কত বেদনা, কত দীর্ঘশ্বাসের পর এই ফাইনাল

তাব্রেইজ শামসিদের হাত ধরে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকারয়টার্স

ম্যাচ শেষ হওয়া মাত্র টুইট করেছেন গ্রায়েম স্মিথ। ছোট্ট একটা কথা—আমরা ফাইনালে। ওই ছোট্ট কথাটায় লুকিয়ে কত বেদনা, কত দীর্ঘশ্বাস, দক্ষিণ আফ্রিকার কয়েক প্রজন্মের বয়ে বেড়ানো দুঃসহ যন্ত্রণা অবসানের আনন্দ।

ম্যাচ শেষ হওয়া মাত্র কমেন্ট্রি বক্স থেকে নিচে নেমে গেছেন ডেল স্টেইন। একে একে সবাইকে জড়িয়ে ধরেছেন। মুখে অভিনন্দন জানিয়েছেন। আর মনে মনে হয়তো ধন্যবাদ এত বছর বুকের ওপর জেঁকে বসে থাকা পাথরটাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য।

কত বছর? তা ৯ বছর তো হলোই। অকল্যান্ডে ইডেন পার্কের সেই রাত। শেষ ওভারে ১০ রানের বেশি না দিলেই দক্ষিণ আফ্রিকা ফাইনালে। যে বোলারের ওপর এই দায়িত্ব, আগের ওভারটার সময় লং অফে দাঁড়িয়ে তিনি ভাবছেন, শেষ ওভারে নিউজিল্যান্ডের ৩ রান দরকার হলেও ঠিকই ম্যাচটা জিতিয়ে দেবেন।

শেষ ৪ বলে ১০ রান লাগে নিউজিল্যান্ডের, শেষ ২ বলে ৫। তখনই গ্রান্ট এলিয়টের ওই ছক্কা। বলটা গ্যালারির যে আসনটাতে গিয়ে পড়েছিল, সেটি ‘গ্রান্ট এলিয়ট সিট’ নাম দিয়ে আলাদা করে রাখা হয়েছে। পেছনে লেখা আছে ওই ছক্কার তাৎপর্য। কাদের বিপক্ষে বোঝাতে চেয়ারটার রং দক্ষিণ আফ্রিকার জার্সির রঙের সঙ্গে মিলিয়ে সবুজ। বোলারের নাম? ডেল স্টেইন।

ডেল স্টেইনকে লং অনের ওপর দিয়ে ছক্কা মেরে কিউইদের বিশ্বকাপ ফাইনালের স্বপ্ন পূরণ করলেন গ্রান্ট এলিয়ট। স্বপ্নভঙ্গের হতাশায় স্টেইন তখন প্রায় বিধ্বস্ত। ২০১৫ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে, অকল্যান্ডে
ফাইল ছবি: এএফপি

স্টেইনের নাহয় ৯ বছর। কিন্তু এদিন কমেন্ট্রিতে দক্ষিণ আফ্রিকার জয়ের মুহূর্তটা বর্ণনা করা দীর্ঘদেহী অলরাউন্ডার তো ২৫ বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছিলেন এই যন্ত্রণা।

সেমিফাইনালে না হেরেও কোনো দল বাদ পড়তে পারে, সেবারই তা প্রথম জেনেছে বিশ্বকাপ। ৫ উইকেট নিয়ে সেই ম্যাচের সফলতম বোলার পরে ব্যাট হাতেও করেছেন ১৪ বলে ২০। তারপর দেখেছেন ল্যান্স ক্লুসনার ও অ্যালান ডোনাল্ডের মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে যাওয়ার সেই মুহূর্ত। এই সেমিফাইনালের আগে সাক্ষাৎকার দেওয়া শেষ করে যেতে যেতে বলেছেন, ‘এবার হয়তো অন্য কিছু হবে।’ শন পোলকের কথাটাকে যত না বিশ্বাস বলে মনে হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি আশাবাদ।

১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের সেই দৃশ্য। অ্যালান ডোনাল্ড রানআউট, ম্যাচ টাই, অস্ট্রেলিয়া ফাইনালে
টুইটার/ক্রিকইনফো
আরও পড়ুন

কেপলার ওয়েসেলস থেকে শুরু করে হানসি ক্রনিয়ে, গ্রায়েম স্মিথ, এবি ডি ভিলিয়ার্স কতজনের মুখেই তো এমন শোনা গেছে। গল্পটা তো বদলায়নি। বিশ্বকাপের পর বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল থেকে বিদায়। কখনোবা এর আগেই। অপ্রতিরোধ্য মনে হওয়া এক দল ভেঙে পড়েছে নকআউটে এসে। সব সময় যে ভেঙে পড়েছে, এমনও নয়। কখনো বৃষ্টি আইনের শিকার, কখনোবা ডাকওয়ার্থ-লুইসের হিসাবে ভুল, কখনো প্রতিপক্ষের কোনো খেলোয়াড়ের জ্বলে ওঠা—এত বিচিত্র সব বিদায় যে কখনো মনে হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা কি তাহলে শাপগ্রস্ত এক দল। বর্ণবাদের সেই অন্ধকার দিনগুলোরই কি!

