ভুল কি শুধুই আম্পায়ারের, জেতার জন্য বিশেষ কী করেছে বাংলাদেশ
মাহমুদউল্লাহর মাথায় হাত। তাওহিদ হৃদয়ের চোখ দুটো ছলছল। নাজমুল হোসেন নির্বাক। ডাগআউটের অন্য মুখগুলোও বিষণ্ন। অথচ কিছুক্ষণ আগেও মুখগুলো স্বাভাবিক ছিল। সাকিব আল হাসান তো হাসি-ঠাট্টাও করছিলেন। কিন্তু কোত্থেকে কী হয়ে গেল। বাংলাদেশ জিততে জিততে হেরে গেল!
পেছন ফিরে তাকানো যাক। নাসাউ কাউন্টি স্টেডিয়ামে টস জিতে ফিল্ডিং নেওয়ার ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুলের। দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক এইডেন মার্করাম টস জিতে নাজমুলের সেই ইচ্ছেপূরণ করেন। অধিনায়কের প্রত্যাশামতো দল আগে ফিল্ডিং করেছে, অধিনায়ক নিজেও সমর্থকদের প্রত্যাশা পূরণ করে বোলারদের ভালোভাবে ব্যবহার করেছেন। আর বোলাররা-ফিল্ডাররা মিলে প্রত্যাশার দারুণ প্রতিদান যে দিয়েছেন, সেটির প্রমাণ তো স্কোরবোর্ড।
কুইন্টন ডি কক, ডেভিড মিলার, হাইনরিখ ক্লাসেনদের দক্ষিণ আফ্রিকা পুরো ২০ ওভার খেলে তুলেছে ৬ উইকেটে মাত্র ১১৩। হ্যাঁ, নাসাউ কাউন্টি স্টেডিয়ামের বোলিংবান্ধব উইকেটের অবদান ছিল তাতে, কিন্তু প্রোটিয়ারা ব্যাটসম্যানরা তো ইচ্ছে করে উইকেট দেননি কিংবা মন্থর ব্যাটিং করেননি। ভালো বোলিং করে উইকেট নিতে হয়েছে, আটকাতে হয়েছে রানও। অর্থাৎ, বোলিংয়ে বাংলাদেশ সফল। এবার আসা যাক ম্যাচের সেই অংশে, যেখানে বাংলাদেশ হেরেছে। ব্যাটিং!
সবার আগে একটি বিষয় পরিষ্কার করা ভালো। আইসিসির ‘ডেড বল’ নিয়ম জেনেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলতে নেমেছে দলগুলো। অর্থাৎ ১৭তম ওভারে ‘ডেড বল’ নিয়মের মারপ্যাঁচে যে ৪টি রান পায়নি বাংলাদেশ, সেটির জন্য অনুতাপ অর্থহীন। খেলা ১২০ বলের, ১ বলের না। হ্যাঁ, নিয়মটির কারণে ওই ৪ রান না পাওয়া ম্যাচের ফলে প্রভাব রেখেছে, কিন্তু এটার জন্য ম্যাচ হারেনি বাংলাদেশ। হ্যাঁ, সে জন্য দুঃখ লাগতে পারে। কিন্তু অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানোর সুযোগ নেই।
এমন নয় যে নিয়মটি বাংলাদেশের ইনিংসেই প্রথম করা হয়েছে কিংবা এ নিয়মের অধীনে খেলার কথা ছিল না! নিয়ম অনুযায়ী, আম্পায়ার আউট দেওয়ার পর বল ডেড হয়ে যাওয়ায় লেগ বাই হিসেবে ৪ রান পায়নি বাংলাদেশ। ভুল আউটের সেই সিদ্ধান্ত ঠিক করা হলেও বাংলাদেশ লেগ বাই থেকে যে ৪ রান পায়নি, সেটাও কিন্তু নিয়মের বাইরে ছিল না। তাই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হারের ঢাল হিসেবে ওই ৪ রান না পাওয়াকে দাঁড় করানোর আসলে ভিত নেই। এবার আসল কথাটা বলা যাক—
আচ্ছা, বাংলাদেশ তো টেস্ট খেলুড়ে দল। ক্রিকেটের কুলীন গোত্রভুক্ত দলগুলোর একটি। এমন একটি দলের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন উইকেটেও মাত্র ১১৩ রান তাড়া করে জয় প্রত্যাশিত। কারণও নিশ্চয়ই জানা। ১২০ বলে ১১৩ রান—সংস্করণ টি-টোয়েন্টি হলেও সহজ লক্ষ্য। উইকেট যত কঠিনই হোক, সেখানে এ রান তাড়া করতে না পারলে আর ব্যাটসম্যান হওয়া কেন!
