য। তারার হাট বোধ হয় একেই বলে।

‘জুলিয়ান কান একাদশ’–এর সঙ্গে এ যুগের যেকোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি দলকে মিলিয়ে নিতে পারেন, চাইলে সে দলের ক্রিকেটারদের সঙ্গে এ যুগের তারকা ক্রিকেটারদেরও। দেশের হয়ে খেলার চেয়ে যেখানে বেশি টাকা, সেখানে খেলার ঘটনা ক্রিকেটে একদমই নতুন নয়। কাউন্টি ক্রিকেটের শুরু তো এভাবেই হয়েছিল! ১৭০০ সালের দিকে ইংল্যান্ডে যখন ধনী ব্যবসায়ীরা কোনো রকম দল সাজিয়ে একে অপরের বিপক্ষে দু-একটি ম্যাচ খেলত, তখন চার্লস লেনেক্স সাসেক্সের সেরা ক্রিকেটারদের সারা বছরের জন্য বেতন দিয়ে নিজ দলে রাখতেন। অনুশীলনের ব্যবস্থাও ছিল তাঁর দলে। তখন লন্ডন ছিল ক্রিকেটের প্রাণকেন্দ্র। লেনেক্সের একমাত্র লক্ষ্য ছিল লন্ডনকে হারানো। সে জন্য তিনি নিজ দলের ক্রিকেটারদের অন্য দলের হয়ে খেলতে দিতেন না। এক কাউন্টির সঙ্গে অন্য কাউন্টির প্রতিদ্বন্দ্বিতার শুরু এভাবেই। আর তা কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপ শুরুর আরও ১০০ বছর আগেই।

ক্রিকেট আর টাকার এই দ্বন্দ্ব ছিল কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপ শুরুর পরও। ১৮৪৬ সালে নটিংহামশায়ারের বোলার উইলিয়াম ক্লার্কের মনে হলো, সুযোগ থাকলেও ক্রিকেট প্রশাসকেরা খেলা থেকে যথেষ্ট আয় করতে পারছে না। ক্লার্ক খেলার পাশাপাশি এমসিসিতে চাকরি করতেন। ক্রিকেট থেকে যে আরও অনেক আয় করা সম্ভব, সেটি তিনি এমসিসিতে কাজ করেই উপলব্ধি করলেন। তাই কাউন্টি দল ছেড়ে নিজেই ‘উইলিয়াম ক্লার্ক অল-ইংল্যান্ড একাদশ’ নামের দল সাজালেন। তখন ক্রিকেট খেলা হতো সাদা জার্সি-ট্রাউজারে। ক্লার্ক সেটিতেও পরিবর্তন আনলেন। ক্রিকেটারদের সাদা ট্রাউজারে যোগ হলো গোলাপি বৃত্তের ছোপ—যেন আগামীর রঙিন পোশাকের ক্রিকেটের পূর্বাভাস।

ক্লার্ক নিজেই ছিলেন সেই দলের অধিনায়ক। ম্যানেজার ও কোচও। প্রতিভা খুঁজে বের করার অদ্ভুত দক্ষতা ছিল তাঁর। নিজ দলের স্কাউটিং নিজেই করতেন। ইংল্যান্ডের প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের তাই এক করতে খুব বেশি সময় লাগেনি। একসময় দেখা গেল, ইংলিশ ক্রিকেটের প্রায় সব তারকাই ক্লার্কের দলের হয়ে খেলেছেন। উইলিয়াম লিলিহোয়াইট, জর্জ পার, উইলিয়াম কাফিন, জন উইজডেন, নিকলাস ফিলিক্সের নাম তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। সেরাদের নিয়ে খেলতে নামলে দর্শকেরা মাঠে আসবেই। দর্শকেরা বাজি ধরবে। আয়ও হবে। তাই ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজন করে ধনী হতে ক্লার্কের খুব বেশি সময় লাগেনি।

ক্রিকেট যখন শুধুই ইংলিশ এলিটদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, ক্লার্কের দল খেলাটাকে নিয়ে যায় ইংল্যান্ডের কোনায় কোনায়। ছোট ছোট গ্রামের স্থানীয় লোকজন চাইলেই তারকায় ঠাসা অল-ইংল্যান্ড একাদশের বিপক্ষে খেলতে পারত। শুধু দরকার ছিল ম্যাচ আয়োজনের টাকা। কখনো দু-তিন গ্রাম মিলে টাকা জোগাড় করে অল-ইংল্যান্ড একাদশের বিপক্ষে ম্যাচ আয়োজন করত। ক্লার্ক একাদশ শক্তিমত্তায় এগিয়ে থাকায় প্রতিপক্ষ দলে কখনো কখনো ২২ জন ব্যাটসম্যানও খেলার ঘটনা আছে। অল-ইংল্যান্ড দলের অবশ্য তাতে কোনো অভিযোগ ছিল না। তারা খেলত টাকার জন্য।

