২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

‘লেগ স্পিনারদের নিয়ে ধারণা বদলে দিয়েছিল ওয়ার্নের ওই বল’

শেন ওয়ার্নের বল অব দ্য সেঞ্চুরিটুইটার

১৯৯৩ সালের ৪ জুন, ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ড। অ্যাশেজের প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় দিন চা-বিরতির আগ দিয়ে ২৪ বছর বয়সী ব্লন্ড এক লেগ স্পিনারের হাতে বল তুলে দিয়েছিলেন অ্যালান বোর্ডার। সামনে মাইক গ্যাটিং। প্রবল স্নায়ুচাপে ভুগতে থাকা তরুণ ওই স্পিনারের মনে ওই বলটি করার আগে একটিই ভাবনা, ‘বলটি যাতে পিচের অন্য প্রান্তে অন্তত পৌঁছায়’। বলটি পিচের অন্য প্রান্তে পৌঁছাল ঠিকই। তাতে যা হলো, সেটিকে আপনি ইতিহাস বলতে পারেন। আজ তিন দশক পরও শেন ওয়ার্ন নামের স্পিনারের ওই বলটি নিয়ে কথা হয়, ক্রিকেটে ওই ডেলিভারির মাহাত্ম্যই এমন!

ওয়ার্নের ‘বল অব দ্য সেঞ্চুরি’র ৩০ বছর পূর্ণ হয়ে গেল আজ। ওয়ার্নের সমসাময়িক পাকিস্তান লেগ স্পিনার মুশতাক আহমেদের মতে, ওয়ার্নের বলটির কারণে লেগ স্পিনারদের নিয়ে ধারণাই বদলে গিয়েছিল মানুষের। ভারতের লেগ স্পিনার পীযুশ চাওলার কাছে সেই বলটি একরকম ‘মিরাকল’ই।

ওয়ার্নের বলটি কেন বিশেষ কিছু, সে প্রশ্ন জাগতেই পারে। ক্রিকইনফোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের হয়ে ৫২টি টেস্ট খেলা মুশতাক সেটি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, ‘লেগ স্পিনার হিসেবে আর আমি কাউকে এমন বল করতে দেখিনি। বলটির সৌন্দর্য হচ্ছে, এটি বাতাসে ড্রিফট (দিক পরিবর্তন) করেছিল এমনভাবে, দেখে মনে হবে ঠিক যেন কোনো ফাস্ট বোলার ইনসুইং করছেন। মাইকের মাথা বলের লাইনই অনুসরণ করছিল, তবে ঠিক যখনই শট খেলতে উদ্যত, তখনই বল পিচে পড়ে তীক্ষ্ণভাবে। আমার মনে হয় না ওয়ার্ন ছাড়া অন্য কেউ করতে পারত এটি।’

আরও পড়ুন

ভারতের হয়ে ২০১১ বিশ্বকাপ জেতা চাওলাও বলেছেন ড্রিফটের কথাই, ‘কোনো লেগ স্পিনার লেগ স্টাম্প বা এর বাইরে বল ফেললে সাধারণত ব্যাটারের পায়ের দিকে ড্রিফট করে, এরপর অন্যদিকে ঘুরে যায়। তবে বলটি অনেকটা ড্রিফট করেছিল, লেগ স্টাম্পের বাইরে ষষ্ঠ বা সপ্তম স্টাম্পে পড়েছিল। সেখান থেকে এতটা ঘুরে অফ স্টাম্পের চূড়ায় আঘাত করা—বলতে পারেন এটি একধরনের মিরাকল।’

অস্ট্রেলিয়ার লেগ স্পিনার অ্যালানা কিংয়ের কাছে ড্রিফটের সঙ্গে ওয়ার্নের বলের রেভল্যুশনও (ঘূর্ণন) ছিল মুগ্ধ করার মতো, ‘যখনই ওই বলটা দেখবেন, লেগ স্পিনার হিসেবে আপনার চোখে পড়বে কতগুলো রেভল্যুশন সেই বলে দিয়েছিলেন ওয়ার্ন, কতটা ড্রিফট পেয়েছিলেন। এসব কিছুর কারণে বলটি আরও বিশেষ হয়ে উঠেছিল, লেগ স্পিনারের কাছে যেটি স্বপ্নের মতো। বলে এতটা রেভল্যুশন দেওয়া, সুন্দর ড্রিফট পাওয়া, লেগ স্টাম্পের বাইরে পড়ে অফ স্টাম্পের চূড়ায় আঘাত করা—দুর্দান্ত। প্রতিটি লেগ স্পিনারই এমন কিছুর স্বপ্ন দেখে। এটি ‘পারফেক্ট’, যতটা পারফেক্ট লেগ স্পিন হতে পারে।’