হ্যাঁ, কোনো কোনো দিন এর চেয়েও কম রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে দল হেরে যেতে পারে। কিন্তু দুর্ঘটনা এবং ভুল—এ দুটির মধ্যে পার্থক্য খালি চোখেই টের পাওয়া যায়। আর এমন লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে নিয়মের বলি হয়ে ৪ রান না পাওয়াকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাতে নিশ্চয়ই চক্ষুলজ্জায় বাধবে? তাহলে যে ব্যাটসম্যানদের সামর্থ্য নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। যেহেতু সে সুযোগ নেই, তাই বাংলাদেশ ম্যাচটা হারল কোথায়, সেটি খুঁজে বের করার চেষ্টায় তাকাতে হয় ব্যাটিংয়ের ধারায়।
একটি সাধারণ বিষয় হলো, ব্যাটিংবান্ধব নয়, এমন উইকেটে লো স্কোরিং ম্যাচে রান তাড়ায় খুব সাবধানী ব্যাটিংয়েরও নেতিবাচক দিক থাকে। যেমন ধরুন, সাবধানী ব্যাটিং করতে করতে ম্যাচটা যখন শেষ দিকে কিংবা শেষ ওভারে চলে যাবে, তখন কিন্তু প্রতিপক্ষ দলেরও জয়ের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কারণ, শেষ ওভারে কিংবা শেষ বলে যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে। এ কারণে বিশেষজ্ঞরা বলেন, লো স্কোরিং ম্যাচে উইকেট যত কঠিনই হোক, মারার বল পেলে দু-একটি মেরে দিতে হয়। এর উপকারিতা কিন্তু বাংলাদেশ টের পেয়েছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই।
ডালাসের গ্র্যান্ড প্রেইরি স্টেডিয়ামে সে ম্যাচেও রান তাড়া করেছে বাংলাদেশ। উইকেটও ব্যাটিংয়ের জন্য কঠিন ছিল। ১২৪ রান তাড়া করতে নেমে বাংলাদেশ জিতেছিল ৬ বল হাতে রেখে ২ উইকেটে। অর্থাৎ আরেকটু হলেই বিপদে পড়ত বাংলাদেশ। অন্তত রানের ক্ষেত্রে বিপদটা সেভাবে অনুভূত হয়নি কারণ, শেষ ২ ওভারে জয়ের জন্য রানের লক্ষ্যটা কম ছিল—১১।
১২তম ওভারে প্রথম তিন বলে তাওহিদ হৃদয়ের টানা তিন ছক্কা তার অন্যতম কারণ। ওই টানা তিন ছক্কার পর আর বাউন্ডারি হয়নি, একদম ১৯তম ওভারে এসে ১২ বলে ১১ রানের সমীকরণে থাকতে ছক্কা মেরে ম্যাচটা সহজ করেন মাহমুদউল্লাহ। অর্থাৎ, হৃদয়ের ওই টানা তিন ছক্কায় লক্ষ্যটা শেষ দিকে একটু সহজ হয়েছে। তারপর ঠিক যে সময়ে একটি ছক্কার প্রয়োজন ছিল, সেটা মেরেছেন মাহমুদউল্লাহ। ধরা যাক মাহমুদউল্লাহ যদি তখন ছক্কাটি মারতে না পারতেন, বাংলাদেশও যদি ম্যাচ হারত—তখন কিন্তু এই স্বল্প লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ম্যাচটা কেন অতটা শেষ দিকে টেনে নেওয়া হলো, সেই প্রশ্ন উঠত।