১৮৫২ সালের দিকে ক্লার্কের রাজত্বে ফাটল ধরে। কয়েকজন ক্রিকেটার ক্লার্কের চুক্তিতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। জন উইজডেন ছিলেন তাঁদের একজন। জেমস ডিনকে নিয়ে উইজডেন ক্লার্কের দল ছেড়ে নতুন দল গঠন করেন, নাম ইউনাইটেড অল-ইংল্যান্ড একাদশ। ইউনাইটেড নর্থ অব ইংল্যান্ড একাদশ, ইউনাইটেড সাউথ অব ইংল্যান্ড একাদশের মতো আর্থিকভাবে স্বাধীন দলের শুরু এভাবেই। কাউন্টি দল, এমসিসি একাদশের চেয়েও ব্যক্তিগত মালিকানায় সাজানো এই দলগুলো ছিল শক্তিশালী।

ক্রিকেটের এই সংঘাত ডব্লিউ জি গ্রেস, ভিক্টর ট্রাম্পার ও সিডনি বার্নসদের সময়ও ছিল। ডব্লিউ জি তো সে সময়ই ক্রিকেট খেলেছেন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের মতো করে। ইংল্যান্ডে এমন কোনো পর্যায়ের ক্রিকেট ছিল না, যেখানে গ্রেস খেলেননি। ছিলেন অ্যামেচার ক্রিকেটার। কিন্তু পারিশ্রমিক নিতেন পেশাদার ক্রিকেটারদের থেকেও বেশি। এর বাইরেও নানাভাবে টাকা নেওয়ার গল্প প্রচলিত আছে। আর্থিক কারণে সুযোগ থাকার পরও ইংল্যান্ডের হয়ে সব ম্যাচ নয়, খেলে বেড়াতেন বিভিন্ন প্রীতি ম্যাচে।

ডব্লিউ জি গ্রেস টাকার জন্য ইংল্যান্ডের হয়ে সব ম্যাচ না খেলে বেড়াতেন বিভিন্ন প্রীতি ম্যাচে।
সংগৃহীত

অনেকের মতে, সর্বকালের সেরা বোলার সিডনি বার্নস তো কাউন্টি ক্রিকেট আর টেস্ট ক্রিকেটকে পাত্তাই দিতেন না! কারণ, ল্যাঙ্কাশায়ার লিগে খেলে তিনি এর চেয়ে বেশি টাকা আয় করতেন। ল্যাঙ্কাশায়ার কাউন্টিতে গ্রীষ্মের সময় তাঁর বেতন ছিল সপ্তাহে ৩ পাউন্ড আর শীতের সময় ১ পাউন্ড। কিন্তু ল্যাঙ্কাশায়ার লিগে এক দিন খেলেই তিনি এর চেয়ে বেশি আয় করতেন। এ নিয়ে তিনি ল্যাঙ্কাশায়ার কাউন্টির সঙ্গে দীর্ঘদিন যুদ্ধ করেও কোনো লাভ হয়নি। একটা পর্যায়ে ল্যাঙ্কাশায়ার কাউন্টি বার্নসকে ছাড়তে বাধ্য হয়। কাউন্টি থেকে বাদ পড়া মানে বার্নসের ইংল্যান্ড ক্যারিয়ারও শেষ। তাতে বার্নসের খুব যে ক্ষতি হয়েছে, তা নয়। তিনি লিগ ক্রিকেটের টাকায় গা ভাসিয়ে দেন, প্রথমে ল্যাঙ্কাশায়ার লিগে, পরে স্ট্যাফোর্ডশায়ারে। অথচ ক্রিকেটের সোনালি যুগের কিংবদন্তিদের তালিকায় তাঁর নামটা ঠিকই আছে।

