শেন ওয়ার্ন: বাকিটা যখন ব্যক্তিগত
২০২২ সালের এই দিনে থাইল্যান্ডের কোহ সামুইয়ে ছুটি কাটাতে গিয়ে মারা যান শেন ওয়ার্ন। অস্ট্রেলিয়ার স্পিন জাদুকরের জীবন ছিল বর্ণিল, যে জীবন ছাপিয়ে গিয়েছিল ক্রিকেটকেও। যে জীবন ছুঁয়ে গিয়েছিল অনেককেই।
আপনি হয়তো লিয়াম লিভিংস্টোন।
টি-টোয়েন্টির এই ম্যাচ-আপের যুগে বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের সামনে যেমন অফ স্পিনার, ডানহাতি এলে আবার হয়ে পড়েন লেগ স্পিনার। ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোতে তাই ইংলিশ অলরাউন্ডারের চাহিদা বেশ চড়া, মেট্রোরেল আসার আগে ঢাকার সিএনজির মতো। লিভিংস্টোনের জার্সি নম্বর ২৩। তাঁর লেগ স্পিন কিংবা ওই ২৩ নম্বর জার্সির কারণ একটিই—শেন ওয়ার্ন।
হতে পারে, আপনি ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা।
একদিকে মুত্তিয়া মুরালিধরন, তাঁর দেশের স্পিন জাদুকর। আরেক দিকে সে মুরালিধরনকে একসময় ‘চাকার’ ট্যাগ দিতে যাদের প্রবল ‘অবদান’ ছিল, সেই দেশের আরেক জাদুকর—ওয়ার্ন। দুজন যতই বন্ধু হোন না কেন, দুজনের মধ্যে কে সেরা—একটা প্রজন্মের হয়তো অনেক ঘণ্টা ব্যয় হয়েছে সে বিতর্কে। কিন্তু হাসারাঙ্গা এত কিছুর ধার না ধেরে নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারেন, তাঁর কাছে বিশ্বের সেরা স্পিনার একজনই—ওয়ার্ন।
অথবা আপনি হয়তো মেসন ক্রেন।
২০০৫ সালে ক্রেনের বয়স আট। সেবারের অ্যাশেজ দেখতে দেখতে ওয়ার্নের বোলিংয়ের মোহে পড়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন লেগ স্পিনার হবেন। ১৩ বছর পর ক্রেনের টেস্ট অভিষেক সিডনিতে। সেই এসসিজি, যেখানে ওয়ার্ন বিদায় বলেছিলেন টেস্ট ক্রিকেটকে। গত মাসে ২৭ পূর্ণ করা ক্রেন এরপর আর সুযোগ পাননি এখন পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেট খেলার, ‘ওয়ান টেস্ট ওয়ান্ডার’ হয়ে থাকবেন কি না—তা সময় বলবে।
ক্রেন এমনিতে খেলেন হ্যাম্পশায়ারে, যেটি ওয়ার্নের কাউন্টি দল, যাদের মাঠ হ্যাম্পশায়ার বোওলে ওয়ার্নের নামে একটা স্ট্যান্ড আছে। ক্রিকেটারদের ডাইনিং রুমে আগে একটা কোলাজ ছিল হ্যাম্পশায়ারের কিংবদন্তিদের। এখন সেই কোলাজের জায়গায় ওয়ার্নের বড় একটা ছবি, সঙ্গে তাঁর বিখ্যাত একটা উক্তি—‘হাল ছেড়ো না, কখনোই হাল ছেড়ো না।’
হ্যাম্পশায়ার ২০২২ সালের টি-টোয়েন্টি ব্লাস্ট শুরু করেছিল টানা চারটি ম্যাচ হেরে। কিন্তু তারা হাল ছাড়েনি, পরে ঠিকই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ক্রেন জানেন, তাঁদের ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করেছিল ওয়ার্নের ওই ছবি আর উক্তিটাও।
