খেলাটা তাহলে ভারত আর দুবাইয়ের

আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি টুর্নামেন্টের শিরোপাআইসিসি

বিসিবির এক সাবেক সভাপতি একবার কুয়ালালামপুরে গিয়েছিলেন আইসিসির কী একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। তিনি নিজেও তখন আইসিসির বড় পদ অলঙ্কৃত করে আছেন। কিন্তু কুয়ালালামপুরে গিয়ে ভদ্রলোক বেজায় ক্ষুব্ধ হলেন। আইসিসির এত বড় একটা অনুষ্ঠান অথচ বিমানবন্দর থেকে মাঠ পর্যন্ত কোথাও একটা ব্যানার–ফেস্টুন নেই! এ জন্যই নাকি মালয়েশিয়ার ক্রিকেট এগোচ্ছিল না!

আরও পড়ুন

কাল দুবাইয়ে পা দিয়ে সেই কথাটাই মনে পড়ল এবং হাসি পেয়ে গেল। বাংলাদেশে ক্রিকেট যতটা না মাঠের বিষয়, কখনো কখনো এর ব্যাপ্তি তার চেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়ে মাঠের বাইরে। মাঠের বাইরে রং না লাগা মানেই যেন টুর্নামেন্টটা ঠিক জমল না। এসব দেশে বিষয়টা তেমন নয়। এখানে যার বিয়ে তার খবর যেমন ঠিকই থাকে, অন্যের বিয়েতে নাক না গলানো পাড়াপড়শিও এখানে ঠিক সময়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

দুবাই বিমানবন্দর থেকে শেখ জায়েদ সড়কের দুই পাশে আরও উঁচু এবং আরও চোখধাঁধানো হয়ে ওঠা অট্টালিকার সারি দেখতে দেখতে কাল একবারও মনে হয়নি, আরে, বুর্জ খলিফার মাথা থেকে কেন চ্যাম্পিয়নস ট্রফির একটা ব্যানার ঝুলছে না! সড়ক বিভাজনগুলোতে কেন টুর্নামেন্টের মোটিভ ফুটিয়ে তোলা হলো না! কেন বিশ্বকাপে পর ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসর উপলক্ষে বিশেষ আলোকসজ্জা নেই এই শহরে!

দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম
দুবাই স্পোর্টস সিটি ওয়েবসাইট

কিন্তু দুবাই স্পোর্টস সিটির দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সামনে এসে ঠিকই বোঝা গেল, মরুর স্বর্গ দুবাইয়ে নিত্য হতে থাকা আরও হাজারটা আয়োজনের মতো আপাতত চ্যাম্পিয়নস ট্রফিও একটা উপলক্ষ। স্টেডিয়ামের আবহে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির রং লাগিয়েছে এখনো কার্যকর না হওয়া কিছু নিরাপত্তাবলয় আর কিছু ব্যানার–ফেস্টুন।

আরও পড়ুন

দুবাই অবশ্য এবারের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির আসল জায়গাও নয়। টুর্নামেন্টের আয়োজক পাকিস্তান। সে দেশের ভেন্যুগুলোতেই এটি বেশি জাঁকজমক থাকার কথা। আজ পাকিস্তান–নিউজিল্যান্ড ম্যাচ দিয়ে টুর্নামেন্টের শুরুও করাচিতে। সেই ম্যাচ ফেলে এই প্রতিবেদকের দুবাইয়ে চলে আসার কারণ, কাল ভারতের বিপক্ষে এখানেই নিজেদের প্রথম ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ দল। প্রস্তুতি ম্যাচে পাকিস্তান শাহিনসের কাছে ৭ উইকেটের বড় ব্যবধানে হেরে বাংলাদেশ যে একটু অস্বস্তিতে পড়েছে, তা বলাই বাহুল্য। সেই অস্বস্তি কাটাতেই হোক কিংবা বিশ্রাম নিতে কাল অনুশীলন করেনি নাজমুল হোসেনের দল। এদিন বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি সীমাবদ্ধ থেকেছে টিম হোটেলে।