কিংবদন্তিদের তালিকায় ডেনিস লিলি, গ্রেগ চ্যাপেল, টনি গ্রেগ, ইমরান খান, ভিভ রিচার্ডস, মাইকেল হোল্ডিংদের নামও আসবে নিশ্চয়ই। আধুনিক ক্রিকেটের এই তারকারা নিজ দেশের ক্রিকেট বোর্ডের পারিশ্রমিক নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। ওদিকে অস্ট্রেলীয় টিভি চ্যানেল নাইনের স্বত্বাধিকারী ছিলেন কেরি প্যাকার। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে টিভি সম্প্রচারস্বত্ব নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় তিনি নিজেই ক্রিকেট লিগ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেন। ক্রিকেটাররাও যেন এমন কিছুরই অপেক্ষায় ছিলেন। প্যাকারের ক্রিকেট খেলে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে চাইলেন অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তানের তারকা ক্রিকেটাররা। পরের গল্পটা সবার জানা।

ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা বোলার সিডনি বার্নস কাউন্টি ক্রিকেট আর টেস্ট ক্রিকেটকে পাত্তাই দিতেন না
সংগৃহীত

প্যাকার–সিরিজ বিশ্ব ক্রিকেটকেই টালমাটাল করে তোলে। অনুমোদনহীন এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া ক্রিকেটাররা নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েন। পরে অবশ্য ইংল্যান্ড ছাড়া বাকি সব দেশই তাদের ক্রিকেটারদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। দুই মৌসুমের ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটের পর অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ডও প্যাকারের সন্ধি প্রস্তাবে রাজি হয়। তবে ওই দুই মৌসুমের ওয়ার্ল্ড সিরিজ আমূল বদলে দেয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে। সাদা বল ও রঙিন পোশাকের ওয়ানডে ম্যাচ, দিবারাত্রির ম্যাচ, ড্রপ ইন পিচ, ক্রিকেটের বাণিজ্যিক সাফল্য—এর সবই প্যাকার-সিরিজের ফসল। যে কারণে কেরি প্যাকারকে অনেকেই আধুনিক ক্রিকেটের জনক বলে মানেন।

কেরি প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট লিগে বসেছিল তারার হাট।
সংগৃহীত

টাকার জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিসর্জন দেওয়ার গল্পে পরবর্তী অধ্যায়টার জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক অধিনায়ক আলী ব্যাখারের কল্যাণে। বর্ণবাদী শাসনের কারণে ১৯৭০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। নিষেধাজ্ঞার আগে দক্ষিণ আফ্রিকার শেষ টেস্ট সিরিজের অধিনায়ক ছিলেন আলী ব্যাখার। পরে যোগ দেন ক্রিকেট প্রশাসনে। ব্যাখার ভেবে দেখলেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে এভাবে বিচ্ছিন্ন থাকলে দু-এক প্রজন্ম পরে দক্ষিণ আফ্রিকায় ক্রিকেটের মৃত্যু ঘটবে। কিন্তু উপায় কী? সেই উপায়ও বের করলেন। বিপুল অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের দক্ষিণ আফ্রিকায় এনে খেলানোর সিদ্ধান্ত নিলেন ব্যাখার। ১৯৮২ সালে মাইক গ্যাটিং, গ্রাহাম গুচ, বল উইলিসরা দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করেন। এরপর টেস্ট পরিবারের নতুন সদস্য শ্রীলঙ্কার একটি দলও। ক্রিকেট ইতিহাসে এসব পরিচিত হয়ে আছে ‘রেবেল ট্যুর’ নামে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় রেবেল ট্যুরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটাররা।
সংগৃহীত

আলী ব্যাখার জানতেন, আলোড়ন সৃষ্টি করতে হলে দরকার বড় কিছুর। বর্ণবাদের কারণে নিষিদ্ধ দেশে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটারদের প্রতীক ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের আনতে পারলে এর চেয়ে বড় কিছু আর কী হতে পারে! তা ছাড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখন বিশ্বসেরাও। আশির দশকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট এতটাই শক্তিশালী ছিল যে দলের বাইরে থাকা ক্রিকেটারটা অন্য টেস্ট দলে সহজেই জায়গা করে নিতে পারতেন। তাই সিলভেস্টার ক্লার্ক, কলিন ক্রফট, লরেন্স রোর মতো ‘সেকেন্ড ইলেভেন’ ক্রিকেটারদের দক্ষিণ আফ্রিকায় এনে খেলানোর পরিকল্পনা করেন ব্যাখার। সফলও হন। ক্যারিবীয়রা টানা দুবার দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করে। ব্যাখার এরপর অস্ট্রেলীয়দের নিয়ে আসেন, যে দলের অধিনায়কত্ব করেছিলেন কিম হিউজ। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা এভাবেই ক্রিকেট খেলেছে। এর পরের বছরই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রোটিয়াদের প্রত্যাবর্তন হয়। ‘রেবেল ট্যুর’-এ যাওয়া ক্রিকেটারদের প্রায় সবাই তাঁদের দেশে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। এই পরিণতি তাঁদের জানাও ছিল। কিন্তু টাকার প্রলোভনের কাছে হার মেনেছেন তাঁরা।

