২০ ডিসেম্বর যেভাবে মিলিয়ে দিয়েছে অমর দুই টেস্টকে

৫৪ বছর আগে-পরের এক দিন...

এক দিন! ৫৪ বছর আগে-পরে হলে এক দিন কীভাবে, দুই দিন হওয়ার কথা না! তার পরও ‘এক দিন’ লিখছি, কারণ বছর আলাদা হলেও দিন একটাই—২০ ডিসেম্বর।
আরে, আজও তো ২০ ডিসেম্বরই! টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর সমাপ্তির তালিকায় যে কয়টি টেস্ট ম্যাচ থাকবে, তার দুটির সমাপ্তি এই দিনেই!
প্রথমটি প্রায় ১৩০ বছর আগে, ১৮৯৪ সালে। দ্বিতীয়টির বয়সও ৭৬ হয়ে গেল আজ—সেই টেস্ট ১৯৪৮ সালে।

দুটি টেস্টেরই ২০ ডিসেম্বর শেষ হওয়াটা যেমন কাকতালীয়, তেমনি আরেকটি কাকতালীয় ব্যাপারও খুঁজে পেলাম। ১৮৯৪ ও ১৯৪৮—সাল দুটি একটু খেয়াল করে দেখুন। চারটি অঙ্ক নিয়েই খেলা—১, ৪, ৮ ও ৯!

১৯৪৮ সালের যে টেস্ট ম্যাচটির কথা হচ্ছে, সেটি ডারবানের কিংসমিডে। স্বাগতিক ইংল্যান্ডের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার। টেস্ট ম্যাচের দৈর্ঘ্য তখনো পাঁচ দিনে নির্ধারিত হয়নি। চার-পাঁচ-ছয় দিনের টেস্ট যেমন হতো, তেমনি হতো ‘টাইমলেস’ টেস্টও। ১৯৪৮ সালের ওই ডারবান টেস্টই যেমন ছিল চার দিনের। সে ম্যাচে ইংল্যান্ড জিতেছিল ২ উইকেটে। ২ উইকেটে! তাহলে রোমাঞ্চকর সমাপ্তি বলে এত মাতামাতি করার কী আছে?

টেস্ট ক্রিকেট তো ১ উইকেটে নিষ্পত্তিও দেখেছে ১৫টি, যার একটিতে আবার বাংলাদেশও ছিল। তবে ২ উইকেটে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হওয়া ওই ডারবান টেস্টের মাহাত্ম্য অন্যখানে। টেস্ট ইতিহাসে এটিই একমাত্র ম্যাচ, যেটির মীমাংসা হয়েছে শেষ বলে। তাও আবার লেগ-বাই থেকে আসা ১ রানে!

লো-স্কোরিং সেই টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার দুই ইনিংস ১৬১ ও ২১৯ রানের। ইংল্যান্ডের ২৫৩ রানের প্রথম ইনিংস তাদের সামনে দাঁড় করাল মাত্র ১২৮ রানের লক্ষ্য। অষ্টম উইকেট যখন পড়ল, তখনো প্রয়োজন ১২ রান। দিনের শেষ ওভারে তা নেমে এল ৮ রানে। উইকেটে দুই বোলার অ্যালেক বেডসার ও ক্লিফ গ্ল্যাডউইন।

তখন আট বলের ওভার। তিন বল বাকি থাকতে অবস্থাটা এমন যে, দুই দলের জয়, ড্র বা টাই—সম্ভাব্য চারটি ফলই সম্ভব। ষষ্ঠ বলে বেডসার সিঙ্গেল নিয়ে স্কোর সমান করে দিলেন। শেষ দুই বলে ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ১ রান।
আরও পড়ুন

তখন আট বলের ওভার। তিন বল বাকি থাকতে অবস্থাটা এমন যে, দুই দলের জয়, ড্র বা টাই—সম্ভাব্য চারটি ফলই সম্ভব। ষষ্ঠ বলে বেডসার সিঙ্গেল নিয়ে স্কোর সমান করে দিলেন। শেষ দুই বলে ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ১ রান।

সপ্তম বলটি ব্যাটে লাগাতে পারলেন না গ্ল্যাডউইন। উইজডেন অ্যালম্যানাক থেকে জানা যাচ্ছে, শেষ বলটির আগে দুই ব্যাটসম্যান বেডসার ও গ্ল্যাডউইন মাঝ-উইকেটের আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেন, বল যেখানেই যাক, তাঁরা ঝেড়ে দৌড় দেবেন। বোলার লিন্ডসে টাকেট বল করতেই দক্ষিণ আফ্রিকান ফিল্ডাররাও সবাই সিঙ্গেল ঠেকাতে উইকেটের দিকে রীতিমতো স্প্রিন্ট লাগালেন। গ্ল্যাডউইন চোখ বুঁজে ব্যাট চালালেন, লাগল না, বল তাঁর প্যাডে লেগে ঠিক সামনেই পড়ল। শর্ট লেগ থেকে ইংল্যান্ড-অধিনায়ক জর্জ মান তা তুলে নেওয়ার আগেই দুই ব্যাটসম্যানের জায়গা বদল সারা।