দুবাইয়ের প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। সংযুক্ত আরব আমিরাত মাঠের ক্রিকেটে এখনো খুব বড় কিছু হয়ে উঠতে না পারলেও অনেক ক্ষেত্রেই এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কুর্নিশ করে দুবাই–আবুধাবি–শারজাকে। শারজা তো শারজা কাপ দিয়ে অনেক আগে থেকেই ক্রিকেটে পরিচিত। বেশ কয়েক বছর ধরে এ–ও দেখা যাচ্ছে যে ক্রিকেটে যার কিছু নেই, তার আছে আবুধাবি–দুবাই-শারজা। আফগানিস্তান ঘরের মাঠে খেলতে পারে না, তাদের হোম গ্রাউন্ড হয়ে যায় আমিরাতের কোনো মাঠ। ভারত পাকিস্তানে খেলতে যাবে না, নিরপেক্ষ ভেন্যু হিসেবে আছে দুবাই। এখন তো আরব্য রজনীতে রোমাঞ্চ ছড়াতে শুরু করেছে রংবেরঙের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটও।

দুবাই স্টেডিয়ামে প্রথম ম্যাচে ভারতের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ
এএফপি

সব মিলিয়ে হলিউড, বলিউড, ব্যবসা–বাণিজ্য এবং বাংলাদেশের দেশান্তরি হওয়া রাজনীতিবিদদের মতো দুবাই ক্রিকেটকেও টানছে দারুণ আকর্ষণে। অবশ্য এ দেশে থাকা উপমহাদেশের বিপুলসংখ্যক দর্শক সেই ধারার পেছনে একটা বাণিজ্যিক যুক্তিও দাঁড় করায়। বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান খেলতে নামলে আমিরাতের মাঠে দুই দেশের যে কোনো মাঠের চেয়েই দর্শক কম হয় না।

আরও পড়ুন

চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ভারত যখন পাকিস্তানে খেলবে না বলে জানিয়ে দেয় এবং শুরুতে তুমুল প্রতিবাদ করেও শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান তা মেনে নেয়, মনে হচ্ছিল যেন আগে থেকে লিখে রাখা স্ক্রিপ্ট মেনেই দুবাই হয়ে গেছে ভারতের ‘হোম’ ভেন্যু। এ নিয়ে তর্কবিতর্ক কেবলই রাজনীতির মঞ্চ কাঁপানোর উদ্দেশ্যে। টুর্নামেন্টের আয়োজক যতই পাকিস্তান হোক, ভারতের সঙ্গে লিগ পর্বের ম্যাচ এবং এই দল ফাইনালে উঠলে সেটিও হবে দুবাইয়ে। আপাতদৃষ্টিতে এতে স্বাগতিক পাকিস্তান মাথা নত করেছে বলেই মনে হচ্ছে। তবে দিন শেষে আর্থিকভাবে দুই দেশের কারোর লাভই কম নয়।

ভালো কথা, শুধু রাজনৈতিক কারণে একটা টুর্নামেন্টের এমন সীমানা পেরোনো আয়োজনে মজার একটা বিষয় কি খেয়াল করেছেন? ভারত–পাকিস্তান এই টুর্নামেন্টে একটি কী সর্বোচ্চ দুটি ম্যাচেই মুখোমুখি হবে হয়তো। অথচ পুরো টুর্নামেন্টে তাদের নিয়েই আলোচনা, বিভেদের অদৃশ্য ছায়া! টুর্নামেন্টের সম্পূর্ণ রূপরেখা শুধুই তাদের ঘিরে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অলিখিত রাজধানী হয়ে ওঠা দুবাই যেটিকে নতুন মাত্রা তো দিচ্ছেই, দিচ্ছে একধরনের বৈধতাও।

চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ভারত–পাকিস্তান ম্যাচ নিয়েই বেশি আলোচনা হচ্ছে
এএফপি

শুধু এই দুই দলের কারণেই অন্য দলগুলোকে আজ এই দেশ, কাল ওই দেশে গিয়ে খেলতে হবে। কিন্তু এ নিয়ে কোনো দলের প্রবল আপত্তির কথা কি শুনেছেন? কেউ কি বলেছে, এমন হলে আমরা খেলব না! বলেনি। কারণ, ভারতকে বাদ দিলে যেমন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অনেকটাই ফাঁকা মাঠ, তেমনি ভারত–পাকিস্তান বৈরিতার বাড়তি ঝাঁজ না ছড়ালে এমন বৈশ্বিক টুর্নামেন্টও থেকে যায় অসম্পূর্ণ। কাজেই ঝগড়া করতে করতে চলে যাও দুবাইয়ে, যেখানে খেলা হলে কোনো ক্ষতি আর ক্ষতিকর মনে হয় না।