জাতীয় পর্যায়ের এক ধাপ নিচের ক্রিকেটারদের অনেকের চোখ এখন যুক্তরাষ্ট্রে। অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেট ক্যারিয়ার গড়ার চেষ্টা করছেন। সেখানকার মাইনর লিগ ক্রিকেটে খেলতে পারলেও সেটা অনেক বাংলাদেশি ক্রিকেটারের জন্য হবে বিরাট আয়ের উৎস।

২০২০ সাল পর্যন্ত কলপ্যাক চুক্তির কারণে কাউন্টি ক্রিকেটের কাছে অনেক ক্রিকেটার হারিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এর আগে ইংলিশ কাউন্টি দলে একজন বিদেশি ক্রিকেটার খেলতে পারত। কলপ্যাক-রায়ের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর ক্ষেত্রে সেই বাধানিষেধ আর থাকেনি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বিশেষ চুক্তি করা দেশগুলোর ক্ষেত্রেও নয়। এসব দেশের ক্রিকেটাররা ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলার সময় আর ‘বিদেশি’ বলে বিবেচিত হতেন না। এর জের হিসেবে সবচেয়ে বড় আঘাতটা আসে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার গৌরব ত্যাগ করে বহু দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটার কলপ্যাক খেলোয়াড় হিসেবে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। তাঁরা ইংলিশ গ্রীষ্মে খেলতেন কাউন্টি দলের হয়ে আর বছরের বাকি সময়টা নিজ দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে। আর্থিকভাবে যা সেই ক্রিকেটারদের জন্য ‘উইন-উইন সিচুয়েশন’ ছিল। সে জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার অনেকেই ক্যারিয়ারের শুরুতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলেছেন। ইংল্যান্ড ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি কলপ্যাক চুক্তি বাতিল করে দেয়। দক্ষিণ আফ্রিকার অনেক কলপ্যাক খেলোয়াড়ও ফিরে যান নিজের দেশের ক্রিকেটে।

কলপ্যাক চুক্তিতে ইংল্যান্ড পাড়ি জমান দক্ষিণ আফ্রিকার ফাস্ট বোলার কাইল অ্যাবট
সংগৃহীত

কেরি প্যাকারের ঘটনা মনে করিয়ে দেওয়া আইসিএলের স্মৃতিতে তো খুব বেশি দিনের ধুলা পড়েনি। আইসিএলের জন্মের মূলেও ছিল টিভি স্বত্ব নিয়ে বিরোধ। জি নেটওয়ার্কের স্বত্বাধিকারী সুভাষ চন্দ্র ভারতীয় বোর্ডের কাছ থেকে টিভি স্বত্ব না পেয়ে নিজেই একটা টি-টোয়েন্টি লিগ চালু করে দেন। এই টি-টোয়েন্টি লিগে খেলতে গেলে নিষিদ্ধ হতে হবে, এটা জেনেও অনেক ক্রিকেটার আইসিএলে গেছেন। গেছেন বাংলাদেশের এক দল ক্রিকেটারও।

টাকার জন্য দেশের পক্ষে খেলাটাকে বড় না করার এমন অনেক ঘটনা থাকার পরও এত দিন ক্রিকেটারদের জার্সির পেছনের নামের চেয়ে সামনের নামটার গুরুত্বই বেশি ছিল। ক্রিকেট তারকা হতে হলে দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে হবে, জিততে হবে বিশ্বকাপ। ফ্র্যাঞ্চাইজি বা কাউন্টি ক্রিকেট কখনোই এর নিশ্চয়তা নয়। কিন্তু এই ভাবনাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে বদলে যাওয়া ক্রিকেট। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবর, আইপিএল দলগুলো ক্রিকেটারদের সঙ্গে সারা বছরের জন্য চুক্তি করতে চায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো নতুন নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের জন্ম হচ্ছে। সেসব লিগের অনেক দলের মালিকানাই আইপিএল দলগুলোর হাতে। যেমন রাজস্থান রয়্যালসের দল আছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, দক্ষিণ আফ্রিকা, আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্রের টি-টোয়েন্টি লিগে। তারা এসব লিগের জন্য ক্রিকেটারদের সঙ্গে ১২ মাসের চুক্তি করতে চায়। তাদের চোখ এখন বিশ্বসেরা ক্রিকেটারদের দিকে।

