প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ভেঙে দেওয়ার পর একজন ব্যাটসম্যানের অনুভূতি কেমন হতে পারে? প্রশ্নটাই কেমন যেন, এত বড় একটা রেকর্ড করার পর আনন্দে ভেসে যাওয়া ছাড়া আর কী অনুভূতি হবে!
ব্রায়ান লারাকে জিজ্ঞেস করলেই যা জানতে পারবেন। রেকর্ডটা তো এখন তাঁরই। লারার আনন্দটা আরও বেশি ছিল, কারণ তিনি তো শুধু প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সর্বোচ্চ স্কোরের রেকর্ডই ভাঙেননি, তা ভেঙেছেন ইতিহাসে প্রথম ৫০০ রানের মাইলফলক ছুঁয়ে।
কিন্তু ব্রায়ান লারা যাঁর রেকর্ড ভেঙেছিলেন, তাঁর আনন্দটা অবিমিশ্র ছিল না। রেকর্ড ভাঙার আনন্দের মাত্রা মূলত দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। এক. রেকর্ডটা কী। দুই. রেকর্ডটা কার ছিল। এই দুই বিচারেই হানিফ মোহাম্মদের আনন্দ চরম মাত্রা ছোঁয়ার কথা ছিল। রেকর্ডটা কী, তা তো বলাই হয়েছে। যাঁর রেকর্ড ভেঙেছিলেন, তিনিও ব্যাটিংয়ের সবচেয়ে বড় নাম। যে ডন ব্র্যাডম্যান তাঁর রেকর্ড ভেঙে দেওয়ার পর হানিফ মোহাম্মদকে অভিনন্দন জানাতে একটুও দেরি করেননি।
তবে এসব তো পরের কথা। এর আগে রেকর্ড ভাঙার আনন্দে ভেসে যেতে যেতেও হানিফ মোহাম্মদের বড় একটা দুঃখের অনুভূতি হয়েছিল। ৫০০তম রান নিতে গিয়ে রান আউট হয়ে গেলে তা হওয়ারই কথা। এই ঘটনা ১৯৫৯ সালের ১১ জানুয়ারিতে, মানে আজকের তারিখেই। এ কারণেই পুরোনো সেই ঘটনাকে ফিরিয়ে আনা। আউট হয়ে ফেরার সময় ৪৯৯ রান করার তৃপ্তির চেয়ে আর ১ রান করতে না পারার দুঃখই বড় হয়ে উঠেছিল হানিফের মনে। দুঃখটা আরও বেড়ে গিয়েছিল একটা ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়েছিলেন বলে।
২০০১ সালে করাচিতে হানিফ মোহাম্মদকে ইন্টারভিউ করতে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম। যত না ইন্টারভিউ, তার চেয়ে বেশি তুমুল আড্ডা হয়েছিল। অতিথিকে যেমন আপ্যায়ন করা হয়, তেমন আদর–আপ্যায়নে চোখের পলকে চলে গিয়েছিল দুই–আড়াই ঘণ্টা। আর হানিফ মোহাম্মদের ইন্টারভিউ বলুন বা তাঁর সঙ্গে আড্ডা—তাতে দুটি ইনিংসের প্রসঙ্গ আসা তো অবধারিতই। ১৯৫৮ সালের জানুয়ারিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তাঁর সেই অমর ৩৩৭। ব্যাটিং করেছিলেন ১৬ ঘণ্টা ১০ মিনিট। টেস্ট ক্রিকেটে দীর্ঘতম ইনিংসের এই রেকর্ড এখনো ভাঙেনি। পরের বছর জানুয়ারিতেই করাচির পার্সি ইনস্টিটিউট মাঠে সেই ৪৯৯।
৪৯৯ রানে রান আউট হওয়ার পেছনে যে ভুল বোঝাবুঝির কথা বলেছিলাম, সেটিও শুনেছিলাম হানিফ মোহাম্মদের মুখেই। সেভাবেই কি জানবেন ঘটনাটা? সেটাই মনে হয় ভালো। তাহলে ‘ওভার টু হানিফ মোহাম্মদ’— ‘দিনের শেষ ওভার শুরুর সময় আমি ছিলাম ৪৯০-এর ঘরে। দুই বল বাকি থাকতে দেখলাম, স্কোরবোর্ডে আমার রান ৪৯৬। পঞ্চম বলটিকে ডিপ এক্সট্রা কাভারে পাঠিয়ে সেখানে মিসফিল্ড হওয়ায় আমি স্ট্রাইক ধরে রাখতে দ্বিতীয় রানটি নিতে গিয়ে রান আউট হয়ে যাই । অথচ আউট হয়ে ফেরার সময় দেখি আমার রান ৪৯৯। আমি তো অবাক। পরে জানলাম, স্কোরবোর্ডে কাজ করছিল যে ছেলেটি, সে ঠিক অংকটি খুঁজে না পাওয়ায় দেৱি করেছিল আমার রানটা বসাতে। আসলে দুই বল বাকি থাকতে আমার রান ছিল ৪৯৮। এটা জানার পর আমার খুব মন খারাপ হলো। তখন আমি এত সেট ছিলাম যে, রান ৪৯৮ জানলে পঞ্চম বলটিতে ঝুঁকি না নিয়ে ২ রান নেওয়ার জন্য শেষ বলটি পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম।'
সেই ম্যাচে করাচি দলের অধিনায়ক ছিলেন হানিফের বড় ভাই ওয়াজির মোহাম্মদ। ক্রিকেটের সব রেকর্ড ঠোঁটস্থ থাকত বলে যাঁকে সতীর্থরা যাঁকে ডাকতেন ‘উইজডেন’ বলে। ট্রিপল সেঞ্চুরি হয়ে যাওয়ার পরই হানিফকে তিনি বলেন, ‘তোমাকে ব্র্যাডম্যানের বিশ্ব রেকর্ড ভাঙতে হবে।’
হানিফ জানতে চান, ‘বিশ্ব রেকর্ডটা কত?’