অ্যালেক বেডসার ও ক্লিফ গ্ল্যাডউইন—শেষ বলটির আগে দুই ব্যাটসম্যান মাঝ–উইকেটের আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেন, বল যেখানেই যাক, তাঁরা ঝেড়ে দৌড় দেবেন

পরের কথা আগে হয়ে গেল। এবার ৫৪ বছর আগের ২০ ডিসেম্বর। সিডনিতে ১৮৯৪ অ্যাশেজের সেই টেস্টটি ছিল ‘টাইমলেস’, অর্থাৎ ফলাফল না হওয়া পর্যন্ত খেলা চালিয়ে যাওয়ার শপথ নিয়ে নেমেছিল দু দল। পঞ্চম দিন শেষেই অবস্থা বোঝা গেল, ষষ্ঠ দিনেই ফলাফল হয়ে যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া যে জিতছে, এ নিয়েও কারও মনে খুব একটা সন্দেহ ছিল না। প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার ৫৮৬ রানের পাহাড়। ৩২৫ রানে অলআউট হয়ে গিয়ে ফলোঅন করতে নেমে ইংল্যান্ড একটু ভালো করল।

‘৪৩৭’ ভালো, কিন্তু তারপরও তো জয়ের জন্য অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন মাত্র ১৭৭ রান। আগেই বলেছি ‘টাইমলেস’ টেস্ট, অর্থাৎ সময়ের কোনো ব্যাপার নেই, চাইলে তিন-চার দিনেও এই রান করতে পারে অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু হাতে সময় থাকলেই তা নষ্ট করতে হবে নাকি, পঞ্চম দিনশেষে অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংস তাই ২ উইকেটে ১১৩। আর চাই ৬৪ রান, হাতে ৮ উইকেট।

আরও পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ানরা যেমন জয় নিশ্চিত বলে ভেবেছিল, ইংলিশরাও মেনে নিয়েছিল পরাজয়। ইংল্যান্ডের প্রায় সব খেলোয়াড়ের রাতটা তাই নৈশবিহারেই কাটল। পরদিন অনেকের মাঠে নামার মতো অবস্থাই নেই। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ববি পিলের। ইংল্যান্ডের পক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ১০০ উইকেট নেওয়ার কীর্তি এই বাঁ-হাতি স্পিনারের। তবে মদিরাপ্রীতির কারণে তাঁর ‘খ্যাতি’ আরও বেশি। সেই রাতে আবার টেস্ট ম্যাচে অনিবার্য পরাজয়ের দুঃখ ভোলার উপলক্ষ বা অজুহাত ছিল। পিল তাই একটু বেশিই গিলেছিলেন।

সেই রাতে তুমুল বৃষ্টি হলো, সকাল থেকেই আবার কড়া রোদ্দুর। উইকেট ঢেকে রাখার নিয়ম তখনো হয়নি। বৃষ্টিতে ভেজা উইকেটে রোদ পড়ার পর তাতে সাপের মতো এদিক-ওদিক করত বল। ব্যাটিং-দুরূহ সেই উইকেটের একটা নামও ছিল—‘স্টিকি উইকেট’।

ইংল্যান্ড অধিনায়ক অ্যান্ড্রু স্টডার্ডের তুরুপের তাস ববি পিল, কিন্তু পিল যে তখন আগের রাতে মাত্রাতিরিক্ত পানের কারণে ঝাপসা দেখছেন! স্টডার্ডের নির্দেশে মাঠে নামার আগে পিলকে তাই দাঁড় করানো হলো ঠান্ডা শাওয়ারের নিচে!

সিডনির উইকেট ঐতিহ্যগতভাবেই স্পিনবান্ধব। ‘স্টিকি উইকেটে’ পরিণত হওয়ার পর তো আরও বেশি। এতেই ইংলিশ অধিনায়ক অ্যান্ড্রু স্টডার্ডের কাছে জয়ের আশাটা অসম্ভব থেকে সম্ভবে রূপান্তরিত। সে জন্য তাঁর তুরুপের তাস ববি পিল, কিন্তু পিল যে তখন ঝাপসা দেখছেন! স্টডার্ডের নির্দেশে মাঠে নামার আগে পিলকে তাই দাঁড় করানো হলো ঠান্ডা শাওয়ারের নিচে!

