লেগ স্পিনের স্বর্ণযুগে একজন হোয়াইটের অপেক্ষা
বেন হোয়াইট হতে পারতেন পেসার। ইনসুইং করাতে পারতেন। এখন উচ্চতা ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি, না জেনে থাকলে তাঁকে সরল মনে যে কেউই পেসার ভাবতে পারেন। পেসার হলে এমন কোনো ক্ষতি হতো না তাঁর, হয়তো ভালোও করতেন। তবে হোয়াইট হয়েছেন লেগ স্পিনার।
তখন ১১ বা ১৩ বছর বয়স, একদিন নেটে অনুশীলনে মজার ছলেই লেগ স্পিন চেষ্টা করছিলেন প্লাস্টিক বলে। প্রতিষ্ঠিত এক আইরিশ ক্রিকেটার সেটি দেখে পরামর্শ দিলেন, লেগ স্পিনার হয়ে যেতে। ‘কীভাবে কীভাবে লেগ স্পিনার হয়ে গেলাম, বুঝলামই না’—হোয়াইট বলেন।
সিলেটে প্রথম দুই ওয়ানডেতে বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের ‘নির্যাতন’-এর শিকার হয়েছেন আইরিশ বোলাররা, হোয়াইটকে অবশ্য সেসবের ভেতর দিয়ে যেতে হয়নি। তাঁর ওয়ানডে অভিষেকই হয়নি এখনো।
এ সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচে মাঠে অতিরিক্ত খেলোয়াড় হিসেবে দেখা গেছে তাঁকে, মাঝে মাঝে ওয়াকিটকি হাতে নিয়েও ঘুরতে দেখা গেছে। ড্রেসিংরুম থেকে আসা বার্তা দ্রুত বয়ে নেন সতীর্থদের কাছে। টি-টোয়েন্টি অভিষেক হয়ে গেছে, বিশ্বকাপেও খেলে ফেলেছেন। আপাতত ওয়ানডেতে সুযোগের অপেক্ষায় ২৪ বছর বয়সী লেগ স্পিনার।
মাঝের একটা সময়ে হলে হয়তো লেগ স্পিনের মতো মৃতপ্রায় একটা শিল্পের চর্চা করা নিয়ে হয়তো আক্ষেপই করতেন। তবে এখন তো লেগ স্পিনের একরকম স্বর্ণযুগ, বিশেষ করে সাদা বলে। যেখানে তাঁদের একরকম দাপটই চলছে।
হোয়াইট প্রেরণা নেন তাঁদের থেকেই, ‘তাদের দেখে তো ভালো লাগে—আদিল রশিদ, রশিদ খান, ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা, শাদাব খান, কাইস আহমেদ। সাদা বলে তারা যেমন করে। আদিল ও রশিদ যেমন লাল বলে খেললেও দারুণ করে। অ্যাডাম জাম্পার কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। সে–ও অনেক দিন ধরে আছে।’
হোয়াইট বলে চলেন, ‘তরুণদের জন্যও তারা পথটা সহজ করে দিয়েছে। তারা যে পরিমাণে উইকেট নেয়, যতটা বিপজ্জনক, এখন যতটা টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে হয়, আমাকে দারুণ আত্মবিশ্বাস জোগায় দলে ঢোকার জন্য। আশা করি তাদের মতো হতে পারব।’
লেগ স্পিন এমনিতেই একরকম প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজ, হাত ঘোরাতে হয় উল্টো দিকে। কাঁধের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে তাই। হোয়াইট অবশ্য এদিক দিয়ে নিজেকে ভাগ্যবানই ভাবেন, ‘কারণ আমি বেশ লম্বা, হালকা-পাতলা। ফলে লেগ স্পিনের অ্যাকশনে তেমন একটা ভার পড়ে না আমার শরীরের ওপর।’ সামনে থাকা কাঠের টেবিলে হাত ছুঁয়ে এনে এরপর বলেন, ‘প্রার্থনা করি এমনই থাকবে। এখন পর্যন্ত তেমন বড় কোনো চোটে পড়িনি।’