হয়তো আপনার নাম পিটার হ্যাটজগলু।
মেলবোর্নে করোনাভাইরাসের কোনো এক ঢেউয়ে চলছে লকডাউন। একদিন সাহস করে ইনস্টাগ্রামের ডিএমে হ্যাটজগলু নক করে বসলেন ওয়ার্নকে। উদ্দেশ্য—লেগ স্পিন নিয়ে কথা বলা। তত দিনে বিগ ব্যাশের সৌজন্যে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট হ্যাটজগলুর নামটা একটু-আধটু জানে। কিন্তু ওয়ার্ন রিপ্লাই দেবেন, কেপিএমজির মতো বিখ্যাত কোম্পানির হয়ে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পরামর্শক হিসেবে কাজ করা হ্যাটজগলুও এমনটা ভাবেননি।
শুধু যে রিপ্লাই পেলেন, তা নয়। পার্থের হয়ে বিগ ব্যাশ জেতার পর আবার মেসেজ চালাচালি শুরু হলো ওয়ার্নের সঙ্গে। ওয়ার্ন পরামর্শ দিলেন শীতে ইংল্যান্ডে গিয়ে ক্লাব ক্রিকেট খেলতে। তাহলে হানড্রেডে একটা সুযোগ মিলতে পারে। ওয়ার্ন তখন হানড্রেডের দল লন্ডন স্পিরিটের কোচ।
ইংল্যান্ডের ক্লাব সস্টন অ্যান্ড বাব্রাহামের হয়ে প্রথম যে ম্যাচটি খেলেছিলেন সপ্তাহের মাঝে, সেটি ঠিক কোন টুর্নামেন্টের, তা হ্যাটজগলু নিজেও মনে করতে পারেন না আর। ইস্ট অ্যাংলিয়ান প্রিমিয়ার লিগে অবশ্য তাদের শীর্ষে তুলতে সহায়তা করেছিলেন সবচেয়ে বেশি উইকেট নিয়ে। যদি কারও নজরে পড়েন, এ আশায় ওই লিগ খেলার পাশাপাশি কাউন্টিগুলোতেও গেছেন নেট বোলার হিসেবেও। টি-টোয়েন্টি ব্লাস্টে কেউ সুযোগ দেয়নি তাঁকে, ওয়ার্নবিহীন লন্ডন স্পিরিটও তাঁকে নিয়ে ঠিক উৎসাহ দেখায়নি।
আপনি হয়তো অ্যালানা কিং।
ভিক্টোরিয়ার কেউ ক্রিকেট খেলতে এসে বোলিং করতে নেমে লেগ স্পিন করবেন না—সেটি হতে পারে না। আরেকটু ছোট থাকতে ওয়ার্নের সঙ্গে কয়েকটা সেশন করেছিলেন কিং। তাঁকে দেওয়া ওয়ার্নের বার্তা ছিল সোজাসাপটা—যত পারো বল ঘুরাও, আর উপভোগ করো।
কিং এরই মধ্যে বিশ্বকাপ জিতেছেন, কমনওয়েলথ গেমসে সোনা জিতেছেন। তখন পর্যন্ত কখনোই না পাওয়া হ্যাটট্রিকটাও কিং পেয়ে যেতে পারতেন কমনওয়েলথ গেমসেই, বার্বাডোজের বিপক্ষে ম্যাচে। হ্যাটট্রিক-বলে অধিনায়ক মেগ ল্যানিং সহজতম ক্যাচ ফেলে দেওয়াতে তা আর হয়নি।
১৯৯৯ সালে ওয়ার্ন যেমন স্লিপে ফেলেছিলেন পেসার ড্যামিয়েন ফ্লেমিংয়ের হ্যাটট্রিক-বলে সহজতম ক্যাচ। তার আগেই টেস্টে একটা হ্যাটট্রিক ছিল ফ্লেমিংয়ের, দ্বিতীয় হ্যাটট্রিকটাও পেয়ে গিয়েছিলেন বলেই ধরে নিয়েছিলেন। অনেক বছর পর এক সাক্ষাৎকারে যখন সেই আক্ষেপের কথা বলছেন ফ্লেমিং, পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া ওয়ার্ন সেই কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে যান এভাবে, ‘কাম’ন মেট, ইউ ডোন্ট ডিজার্ভ টু হ্যাটট্রিকস!’