১ বলে ২২ রান। বৃষ্টি আইনের কোপে পড়ে ১৯৯২ বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলা হয়নি দক্ষিণ আফ্রিকার
ফাইল ছবি

ওই বর্ণবাদের কারণেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২২ বছর অস্পৃশ্য হয়ে থাকার পর ১৯৯২ বিশ্বকাপে ফিরেই সেমিফাইনাল। সেই সময়ের বৃষ্টি আইনে ১৩ বলে ২২ রানের ‘কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়’ চাহিদার ১ বলে ২২ হয়ে যাওয়া। তখন কে ভেবেছিল, বিশ্বকাপ ফাইনালে ওঠার শেষ ধাপটা পেরোতে আরও ৩২ বছর অপেক্ষা করতে হবে। যত সময় গেছে, চাপটা আরও বেড়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার গায়ে লেগে গেছে ‘সি’ আদ্যক্ষরের ওই শব্দটা। কয়েকটা প্রজন্মকে সেই বয়ে বেড়াতে হয়েছে সেই অপবাদ। সংবাদ সম্মেলনে অবধারিতভাবে কেউ না কেউ প্রসঙ্গটা তুলেছেন। কখনো কোনো সাংবাদিক ‘শব্দটা বলতে চাই না’ বলেও বুঝিয়ে দিয়েছেন, আসলে ওটাই বলছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়কদের একেকজনের একেক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ২০১১ বিশ্বকাপে গ্রায়েম স্মিথ ভীষণ রেগে গেছেন। ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এবি ডি ভিলিয়ার্স আবার নিয়েছেন অন্য কৌশল। বিশ্বকাপ শুরুর আগেই নিজেদের ‘চোকার্স’ বলে মেনে নিয়েছেন, যাতে এই প্রসঙ্গটা আর না ওঠে। কিছুতেই কিছু হয়নি।

আরও পড়ুন

শেষ পর্যন্ত একজন এইডেন মার্করামে দক্ষিণ আফ্রিকার শাপমুক্তি। অথচ তা নিয়ে তাঁর কোনো উচ্ছ্বাস নেই। সংবাদ সম্মেলনে শান্ত, নিরুত্তাপ, স্থিতধী। যখন দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ, এর ভিত্তি গড়ে দেওয়া সাবেক খেলোয়াড়দের ধন্যবাদ জানাচ্ছেন, তখনো আবেগের কোনো প্রকাশ নেই। আবেগ-উচ্ছ্বাস যা, তা শুধু পোলক-স্টেইনদের মতো দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেকদেরই। এইডেন মার্করামের মতো পরে মিক্সড জোনে এসে কথা বলা তাব্রেইজ শামসি বা মার্কো ইয়ানসেনের কাছেও এটা শুধুই চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। অতীতের কোনো দুঃস্বপ্নকে চাপা দেওয়া নয়। ইয়ানসেন তাই বলেন, ‘আমি সেদিনের ছেলে, আমার পিঠে অতীতের কোনো বোঝা নেই’। শামসি বলে দেন, ‘আমরা এখানে ফাইনালে ওঠার জন্য আসিনি, ফাইনাল জিততে এসেছি।’

এইডেন মার্করামে দক্ষিণ আফ্রিকার শাপমুক্তি
রয়টার্স

শামসি জানিয়ে দেন এই দলের আসল শক্তিও, ‘অন্য সব দল, এমনকি আগের প্রোটিয়া দলগুলোও নির্দিষ্ট কোনো ব্যাটসম্যান বা নির্দিষ্ট কোনো বোলারের ওপর নির্ভর করত। এই দলে সেই ব্যাটসম্যান কে? সেই বোলার কে? কেউই না। একজন ব্যর্থ হলে আরেকজন হাত তুলে দাঁড়িয়ে যায়।’

আরও পড়ুন

এই বিশ্বকাপে টানা ৮ জয়। সেমিফাইনালের আগে প্রায় প্রতিটিতেই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনিশ্চয়তার দোলাচল। নকআউট না হয়েও কোনো কোনোটি কার্যত নকআউট। চাপে ভেঙে পড়ার যে অপবাদ, তা মুছে দেওয়ার কাজটা তো আগেই করে ফেলেছে এই দল। এইডেন মার্করামের অধিনায়কত্বের যাতে বড় ভূমিকা। বিশ্বকাপ ফাইনাল যাঁর কাছে নতুন কিছু নয়। বিশ্বকাপই তো জেতা হয়ে গেছে তাঁর। হোক না সেটি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ। এইডেন মার্করামের মনেই ছিল না, অনূর্ধ্ব-১৯ বা মূল বিশ্বকাপ—অধিনায়ক হিসেবে কোথায় কোনো ম্যাচ হারেননি।

এই দক্ষিণ আফ্রিকা নির্দিষ্ট কারো দিকে চেয়ে থাকে না
রয়টার্স

৩২ বছরের দুঃস্বপ্নকে কবর দেওয়া দক্ষিণ আফ্রিকান অধিনায়ক যে অতীত নিয়ে ভাবেনই না, বেশি দূরের ভবিষ্যৎ নিয়েও। শামসি যেমন বলে গেছেন, এই দক্ষিণ আফ্রিকার চিন্তায় শুধুই ‘পরের ম্যাচ’।

সেই পরের ম্যাচটাই ফাইনাল। যে ফাইনালের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার ৩২ বছরের অপেক্ষা।