চোটে না পড়লেও লড়াইটা তো শেষ নয়। আয়ারল্যান্ডের কন্ডিশনে স্পিনার হওয়াটাই তো এক রকমের চ্যালেঞ্জ। সেখানে স্পিনারদের চ্যালেঞ্জের কথা বলতে গিয়ে হোয়াইট বললেন, ‘চ্যালেঞ্জিং তো বটেই। তবে পিচে কিন্তু টার্ন থাকে। যদি সিম করে, তাহলে তো টার্নও করে। লেংথ নিয়ন্ত্রণ করাটাই মূল ব্যাপার সেখানে। টার্ন করে, তবে উপমহাদেশের মতো এত তীক্ষ্ণ তো নয়। এখানে তো সব সময় স্পিনারই হতে চাইতাম। তবে সেটি তো হবে না দুর্ভাগ্যজনকভাবে।’
আয়ারল্যান্ডের এই দলেই গ্যারেথ ডিলানির মতো লেগ স্পিনার আছেন, যিনি এরই মধ্যে ৫৮টি টি-টোয়েন্টির সঙ্গে খেলেছেন ১৫টি ওয়ানডে। নিজের সুযোগটা কবে আসবে ওয়ানডেতে, হোয়াইটের নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই তাই। সেটি নিয়ে খুব একটা ভাবতেও চান না, ‘অবশ্যই এখন দলে ঢোকা কঠিন। আমার কাছে এখন নেটে ভালো করাই মূল ব্যাপার। এখনই খুব বেশি দূরে ভাবতে চাই না। আশা করি অভিষেকটা হয়ে যাবে। নেটে কঠোর পরিশ্রম করে যেতে চাই, এখন যেমন করছি। সুযোগ এলে যাতে প্রস্তুত থাকতে পারি। তবে এসব অধিনায়ক ও কোচের ব্যাপার। আমি আসলে সবকিছু সহজ-সরল রাখতে চাই। যদি সুযোগ আসে, লুফে নিতে চাই। কঠোর পরিশ্রম করে যাব। এখন যেমন করছি।’
বৃষ্টির কারণে বাংলাদেশের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডের এক ইনিংস ভেসে যাওয়ার পর পরিত্যক্ত হয়েছে ম্যাচ। সে ম্যাচে খেলা ক্রিকেটারদের কেউই পরের দিন অনুশীলনে আসেননি। তবে কোচদের সঙ্গে এসেছিলেন হোয়াইট, তাঁর কাছে এখন নেটই তো কিছু করে দেখানোর মঞ্চ।
হোয়াইট কাজ করছেন নিজের অস্ত্রের ভান্ডার বাড়াতেও। এখন কাজ করছেন স্লাইডার ডেলিভারি নিয়ে, ‘আশা করি এটিই আমার বিপজ্জনক অস্ত্র হবে। এমনিতে তো আমি বাউন্স পাই, জোরের ওপর করি। আশা করি এটি আমার কাজে দেবে। আশা করি ভিন্ন কিছু করতে পারব।’
লেগ স্পিন নিয়ে আলোচনা, শেন ওয়ার্নের প্রসঙ্গ সেখানে আসে স্বাভাবিকভাবেই। হোয়াইটেরও একজন ‘আইডল’ ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার স্পিন-জাদুকর, ইচ্ছা ছিল লেগ স্পিন নিয়ে আলোচনা করবেন। সেটি হয়নি, এখন আর সুযোগও নেই।
ওয়ার্নের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ না মিললেও হোয়াইট অবশ্য একজন অস্ট্রেলিয়ানের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। এ সিরিজে না থাকলেও আয়ারল্যান্ড দলে স্পিন বোলিং কোচ হিসেবে যোগ দিয়েছেন সাবেক অস্ট্রেলিয়ান স্পিনার নাথান হরিজ।