‘কাম’ন মেট, ইউ ডোন্ট ডিজার্ভ টু হ্যাটট্রিকস!’ড্যামিয়েন ফ্লেমিংকে শেন ওয়ার্ন
আপনি রেহান আহমেদও হতে পারেন।
১৩ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের নেটে রেহান বোলিং করার সময় কেউ একজন ডেকে আনলেন ওয়ার্নকে। রেহানের বোলিং দেখে, তাঁর সঙ্গে সময় কাটিয়ে ওয়ার্ন ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, ‘দ্রুতই তোমার বোলিংয়ের ধারাভাষ্য দেব আমরা।’
রেহানের টেস্ট অভিষেক দ্রুতই হয়েছে, সবচেয়ে কম বয়সী ইংলিশ বোলার হিসেবে ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়ার রেকর্ডও গড়েছেন। ওয়ার্ন অবশ্য রেহানের বোলিংয়ের ধারাভাষ্য দিতে পারেননি।
আপনি হয়তো কোনো ক্রিকেটার নন, নেহাত ক্রিকেটকে ভালোবেসে এক অদ্ভুত ঘোরে পড়ে যাওয়া কেউ।
যার কাছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধু স্পিন বোলিং নয়, বোলিংয়েরই শেষ কথা শেন ওয়ার্ন। লেগ স্পিনের শুরু না হতেই শেষ ক্যারিয়ারে আপনার সবচেয়ে বড় সাফল্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিত্যক্ত বাস্কেটবল কোর্টের টেনিস বলের ক্রিকেটে এক বন্ধুকে অ্যারাউন্ড দ্য লেগে বোল্ড করা, তা সে বন্ধু অমনভাবে আউট হওয়ার ক্ষেত্রে যতই অজুহাত দাঁড় করাক না কেন।
ওয়ার্নের সঙ্গে আপনার সে অর্থে ‘সরাসরি সংযোগ’ শুধু একটা ছবি। খুব কাছের এক ভাই বিশ্বকাপ কাভার করতে গিয়ে ওয়ার্নের সঙ্গে তোলা তাঁর একটা ছবি আপনাকে ট্যাগ করে পোস্ট করেছিলেন। ওল্ড ট্রাফোর্ডে তোলা। ডান হাতে ফোন আর সানগ্লাস ধরা ওয়ার্নের মুখে হাসি, বাঁ হাতে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার। সে ছবিটা দেখলে ছোটবেলায় বড় বোনের জোরে জোরে পড়া যুক্তিবিদ্যার অদ্ভুত সেসব তত্ত্বগুলোর কথা মনে পড়ে আপনার—আপনি টেবিলের ওপরে রাখা বই ছুঁয়েছেন, আপনি মাটি ছুঁয়েছেন, ফলে বই মাটি ছুঁয়েছে!
****
নব্বইয়ের দশকে, যখন ফর্মুলা ওয়ান ড্রাইভার ড্যানিয়েল রিকার্ডো কিংবা আরও অনেকের শৈশবেরই একটা বড় অংশের নাম ওয়ার্ন, যখন ‘সব মেয়েই ওয়ার্নকে ভালোবাসে, সব ছেলেই ওয়ার্নের মতো হতে চায়’। সেই ঘোর লাগা সময়ে ১৮ বছর বয়সে একদিন কানে ফুটো নিয়ে ঘরে ফিরলেন ব্রেট লি। মা চমকে উঠলেন ভূত দেখার মতো করে। লি কান ফুটো করেছিলেন, কারণ ওয়ার্ন দুল পরতেন। লি যতই পরে ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম দ্রুতগতির বোলার হয়ে উঠুন না কেন, তিনিও ঠিকই মজেছিলেন ওই হেলতে দুলতে, নেহাত একটু রানআপ নিতে হয় বলেই কয়েক কদম হেঁটে এসে, অনেক আয়েশি ভঙ্গিতে বোলিং করা একজন ওয়ার্নের স্টাইলে। সে বল পিচে পড়ে ব্যাটসম্যানের কী হাল করল, তাতে আপনার বয়েই গেল।
