‘মৃত্যুঞ্জয়ী’ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি যেন ফিনিক্স পাখি

পুড়ে ছাই, সেই ছাই থেকে পুনর্জন্ম। গ্রিক পুরাণ বলবে, বুঝতে পেরেছি, বুঝতে পেরেছি, ফিনিক্স পাখির কথা বলছ তো!

গ্রিক পুরাণের ফিনিক্স পাখির ক্রিকেটীয় প্রতিরূপ খুঁজে পাওয়াটা একটুও কঠিন নয়। কেন, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। কতবার যে এর ‘মৃত্যু’ হয়েছে, কতবার পুনর্জন্ম—হিসাব রাখাই দায়। এতবার রূপ বদলানো টুর্নামেন্টও সম্ভবত আর নেই। সম্ভবত কেন, আসলেই নেই। ক্রিকেটের সীমানা ছাড়িয়ে দিলেও বোধ হয় কথাটা সত্যি।

দেখতে দেখতে মৃত্যুঞ্জয়ী সেই চ্যাম্পিয়নস ট্রফির বয়স এখন ২৭। মনুষ্য জীবনের সঙ্গে মেলালে টগবগে এক যুবক। অথচ কৈশোরেই থামিয়ে দেওয়া হচ্ছিল এর জীবনচক্র। থেমে গেলে তা স্বাভাবিক মৃত্যু হতো না, বলতে হতো অপঘাতে মৃত্যু। ২০১৩ সালে ইংল্যান্ডে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সপ্তম আসরটি শুরুই হয়েছিল এই টুর্নামেন্টের অবিচুয়ারি লিখে। চ্যাম্পিয়নস ট্রফির বয়স তখন ১৫।

এই টুর্নামেন্টটার অসীম জীবনীশক্তি। ফিনিক্স পাখির মতো ছাই থেকে আবারও প্রাণ ফিরে পাওয়ার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা। ২০১৩ সালে অবিচুয়ারি লিখে ফেলার পরের বছরই তাই পুনর্জন্মের ঘোষণা। চার বছর পর আবার হবে। সেই চার বছরের তিন বছর যেতে না যেতেই আবারও ঢং ঢং বাজতে শুরু করল মৃত্যুঘণ্টা। না, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি আর হবে না। তারপরও হলো। ২০১৭ সালের টুর্নামেন্টের প্রায় পুরোটা জুড়েই বেজে গেল বিদায় রাগিণী—বিদায়, হে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, তোমাকে বিদায়!

যে আইসিসিকে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি বলে প্রায়ই বিদ্রূপ করা হয়, হঠাৎ তাদের মনে হয়েছিল, ইভেন্ট বোধ হয় একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে। ক্রিকেটের তিন সংস্করণে একটি করে আইসিসি টুর্নামেন্টই তো যথেষ্ট। ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি আগে থেকেই ছিল, চার বছর পর যোগ হবে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপও। ৫০ ওভারের একটা বিশ্বকাপ যেখানে আছেই, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি নামের অনাসৃষ্টির তাহলে আর কী দরকার! না, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি আর হবে না।

পাকিস্তানই কি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির শেষ চ্যাম্পিয়ন, ২০১৭ সালে এমনটাই মনে হচ্ছিল
রয়টার্স

কিন্তু ওই যে বলছিলাম, এই টুর্নামেন্টটার অসীম জীবনীশক্তি। ফিনিক্স পাখির মতো ছাই থেকে আবারও প্রাণ ফিরে পাওয়ার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা। ২০১৩ সালে অবিচুয়ারি লিখে ফেলার পরের বছরই তাই পুনর্জন্মের ঘোষণা। চার বছর পর আবার হবে। সেই চার বছরের তিন বছর যেতে না যেতেই আবারও ঢং ঢং বাজতে শুরু করল মৃত্যুঘণ্টা। না, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি আর হবে না। তারপরও হলো। ২০১৭ সালের টুর্নামেন্টের প্রায় পুরোটা জুড়েই বেজে গেল বিদায় রাগিণী—বিদায়, হে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, তোমাকে বিদায়!