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচে যেটা এখন উঠছে। কারণ, শ্রীলঙ্কা ম্যাচের মতোই রান তাড়ায় একই পথে হেঁটেছে বাংলাদেশ। আর এই তাড়ায় প্রধান চরিত্র দুজন—তাওহিদ হৃদয় ও মাহমুদউল্লাহ। ৩৪ বলে ৩৭ রান করা হৃদয় আউট হন ১৭.১ ওভারে। তখন জয়ের জন্য ১৭ বলে ২০ রানের সমীকরণে বাংলাদেশ। হাতে ৫ উইকেট। ক্রিজে সেট মাহমুদউল্লাহ। এ পরিস্থিতিতে একজন ফিনিশারের ভাবনাটা কি হওয়া উচিত?
সাধারণ ভাবনা হলো, ম্যাচটা কোনোভাবেই শেষ ওভারে টেনে নেওয়া যাবে না। তার আগেই শেষ করার চেষ্টা করাটা নিরাপদ। যেহেতু হাতে উইকেট এবং সেট ব্যাটসম্যানও আছেন। তাই অন্তত ১৮ ও ১৯তম ওভার থেকে একটি বা দুটি চার বের করতে পারলে বাংলাদেশকে শেষ বলে ৬ রানের কঠিন সমীকরণের সম্মুখীন হতো না। কিন্তু সেটি হয়নি। শেষ ৩ ওভারে বাংলাদেশ বাউন্ডারিই মারতে পারেনি!
মাহমুদউল্লাহ-জাকের আলীরা যে বাউন্ডারি মারার চেষ্টা করেননি, তা নয়। কিন্তু ম্যাচ যত শেষ দিকে এগিয়েছে চাপ ততই বেড়েছে। ১৯তম ওভারে জাকেরের দুটি ‘মিসহিট’ সেই চাপে ভোগারই প্রমাণ। কাগিসো রাবাদার করা আগের ওভারেও মারার মতো অন্তত দুটি ডেলিভারি পেয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ। তখন সেই গরজটা তাঁর মধ্যে দেখা যায়নি।
মাহমুদউল্লাহ এগোতে চেয়েছিলেন তাঁর চেনা সূত্রেই। সেটি অবশ্য মহেন্দ্র সিং ধোনির রান তাড়ার সূত্র। ম্যাচটা সব সময় শেষ ওভারে টেনে নেওয়া। শেষ ওভারে লক্ষ্য যেটাই হোক, ধোনির তা তুলে নেওয়ার আত্মবিশ্বাস আছে এবং এই কাজে তিনি পরীক্ষিত। তারপরও ধোনির মতো কিংবদন্তি ম্যাচ শেষ ওভারে টেনে নিয়ে জেতাতে না পারলে কিন্তু সমালোচনাও হয়। অর্থাৎ, কাজটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সফল হলে নায়ক। ব্যর্থ হলে অন্য কিছু। মাহমুদউল্লাহ হয়েছেন পরেরটি। আত্মবিশ্বাস প্রতিদিন তো আর সহায় হয় না। তবে একটু দূরদর্শী হয়ে শেষ ওভারে গিয়ে ১০–এর বেশি রান তাড়ার চাপ না নিলে ফলটা হয়তো অন্য রকমও হতে পারত।