একটি ডেলিভারি, সেটি ৩০ বছর ধরে এমন আলোচনার যোগ্য কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে চাওলা বলেছেন, ‘শতভাগ। লেগ স্টাম্পের বাইরে পড়া বলে ব্যাটসম্যান স্কয়ারড আপ (সম্মুখবর্তী অবস্থায়  দুই পা সমান্তরালে) হয়ে যাচ্ছে—লেগ স্পিনারের জন্য এটি নাটকীয়।’

আর কিংয়ের কাছে, অমন কোনো বল করার ধারেকাছেও কেউ যেতে পারেননি, ‘এ কারণেই তিনি প্রজন্মে একজন, যেমন স্পিন পেতেন। আর এটা তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারের শুরুতেও ছিল, ফলে তাঁর ৭০০ টেস্ট উইকেট পাওয়ার ভ্রমণটাও শুরু হয়েছিল সেখান থেকেই। আমার কাছে মনে হয়, ওই বলটা লেগ স্পিনের চূড়াতেই থাকবে সব সময়।’

মুশতাক বলছেন, ওয়ার্নের ওই বলের কাছাকাছি ডেলিভারি লেগ স্পিনাররা এরপরেও করেছেন। তবে সেটি এখনো অতুলনীয়, ‘ইংল্যান্ডে বিরাট কোহলিকে বোল্ড করেছিল আদিল রশিদ, ইয়াসির শাহ বোল্ড করেছিল কুশল মেন্ডিসকে। এসব বল লেগ স্পিনারের কাছে স্বপ্নের মতো। আমি অফ স্টাম্পের অনেক বাইরে গুগলি করতাম, ব্যাটসম্যান ছেড়ে দিত, এরপর দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে বোল্ড হতো। (তবে) ওইটির সঙ্গে তুলনা চলে না। ৬০ বছর পরও শেনের ওই বলটি উপভোগ্যই থাকবে।’

আমার কাছে মনে হয়, ওই বলটা লেগ স্পিনের চূড়াতেই থাকবে সব সময়।
শেন ওয়ার্নের বল অব দ্য সেঞ্চুরি প্রসঙ্গে অস্ট্রেলিয়া লেগ স্পিনার অ্যালানা কিং

শুধু স্মরণীয় নয়, ওয়ার্নের ওই বলের প্রভাবও ব্যাপক বলেই মনে করেন মুশতাক, ‘টেস্ট ও ওয়ানডেতে লোকে লেগ স্পিনারদের ব্যাপারে যা ভাবত, ওই বলটি সেটি বদলে দিয়েছিল। দলগুলো এরপর লেগ স্পিনার খোঁজা শুরু করে। আমি যখন ইংল্যান্ডে কোচিং করাতাম, তৃণমূল বা কাউন্টি থেকে লেগ স্পিনার পাওয়ার কথা আলোচনা করতাম। তার অর্ধেক ভালো কোনো লেগ স্পিনারও সুযোগ পেত।’

আরও পড়ুন

গ্যাটিংয়ের বিপক্ষে করা ওই বলের পর ওয়ার্ন আবারও জাদু দেখিয়েছেন, ক্যারিয়ারজুড়েই করে গেছেন সেটি। ওয়ার্নের মতোই ভিক্টোরিয়া থেকে আসা কিংয়ের আছে অস্ট্রেলিয়ান জাদুকরের মাহাত্ম্য অন্য রকমেরই, ‘মনে হয় না এটি শুধু লেগ স্পিনের ব্যাপার। স্পিন বোলিংয়েরই ব্যাপার। সবাই ওয়ার্নি হতে চাইত, অথবা কোনো ধরনের স্পিন করতে চাইত মনের আনন্দে। আপনি যখন অমন কিছু করতে পারবেন, বল নিয়ে এত কারিকুরি করতে পারবেন—এটি আবার আনন্দের ব্যাপার হয়ে উঠেছিল। ক্রিকেটে লেগ স্পিন তার মূল্য হারাচ্ছিল, এরপর হুট করেই ওয়ার্নি এল, আর আপনি ভাবা শুরু করলেন, “হ্যাঁ আমি তার মতো হতে চাই”। ঠিক এ কারণেই আমিও লেগ স্পিন শুরু করি। আমার ধারণা, বিশ্বজুড়ে থাকা অনেক লেগ স্পিনারই তার থেকে অনুপ্রাণিত।’

চাওলাও ওয়ার্নে মুগ্ধই হতেন, ‘লেগ স্পিন ক্রিকেটের সবচেয়ে কঠিন শিল্পগুলোর একটি। প্রতিদিন ওই ছন্দ খুঁজে পাওয়া, এক জায়গায় বোলিং করে যাওয়া। শেন ওয়ার্ন যেভাবে বোলিং করত, এটি জাদুকরি ছিল। সব লেগ স্পিনারই তার মতো হতে চাইত। তবে ওয়ার্নি ছিল বিশেষ কিছু—তার হাতে যে শৈল্পিক ক্ষমতা ছিল, আমার মনে হয় না খুব বেশি বোলারের তা ছিল।’

একটি বল নিয়ে ৩০ বছর ধরে আলোচনা তো আর এমনি এমনি নয়!