ফিনিক্স পাখি তো আর সাধে বলিনি। প্রায় আট বছরের দীর্ঘ বিরতির পর আবারও তাই দুয়ারে আরেকটি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। এই যে নিয়ত ‘কী দরকার’ প্রশ্নটা সঙ্গী করে এতগুলো বছর বেঁচে থাকা, সেই প্রশ্নটা কিন্তু তৃতীয় আসরের সময়ই উঠেছিল। ২০০২ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি হওয়ার কথা ছিল ভারতে। আইসিসির সব টুর্নামেন্টেরই মূল উদ্দেশ্য কোষাগার আরেকটু স্ফীত করা। আর চ্যাম্পিয়নস ট্রফির তো জন্মই সেটির ঘোষণা দিয়ে। অথচ ভারত কিনা আইসিসির রাজস্বের বড় একটা অঙ্ক কর হিসেবে কেটে রাখতে চায়। দেনদরবারেও কাজ না হওয়ায় ভারতের বদলে সেই টুর্নামেন্ট হলো তাই শ্রীলঙ্কায়। মাস পাঁচেক পরই ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ। এটিকে তাই বিশ্বকাপের ড্রেস রিহার্সাল হিসেবেই ভাবতে পারত দলগুলো। তা না ভেবে উল্টো বিরক্তি—কী দরকার এটি খেলার!

বারবার রূপ বদলানোর যে কথা বলছিলাম, সেটি টুর্নামেন্টের ফরম্যাট নিয়ে। শুধু ফরম্যাট নয়, নামও তো বদলেছে। প্রথম টুর্নামেন্টটার অফিশিয়াল নাম ছিল ইন্টারন্যাশনাল কাপ। স্পনসরের নাম যোগ হয়ে উইলস ইন্টারন্যাশনাল কাপ। তবে সেই নামে বলতে গেলে কেউই ডাকেনি। কেউ বলেছে ‘মিনি বিশ্বকাপ’, কেউবা ‌‘নকআউট বিশ্বকাপ’। দ্বিতীয় আসরে তো নকআউট নামটা অফিশিয়ালই হয়ে যায়। তা প্রথম দুই আসরে এটি নকআউটই ছিল। নকআউট মানে তো জানেনই—হারলেই বিদায়।

১৯৯৮ সালে প্রথম চ্যাম্পিয়নস ট্রফি হয়েছে ঢাকায়
এএফপি

মাঝখানে দুটি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বাংলাদেশ ছিল না। তারপরও এই টুর্নামেন্টটিকে ঘিরে বাংলাদেশের মানুষের মনে বাড়তি একটা নস্টালজিয়া। জন্মভূমি বলে কথা। ১৯৯৮ সালে সে সময়ের টেস্ট খেলুড়ে নয় দেশকে নিয়ে এই টুর্নামেন্টের জন্ম তো বাংলাদেশেই। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ঢাকায়। সংখ্যাটা নয় থেকে আটে নামিয়ে আনতে নিউজিল্যান্ড আর জিম্বাবুয়ের মধ্যে প্লে-অফ। এই দুই দেশকে শুরুতেই আলাদা করে দেওয়ায় র‍্যাঙ্কিং-ট্যাঙ্কিং কোনো বিবেচনায় আসেনি। বিবেচনায় এসেছিল দর্শক আগ্রহ।

আরও পড়ুন
আইসিসির প্রেসিডেন্ট হয়েই ভারতের জগমোহন ডালমিয়া  ক্রিকেটকে বৈশ্বিক খেলায় পরিণত করাটাকে ব্রত হিসেবে নিয়েছেন। ‘গ্লোবালাইজেশন অব ক্রিকেট’ হয়ে উঠেছে তাঁর ধ্যানজ্ঞান। ক্রিকেটের বিশ্বায়নের জন্য সেটিকে টেস্ট পরিবারের বাইরের দেশগুলোতে তা ছড়িয়ে দিতে হবে।