টাকার জন্য দেশের পক্ষে খেলাটাকে বড় না করার এমন অনেক ঘটনা থাকার পরও এত দিন ক্রিকেটারদের জার্সির পেছনের নামের চেয়ে সামনের নামটার গুরুত্বই বেশি ছিল। ক্রিকেট তারকা হতে হলে দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে হবে, জিততে হবে বিশ্বকাপ। ফ্র্যাঞ্চাইজি বা কাউন্টি ক্রিকেট কখনোই এর নিশ্চয়তা নয়। কিন্তু এই ভাবনাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে বদলে যাওয়া ক্রিকেট।

অনেকের নামই আছে তালিকায়। তবে প্রকাশিত হয়েছে ইংল্যান্ডের ফাস্ট বোলার জফরা আর্চারের নাম, যাঁর সঙ্গে মুম্বাই ইন্ডিয়ানস নাকি ১২ মাসের চুক্তি করতে চায়। সেটি হলে কী হবে, জানেন? এখন যেমন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে খেলতে নিজের দেশের ক্রিকেট বোর্ডের কাছ থেকে ক্রিকেটারদের ছাড়পত্র নিতে হয়, তখন হবে উল্টোটা। নিজের দেশের পক্ষে খেলার জন্য ফ্র্যাঞ্চাইজি থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে ক্রিকেটারদের। এখন ফুটবলে বিভিন্ন দেশের ফেডারেশন আর ফুটবলারদের ক্ষেত্রে যা হয় আরকি!

জফরা আর্চারের সঙ্গে ১২ মাসের চুক্তি করতে চায় মুম্বাই ইন্ডিয়ানস
সংগৃহীত

টাকা না দেশ—এই দ্বন্দ্ব অনেক ক্ষেত্রেই প্রবল হয়ে উঠেছে এরই মধ্যে। নিউজিল্যান্ড পেসার ট্রেন্ট বোল্ট কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। ইংল্যান্ড ওপেনার জেসন রয় ইসিবির চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ ক্রিকেটে। নেদারল্যান্ডস দল প্রথম সারির ক্রিকেটারদের ছাড়াই খেলবে জিম্বাবুয়েতে অনুষ্ঠেয় ওয়ানডে বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব। কারণ, ডাচ ক্রিকেটাররা ব্যস্ত থাকবেন কাউন্টি ক্রিকেটে! দেশের হয়ে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের চেয়ে কাউন্টি ক্রিকেটে যে অনেক বেশি টাকা। অনেকেরই অনুমান, এ পথেই এগোচ্ছে ভবিষ্যতের ক্রিকেট। একদিন ক্রিকেট–দুনিয়াটা এমন হবে, যেখানে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটই হবে মূল। আর পাশাপাশি থাকবে বিশ্বকাপ। দ্বিপক্ষীয় সিরিজ মূল্য হারিয়ে হবে ফুটবলের ফ্রেন্ডলি ম্যাচের মতো।

পরিবর্তনের এই জোয়ারে বাংলাদেশ ক্রিকেটের কী হবে? ফ্র্যাঞ্চাইজির বাজারে বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের এখন পর্যন্ত তেমন চাহিদা নেই। আইপিএল নিলামে বাংলাদেশিদের নিয়ে টানাটানি হয় না। কিন্তু দ্বিতীয় সারির লিগে ক্রিকেটারদের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশ দলের ব্যস্ত আন্তর্জাতিক সূচির কারণে সেসব লিগে খেলা হচ্ছে না জাতীয় দলের অনেকেরই। জাতীয় পর্যায়ের এক ধাপ নিচের ক্রিকেটারদের অনেকের চোখ এখন যুক্তরাষ্ট্রে। অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেট ক্যারিয়ার গড়ার চেষ্টা করছেন। সেখানকার মাইনর লিগ ক্রিকেটে খেলতে পারলেও সেটা অনেক বাংলাদেশি ক্রিকেটারের জন্য হবে বিরাট আয়ের উৎস। এ বছরই যুক্তরাষ্ট্রের টি-টোয়েন্টি লিগ মেজর লিগ ক্রিকেট (এমএলসি) শুরু হবে। মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে নামা এই লিগ চুম্বকের মতো টানবে বিশ্বের সেরা ক্রিকেটারদের।

প্রশ্ন হচ্ছে, ফ্র্যাঞ্চাইজি-ডলারকে কি ‘না’ বলতে পারবেন ক্রিকেটাররা?