নব্বইয়ের দশকে, যখন ফর্মুলা ওয়ান ড্রাইভার ড্যানিয়েল রিকার্ডো কিংবা আরও অনেকের শৈশবেরই একটা বড় অংশের নাম ওয়ার্ন, যখন ‘সব মেয়েই ওয়ার্নকে ভালোবাসে, সব ছেলেই ওয়ার্নের মতো হতে চায়’। সেই ঘোর লাগা সময়ে ১৮ বছর বয়সে একদিন কানে ফুটো নিয়ে ঘরে ফিরলেন ব্রেট লি।
লির গল্প শুনে হয়তো আপনার সে বন্ধুর কথা মনে পড়ে যায়, যে কানে ফুটো থাকার পরও ওয়ার্নের মতো অমন দুল পরার সাহসটা ঠিক করে উঠতে পারেননি। তবে ইচ্ছাটা সযতনে আগলে রেখেছে এখনো। যেমন আমরা রাস্তায় চলতে-ফিরতে, এখানে-সেখানে হুট করেই ঘুরিয়ে আনি হাতটা, কল্পনায় যখন আমরাও হয়ে উঠি একজন ওয়ার্ন।
সেই লির ওপর আপনার অবশ্য একটু ‘অভিমান’ আছে। আপনি ওয়ার্নের ভক্ত, ওদিকে আবার ইংল্যান্ডের। আর্কেড গেমসের দোকানের টেলিভিশনে ওই ২০০৫-এর অ্যাশেজ দেখতে দেখতে, কেভিন পিটারসেনের শটে উল্লসিত হওয়ার খানিক পরই ক্যামেরা প্যান করে যখন ওয়ার্নের মুখের দিকে নেয়—তখন হয়তো ‘সব পেয়েও কী যেন হারালাম’ অনুভূতিটা হয় আপনার, নেহাত ওই বয়সে সেটি এভাবে প্রকাশ করতে পারেন না।
বছর দশেক আগে লর্ডসে এমসিসি বনাম রেস্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ডের এক ম্যাচে আপনার রোমাঞ্চকর অপেক্ষা ছিল সরাসরি লাল বলে আরেকবার ওয়ার্নের বোলিং দেখবেন বলে। তার আগে ব্যাটিং, আর সেটি করতে গিয়েই ওয়ার্নের হাত ভাঙল লির হাত ফসকে বেরিয়ে আসা বিমারে। টেলিভিশনে শেষ একবার ওয়ার্নকে লাল বলে সরাসরি বোলিং করতে না দেখতে পাওয়ার আক্ষেপটা হয়তো থেকেই গেছে আপনার।
যেমন আক্ষেপ ছিল মাইকেল আর্লের। ওয়ার্নকে সেঞ্চুরি না করতে দেখে। আর্ল অস্ট্রেলিয়ার মার্গারেট রিভার শহরের এক ইলেকট্রিশিয়ান এখন। তাঁর নামটা আপনার না জানার সম্ভাবনাই বেশি। তবে আর্লের একটা ভিডিও আপনি দেখে থাকতে পারেন।
ওয়ার্ন কখনো অস্ট্রেলিয়াকে নেতৃত্ব দেননি, তা নিয়ে তাঁর নিজের বেশি আক্ষেপ হওয়ার কথা, নাকি অস্ট্রেলিয়ার—সেটি বিতর্কের প্রসঙ্গ হতে পারে। তবে ওয়ার্নের একটা আক্ষেপ আছে ঠিকই। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে কখনোই যে সেঞ্চুরি পাওয়া হয়নি তাঁর! ২০০১ সালে পার্থে সেটির খুব কাছে চলে গিয়েছিলেন। ৯৯ রানে দাঁড়িয়ে, দিনের একেবারে শেষে ড্যানিয়েল ভেট্টোরির বলে ‘কুৎসিত এক স্লগ’ খেলার সিদ্ধান্ত নেওয়াতে সেটি আর হয়নি। ওয়ার্ন যখন নিজেকে শাপশাপান্ত করতে করতে ফিরছেন, তখনই জানলেন, ভেট্টোরির বলটি ছিল আদতে নো! যা আম্পায়ারের চোখ এড়িয়ে গেছে।
এক দর্শকের প্রতিক্রিয়া অবশ্য কারও চোখ এড়াল না। বাচ্চা ছেলে, মাত্রই কৈশোরছোঁয়া বলা যায়। সাদা টি-শার্টের ওপর লেখা, ‘ওয়ার্নিস্ গ্রাউস অ্যাট ক্রিকেট।’ মাথার হ্যাটটি কাপড়ের তৈরি, সেটিকেই আছড়ে মারছে বারবার। ওয়ার্ন ৯৯ রানে আউট হবেন, মানতেই পারছে না।
১৩ বছর পর একটা বিয়ার ছেড়েছিলেন ওয়ার্ন, নাম ছিল ‘নাইন্টি নাইন নট আউট।’ সেটির উদ্বোধনে ওয়ার্ন ডেকে পাঠিয়েছিলেন সেই ‘ক্ষুব্ধ আর হতাশ’ ভক্তকে, যাকে খুঁজে বের করেছিলেন টুইটারে। আর্লের কাছে পার্থে ওই দিন ১ রান নিতে না পারার জন্য ক্ষমাও চেয়েছিলেন ওয়ার্ন।
দর্শক-সমর্থকদের সঙ্গে ওয়ার্নের সম্পর্ক ছিল একটু আলাদা।
১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডের সঙ্গে একপেশে জয়ের এক ম্যাচে হুট করেই উত্তপ্ত হয়ে উঠল এমসিজির গ্রেট সাউদার্ন স্ট্যান্ডের দর্শক। মাঠের মধ্যে ছুটে আসছে বিয়ারের বোতল, গলফের বল। আম্পায়াররা খেলা বন্ধ করে দিলেন। ইংল্যান্ড অধিনায়ক অ্যালেক স্টুয়ার্ট ড্রেসিংরুমের দিকে ইশারা করছিলেন একজনকে ডেকে পাঠাতে। এক হাত উল্টো দিকে ঘুরিয়ে আনছিলেন —লেগ স্পিন মানেই তো ওয়ার্ন।
পায়ে স্যান্ডেল চেপে বেরিয়ে এলেন ভিক্টোরিয়ার ঘরের ছেলে। সঙ্গে সঙ্গেই চিৎকার, খেলা দেখার চেয়ে ওয়ার্নকে দেখেই তখন বেশি খুশি এমসিজির দর্শক! স্টুয়ার্টের সঙ্গে কথা বলে ওয়ার্ন এগিয়ে গেলেন ওই গ্যালারির দিকে। মজা করে মাথায় একটা হেলমেটও পরলেন। গিয়ে শুধু ইশারা করলেন, ‘আর কিছু ছুড়ে মেরো না!’
যেমন অন্য ওয়ার্নকে দেখেছিলেন হ্যাম্পশায়ার-ল্যাঙ্কাশায়ারের হয়ে কোনো এক ম্যাচের দ্বাদশ খেলোয়াড়। ওল্ড ট্রাফোর্ডের সে ম্যাচ শুরুর আগে ল্যাঙ্কাশায়ারের হয়ে খেলা মুত্তিয়া মুরালিধরন মাঠের মাঝে বোলিং অনুশীলন করবেন বলে ডাক পড়ল তাঁর। বেসবল গ্লাভস হাতে মুরালির সঙ্গী তাই ওই দ্বাদশ খেলোয়াড়। পাশ দিয়েই যাচ্ছিলেন ওয়ার্ন, মুরালিকে দেখে যোগ দিলেন তিনিও। স্পিন বোলিংয়ের দুই জাদুকর একজন আরেকজনের অ্যাকশন নকল করা শুরু করলেন, যা চলল প্রায় ২০ মিনিট।
এই সুযোগে ওই দ্বাদশ খেলোয়াড় ওয়ার্নকে অনুরোধ করলেন, দিনের খেলা শেষে জার্সিতে যদি একটা অটোগ্রাফ দিতেন। ওয়ার্ন কথা দিলেন। কিন্তু সেই ম্যাচেই চোট পাওয়ায় খেলার পর ওয়ার্নকে ব্যস্ত থাকতে হলো ফিজিওর সঙ্গে। যা জেনে দীর্ঘশ্বাস ওই খেলোয়াড়ের—অটোগ্রাফটা তো তাহলে আর পাওয়া হলো না! কিন্তু দিনের খেলা শেষ হওয়ার ঘণ্টাখানেক পর ওয়ার্ন ঠিকই পার্কিংয়ে খুