ইনসুইং, ইনসুইং, ইনসুইং এবং আরও একটি ইনসুইং। ৩৭তম ওভারে হাসান মাহমুদ তাঁর পঞ্চম বলটি করলেন আউটসুইং। অফ স্টাম্পের বাইরের বল দেখে ব্যাট চালিয়ে বসেন মোহাম্মদ রিজওয়ান। হাসানের আউটসুইং খুঁজে নেয় রিজওয়ানের ব্যাটের বাইরের কানা। বল উইকেটকিপার লিটন দাসের গ্লাভসবন্দী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হাসানের বুনো উল্লাস। শুধু কি তাই! ক্রিজ ছেড়ে ড্রেসিংরুমের পথ ধরার আগে রিজওয়ানের দিকে আঙুল তুলে চোখ রাঙালেন, দিলেন ‘সেন্ড-অফ’।
শুধু রিজওয়ানের আউটের পরই নয়, রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে পাকিস্তানের দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৩ রানে ৫ উইকেট নেওয়া হাসান বাকি ৪ উইকেট নেওয়ার পরও যে উদ্যাপন করলেন, তা ছিল দেখার মতো। প্রশ্ন জাগতে পারে, একজন পেস বোলার উইকেট নেওয়ার পর উদ্যাপন করবেন, এ নিয়ে এত আলোচনার কী আছে?
হাসানকে যাঁরা ভালো চেনেন, তাঁরা বুঝবেন আলোচনাটা কেন। এমন দৃশ্য তাঁদের অবাক করবেই। একসময় এই হাসানই যে উইকেট পেয়ে উদ্যাপন না করার কারণে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন! ব্যাটসম্যান মন খারাপ করবে, সে জন্যই নাকি উইকেট পেয়েও উদ্যাপন করেন না তিনি! ২০২৩ সালে এক সংবাদ সম্মেলনে কথাটা হাসতে হাসতে বললেও পরে সেটাই যেন হাসানের গলার কাঁটা হয়ে যায়। পেস বোলার হবেন আক্রমণাত্মক মানসিকতার, খুনে মেজাজের। অথচ হাসানের কিনা ব্যাটসম্যানের জন্য মন কাঁদে!
বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ, রিস্ট পজিশন ও ইনসুইং-আউটসুইংয়ের অবিশ্বাস্য দক্ষতার পরও যথেষ্ট আক্রমণাত্মক নয় বলে একটা অনুযোগ আছে হাসানকে নিয়ে। প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের যেমন তা ছিল, অধিনায়ক নাজমুল হোসেনেরও দ্বিমত ছিল না তাতে। মাঠে ও মাঠের বাইরে হাসানের নিরুত্তাপ চরিত্র নিয়ে দুজনই প্রশ্ন তুলেছিলেন গত বছরের ডিসেম্বরে নিউজিল্যান্ড সফরে। সাদা বলের ক্রিকেট থেকে হাসানের বাদ পড়া আর শরীরী ভাষায় আক্রমণাত্মক আরেক পেসার তানজিম হাসানের উত্থান তখন থেকেই।
ডিসেম্বরের সেই নিউজিল্যান্ড সফরের পর জাতীয় দলে হাসানের জায়গা হয় গত মার্চে ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে, সেটাও হাথুরুসিংহের প্রথম পছন্দ তরুণ পেসার মুশফিক হাসান চোটে পড়ায়। শ্রীলঙ্কা সিরিজের প্রথম টেস্টে অভিষেক হয় আরেক তরুণ পেসার নাহিদ রানার। অভিষেকেই চোটে পড়ায় চট্টগ্রামে ভাগ্যক্রমে টেস্ট অভিষেক হয়ে যায় হাসানের। দ্বিতীয় ইনিংসে ৪ উইকেটসহ টেস্টে ৬ উইকেট নিয়ে তাক লাগিয়ে দেন হাসান। চট্টগ্রামের ফ্ল্যাট উইকেটে সেই আগুনে বোলিং দিয়ে রাওয়ালপিন্ডির দুই টেস্টেও একাদশে জায়গা ধরে রাখেন তিনি।
এর পরের গল্পটা সবারই জানা। পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে নতুন বলে দুর্দান্ত বল করেও ৩ উইকেট নেওয়া হাসান লাইন-লেংথের অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতার উপহার হিসেবে দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে পেয়ে গেলেন ৪৩ রানে ৫ উইকেট। বিদেশের মাটিতে টেস্টে বাংলাদেশের কোনো পেসারের তৃতীয় সেরা বোলিং এটি। তবে একটা জায়গায় পেসারদের মধ্যে হাসানই এখন সবার ওপরে। যেকোনো সংস্করণে পাকিস্তানের বিপক্ষে তাঁর বোলিংটাই এখন বাংলাদেশের পেসারদের মধ্যে সেরা।
ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে ৪৮ উইকেট নেওয়া হাসান নিজেকে প্রমাণ করলেন লাল বলেও। আক্রমণাত্মক শরীরী ভাষাও এখন তাঁর বোলিংয়ের অনুষঙ্গ। কোচ হাথুরুসিংহ আর অধিনায়ক নাজমুল নিশ্চয়ই তা দেখে খুশি হবেন। দলের চুপচাপ ছেলেটিই যে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মাটিতে সিরিজ জয়ের মঞ্চ গড়ে দিয়েছেন, খুশি না হয়ে উপায় আছে!