বাংলাদেশ তখনো টেস্ট স্ট্যাটাস পায়নি। সুযোগ পায়নি খেলারও। চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ইতিহাসে আয়োজক দেশকে ছাড়া ওই একটাই টুর্নামেন্ট। দুই বছর পর দ্বিতীয় টুর্নামেন্টে অবশ্য বাংলাদেশ থাকল, আয়োজক কেনিয়াও। তখনো টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের অভিষেক হয়নি। ক্রিকেট মানচিত্র থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাওয়া কেনিয়ার তো কখনোই নয়। তাহলে কীভাবে এই দুই দেশ এত বড় একটা টুর্নামেন্টের আয়োজক?

এই প্রশ্নের উত্তরেই লুকিয়ে এই টুর্নামেন্টের জন্ম-ইতিহাস। আইসিসির প্রেসিডেন্ট হয়েই ভারতের জগমোহন ডালমিয়া  ক্রিকেটকে বৈশ্বিক খেলায় পরিণত করাটাকে ব্রত হিসেবে নিয়েছেন। ‘গ্লোবালাইজেশন অব ক্রিকেট’ হয়ে উঠেছে তাঁর ধ্যানজ্ঞান। ক্রিকেটের বিশ্বায়নের জন্য সেটিকে টেস্ট পরিবারের বাইরের দেশগুলোতে তা ছড়িয়ে দিতে হবে। সে জন্য দুটি জিনিস খুব জরুরি। সেসব দেশে ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করে তোলা এবং আরও টাকা ঢালা। এক ঢিলে দুই পাখি মারতে সিদ্ধান্ত—ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করে তুলতে এই টুর্নামেন্ট হবে সহযোগী সদস্য কোনো দেশে আর এমন একটা টুর্নামেন্টে অর্থাগম তো হবেই। বাংলাদেশ ও কেনিয়া কেন প্রথম দুই আসরের আয়োজক, এতক্ষণে তা বুঝে ফেলার কথা।

আরও পড়ুন
এবারের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির অন্যতম ভেন্যু রাওয়ালপিন্ডি ক্রিকেট স্টেডিয়াম
এএফপি

আইসিসিতে ডালমিয়া-যুগ শেষ হওয়ার পরই অবশ্য এই ধারার সমাপ্তি। নকআউট থেকে গ্রুপ পর্ব, নাম বদলে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি—বিশ্বায়নের মন্ত্র ভুলে এটি শুধুই আরেকটি ওয়ানডে টুর্নামেন্ট। এর পর থেকে ঘুরেফিরে আয়োজকও টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোই। সবচেয়ে বেশি তিনবার ইংল্যান্ড। পাকিস্তানে এবারই প্রথম। যেটিকে বলতে পারেন ১৭ বছরের পুরোনো পাওনা বুঝে পাওয়া। ২০০৮ সালেই তো পাকিস্তানের স্বাগতিক হওয়ার কথা ছিল। নিরাপত্তা নিয়ে সংশয়ে একের পর এক দল পাকিস্তানে যেতে আপত্তি তোলায় যা স্থগিত হয়ে যায়। পরের বছর এক অর্থে পাকিস্তানের টুর্নামেন্টটাই আয়োজনের দায়িত্ব পায় দক্ষিণ আফ্রিকা।

এই টুর্নামেন্ট নিয়ে বাংলাদেশের নস্টালজিয়ার কথা বলেছি। ঋণের কথাটাও বলা উচিত। ইন্টারন্যাশনাল কাপই বলুন, অথবা মিনি বিশ্বকাপ বা নকআউট বিশ্বকাপ—১৯৯৮ সালের ওই টুর্নামেন্টকে ঘিরে তুমুল দর্শক-আগ্রহ বড় ভূমিকা রেখেছিল বাংলাদেশের জন্য টেস্ট দরোজা খুলে দেওয়ায়।

চ্যাম্পিয়নস ট্রফির দীর্ঘায়ু তো তাহলে কামনা করাই উচিত, কী বলেন!

আরও পড়ুন