ওয়াজির বলেন, ‘মাত্র ৪৫২।’
বড় ভাইয়ের মুখে ‘মাত্র’ শুনে হানিফ হেসে ফেলেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই রসিকতা করছেন। আমার মাত্র ৩০০ হয়েছে, তাছাড়া আমি এখনই খুব ক্লান্ত।’
ওয়াজির কথাটা কানেই নিলেন না, ‘আজ রাতে আমি তোমাকে দারুণ একটা ম্যাসাজ দেব। ভালো একটা ঘুম দিয়ে উঠলেই তোমার ক্লান্তি চলে যাবে।’
পরদিন বিশ্ব রেকর্ড ভাঙার আনন্দের চেয়ে ৫০০ করতে না পারার দুঃখে কাতর ছোট ভাইকে সান্ত্বনা দিতেও এগিয়ে আসেন ওয়াজিরই। সান্ত্বনাটা একটু ব্যতিক্রমীই ছিল, ‘ভালোই হয়েছে। ৫০০ করলে কোনো সঙ্গী থাকত না তোমার। একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে যেতে।’
এই ভয়ে ভীত না হয়ে পরে লারা ঠিকই ৫০০ করেছেন। ১৯৯৪ সালে ৫০১ রান করে তাঁর রেকর্ড ভাঙার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই লারাকে টেলিফোনে অভিনন্দন জানিয়েছেন হানিফ মোহাম্মদ। ছোট ভাই মুশতাক মোহাম্মদ ছিলেন এজবাস্টনে, তিনিই ফোনে ধরিয়ে দেন লারাকে। রেকর্ড হারানোর দুঃখে একটাই সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছেন হানিফ মোহাম্মদ। লারা স্যার গ্যারি সোবার্সের দেশের লোক।' সোবার্স শুধু হানিফ মোহাম্মদের অল-টাইম ফেবারিট ক্রিকেটারই ছিলেন না, এই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান অলরাউন্ডারের মতো কাউকে যে ক্রিকেট বিশ্ব আর দেখতে পাবে না, এ নিয়েও কোনো সন্দেহ ছিল না তাঁর মনে।
রান আউট হলে বেশির ভাগ সময়ই পার্টনারের দোষ খোঁজে ব্যাটসম্যান। হানিফ তা খোঁজেননি। কারণ তাঁর পার্টনার আবদুল আজিজের কোনো দোষই ছিল না। শেষ বলেও স্ট্রাইক ধরে রাখার ব্যগ্রতায় ঝুঁকিটা তো তিনি নিজেই নিয়েছিলেন।
রান আউট হলে বেশির ভাগ সময়ই পার্টনারের দোষ খোঁজে ব্যাটসম্যান। হানিফ তা খোঁজেননি। কারণ তাঁর পার্টনার আবদুল আজিজের কোনো দোষই ছিল না। শেষ বলেও স্ট্রাইক ধরে রাখার ব্যগ্রতায় ঝুঁকিটা তো তিনি নিজেই নিয়েছিলেন। কথায় কথা আসে। হানিফ মোহাম্মদ রান আউট হওয়ার সময় তাঁর পার্টনার আবদুল আজিজের জীবনের করুণ পরিণতিটাও যেমন জানিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে।
হানিফের রেকর্ড–ভাঙা ম্যাচের পরের সপ্তাহেই করাচিতে কায়েদ-ই আজম ট্রফির ফাইনালে আবদুল আজিজের মর্মান্তিক মৃত্যু। ব্যাটিংয়ের সময় আচমকা লাফিয়ে ওঠা বল লেগেছিল বুকে। তাৎক্ষণিকভাবে যেটির ভয়াবহতা বোঝা যায়নি। পরের বলটি খেলার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় হঠাৎই মাঠে লুটিয়ে পড়েন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় পথেই সব শেষ। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই সম্ভাবনাময় একটা জীবনের কী করুণ সমাপ্তি! আজিজের বুকে যে বলটি লেগেছিল, সেটি কোনো ফাস্ট বোলারের হাত থেকেও বেরোয়নি। সেটি করেছিলেন দিলদার আওয়ান নামে এক অফ স্পিনার। ব্যাখ্যা হতে পারে একটাই, আজিজের হৃদযন্ত্রে আগে থেকেই হয়তো অচিহ্নিত কোনো সমস্যা ছিল।
করাচির এক পেশ ইমামের ছেলে আবদুল আজিজের আরও দুই ভাই ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট খেলেছেন, আবদুল কাদির নামে এক ভাই টেস্ট ক্রিকেটও। যে ম্যাচে আবদুল আজিজের অমন করুণ মৃত্যু, হানিফ মোহাম্মদও খেলেছেন সেই ম্যাচে। সেঞ্চুরিও করেছেন। ভুল বোঝাবুঝির রান আউটে ৫০০ করতে না পারার দুঃখে অনেকটাই প্রলেপ পড়েছে ততদিনে। আবদুল আজিজের মৃত্যুর পর সেটির আর অস্তিত্বই থাকেনি। মৃত্যুর যে ছোটখাট দুঃখ ভুলিয়ে দেওয়ার অসীম ক্ষমতা!