হোয়াইট বেশ কয়েকবারই তাঁর বোলিংয়ে হরিজের প্রভাবের কথা বললেন, ‘বছরখানেক ধরে কাজ করছি। নাথানের সঙ্গে মূলত মানসিক ও স্কিলের দিক নিয়েই কথা হয়। যেমন ধরুন, কীভাবে ব্যাটসম্যানকে সেট-আপ করব একটা ওভারে। এসব নিয়ে ভুগেছি আমি আগে। সে আসার পর এসব ব্যাপারে বেশ কাজ করছে। শুধু আমি নই, গ্যারেথ (ডিলানি), হ্যারি (টেক্টর)—যেই স্পিন করুক না কেন, সবার সঙ্গেই এসব নিয়ে কাজ করছে সে।’
হরিজ আসার আগে থেকেই অবশ্য তাসমান সাগরের প্রভাব হোয়াইটের জীবনে আছে। তাঁর বাবা আয়ারল্যান্ডে এসেছিলেন নিউজিল্যান্ড থেকে, তিনি ক্যান্টারবেরির হয়ে ক্রিকেটও খেলেছেন রাগবির পাশাপাশি। সে সূত্রে অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্টও আছে হোয়াইটের। চাইলে সেখানে ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলতে পারেন। আপাতত অবশ্য হোয়াইটের সব মনোযোগ আয়ারল্যান্ড জাতীয় দলকে ঘিরেই, ‘এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ঠাসা সূচি, এসব রেখে যাওয়া কঠিন। বিশ্বকাপ আসছে, আশা করি এসব (পরিশ্রম) কাজে দেবে।’
লেগ স্পিনার থাকা মানেই কোনো দলের জন্য উইকেট নেওয়ার অন্যতম বড় অস্ত্র। সেটির জন্য অবশ্য প্রায়ই রানও গুনতে হয়। হোয়াইটের কাছে এখন সীমিত ওভারের ক্রিকেটের বাস্তবতাই এমন, ‘আমরা আসলে এটা নিয়ে কথা বলেছি, কীভাবে আরও সাহসী হওয়া যায়। বাংলাদেশ বড় স্কোর গড়েছে দুই ম্যাচেই। আমরা মাঝের ওভারগুলোতে উইকেট নেওয়ার চেষ্টা করেছি। এর মানে যদি এটা হয় যে চার বা দুই-তিন হবে, হোক। তবু যাতে উইকেট পাই। এখন সাদা বলের ক্রিকেট তো এমনই, ব্যাটসম্যানদের খেলা—ফ্ল্যাট পিচ, বড় ব্যাট। আমাদের জন্য ম্যাচে টিকে থাকাটাই বড় এখন। উইকেট নেওয়ার চেষ্টা করাটাই বড়। যদি রান দিই-ও, কিন্তু ২-৩টা উইকেট নিতে পারি, তাহলেই আমি খুশি।’
আপাতত বেন হোয়াইট সুযোগ পাওয়ার অপেক্ষায়। তবে আইরিশ ক্রিকেটের নতুন প্রজন্ম নিয়ে নিয়ে আশাটা তাঁর বড়ই, ‘যেভাবে জশ লিটল, হ্যারি টেক্টর, লরকান টাকার, কার্টিস ক্যাম্ফাররা খেলছে, যেভাবে তরুণেরা উঠে আসছে, এখন তো ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলই দেখাচ্ছে। আশা করি আমরা মশালটা বয়ে নিতে পারব। আশা করি ভালো কিছু হবে।’
কয়েক বছর ধরেই আয়ারল্যান্ডে ক্রিকেটের প্রসার নাকি বাড়ছে। হোয়াইট আয়ারল্যান্ডের নতুন এক সোনালি প্রজন্মের অংশ হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। অবদান রাখতে চান লেগ স্পিন দিয়ে।
সেই হোয়াইট, যাঁর লেগ স্পিনার হওয়ারই কথা ছিল না।