এই ব্যতিক্রমী ‘চিকিৎসা’য় যে কাজ হয়েছিল, তার প্রমাণ আর মাত্র ৫৩ রান যোগ করতেই অস্ট্রেলিয়ার শেষ ৮ উইকেট পড়ে যাওয়া। পিল একাই নিলেন ৫ উইকেট। আগের দিন বোলিং ওপেন করে নিয়েছিলেন একটি—৬৭ রানে ৬ উইকেট নিয়ে পিলই ‘অঘোষিত’ ম্যান অব দ্য ম্যাচ। ‘অঘোষিত’, কারণ ম্যান অব দ্য ম্যাচ নির্বাচনের প্রথা তখনো চালু হয়নি।

১৩০ বছর পরও সিডনির ওই টেস্ট ম্যাচটির রেকর্ড বইয়ে আলাদা জায়গা। ফলো অন করে কোনো দলের জয়ের প্রথম ঘটনা এটি (এরপর আরও তিনবার যা দেখেছে টেস্ট ক্রিকেট, সর্বশেষটি গত বছর ফেব্রুয়ারিতেই)।

আরেকটি রেকর্ডও প্রায় অমর হয়ে গিয়েছিল।। প্রথমে ব্যাটিং করে অস্ট্রেলিয়া করেছিল ৫৮৬—যা প্রথম ইনিংসে সবচেয়ে বেশি রান করে পরাজয়ের রেকর্ড হয়ে ছিল প্রায় সোয়া শতাব্দী। তা কোন দল ভেঙেছে, জানেন? বাংলাদেশ! সেটিও আবার প্রথম ইনিংস ডিক্লেয়ার করে। হয়তো আপনার মনে আছে, ২০১৭ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৮ উইকেটে ৫৯৫ রান করেও হারতে সক্ষম হয়েছিল বাংলাদেশ।

আরও পড়ুন

নাম তাঁর ববি পিল

২০ ডিসেম্বরে সমাপ্তি দিয়ে এক সুতোয় গাঁথা ৫৪ বছর আগে-পরে নাটকীয় সমাপ্তির দুই টেস্ট ম্যাচের গল্প শেষ। তবে ববি পিলের গল্পটা একটু অসমাপ্ত থেকে গেল। সেটাও না হয় বলেই ফেলি।

বাংলাদেশে যেমন বাঁহাতি স্পিনারের ছড়াছড়ি, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ আর পরের শতাব্দীর শুরুর দিকে ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারও ছিল এমন বাঁহাতি স্পিনারের খনি। শুরুটা হয়েছিল ববি পিলকে দিয়েই। এরপর তাঁর পথ বেয়ে আসেন উইলফ্রেড রোডস ও হেডলি ভেরিটি।

১০০ উইকেট নেওয়া প্রথম বোলার ইংল্যান্ডের বাঁহাতি স্পিনার ববি পিল। বোলিংয়ের সঙ্গে মদিরাপ্রীতির জন্যও যিনি কম বিখ্যাত ছিলেন না

২০ টেস্টে ১০১ উইকেট, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে উইকেট ১৭৭৫—তাঁর সময়ের সেরা বাঁহাতি স্পিনার ছিলেন পিল। কিন্তু ওই যে বললাম, ঘূর্ণিজাদুর চেয়ে মদিরাপ্রীতির জন্যও তিনি কম বিখ্যাত ছিলেন না। ক্রিকেটের গল্পগাথার অনুসারী মাত্রই যেমন ববি পিল নামটা শুনেই বলে ফেলবেন—ওই পিল তো, মদ্যপ অবস্থায় মূত্রে উইকেট ভিজিয়ে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন!

ঘটনাটা ১৮৯৭ সালের, যদিও প্রত্যক্ষদর্শীর কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই। পিল নিজেও পরিষ্কার কিছু বলেননি। বলবেনই বা কীভাবে, প্রকৃতিস্থ থাকলে না তাঁর মনে থাকবে কী করেছিলেন! স্বপ্রণোদিত হয়ে প্রাকৃতিক উপায়ে উইকেটে ‘পানি’ দেওয়ার দায়িত্বটা সত্যিই কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন কি না, সে ব্যাপারে নিঃসংশয় না হওয়া গেলেও মাতলামির জন্য ববি পিলের ইয়র্কশায়ার থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার ঘটনা ঐতিহাসিক সত্যি। পিলের মুখে ওই দিনের ঘটনার বর্ণনাটা খুব মজার—‘লর্ড হক (ইয়র্কশায়ারের প্রেসিডেন্ট) আমার কাঁধে হাত রেখে আমাকে মাঠ থেকে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করলেন, একই সঙ্গে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট থেকেও! হোয়াট আ জেন্টলম্যান!’

আরও পড়ুন