তারপরও সুযোগ ছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলাবলি হচ্ছে, কেশব মহারাজের করা শেষ ওভারে তিনটি ফুল টস পেয়েও কাজে লাগাতে পারেনি বাংলাদেশ। একটি কথা জানিয়ে রাখা ভালো, টেপ টেনিসের মতো ক্রিকেট বলে ফুল টস ডেলিভারি মেরে সীমানা পার করা কিন্তু অত সোজা নয়। টাইমিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটের একদম ‘সুইট স্পট’–এ লাগাতে হয়। একটু এদিক-সেদিক হলেই ক্যাচ। ১৯.৫ ওভারে ঠিক সেটাই দেখা গেল। দুই বলে ৬ রানের সমীকরণে থাকতে মহারাজের ফুল টস বলটি স্ট্রেটে তুলে মেরেছিলেন মাহমুদউল্লাহ। বলটা একটু বেশি তুলে খেলায় সেটি আর সীমানা পার হলো না। ক্যাচ আউট। তাই হতাশায় মাহমুদউল্লাহর ওই মাথায় হাত দেওয়া।
মাহমুদউল্লাহ সম্ভবত ভুলটা বুঝতে পেরেছিলেন তখনই। নাসাউ কাউন্টি স্টেডিয়ামে স্ট্রেটের সীমানা বেশ বড়। ধারাভাষ্যকারেরা তখনই এটি বলছিলেন। মাহমুদউল্লাহ যেহেতু পেছনের পায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে উইকেটের যেকোনো দিকেই বড় শট খেলতে পারেন, তাই ওই ফুল টসটি স্ট্রেটে টেনে না মেরে কাভার, পয়েন্ট কিংবা মিড উইকেটে খেললে সম্ভবত বাউন্ডারি আসত। অন্তত ২টি রান?
সেটি হলেও কিন্তু শেষ বলে তাসকিনের খেলা ফুলটসটা খেলতেন মাহমুদউল্লাহ। অর্থাৎ তখনো সুযোগ থাকত।
অবশ্য এসব যদি-কিন্তু সমীকরণ এখন মেলানোর প্রয়োজন হতো না যদি ব্যাটিংয়ে একটি মৌলিক ব্যাপারে ব্যাটসম্যানরা মনোযোগ দিতেন। সেটি সিঙ্গেলসকে ডাবলস বানানো। মাহমুদউল্লাহ-হৃদয়ের ৪৪ রানের জুটিতেই এমন তিন-চারটি সিঙ্গেলস ছিল, যেগুলো একটু পুশ করলেই ডাবলস হতো। অন্য ব্যাটসম্যানরা তো সে সুযোগ পেয়েছেনই। কিংবা উইকেট কঠিন—এই ভাবনা আগে থেকেই মনের মধ্যে নিয়ে রক্ষণাত্মক মানসিকতায় কিছু ডেলিভারিকে ‘ডট’ দেওয়া, যেখান থেকে কিছু সিঙ্গেলস এমনিতেই বের করা যেত। আসলে এই প্রশ্নও উঠতে পারে, জেতার মতো ব্যাটিং কি করেছে বাংলাদেশ?
দক্ষিণ আফ্রিকা আগে ব্যাট করে ৬৬টি ডেলিভারি ‘ডট’ দিয়েছে। কঠিন উইকেট, প্রতিপক্ষের বোলাররাও ভালো বোলিং করছিলেন—এসব কারণেই হয়তো একটু খোলসবন্দী ব্যাটিং করতে হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের এই রান তাড়া করতে নেমে একইসংখ্যক (৬৬) বল ‘ডট’ দেওয়াটা একটু অবাক করার মতোই। হ্যাঁ, এর চেয়ে বেশি বল ডট দিয়েও এমন লক্ষ্য তাড়া করে জেতা সম্ভব। কিন্তু দল যেভাবে ব্যাট করেছে, সেটা দেখে ব্যাটিং দেখে এই প্রশ্নটি জাগতেই পারে, জেতার জন্য এমন বিশেষ কী করেছে বাংলাদেশ?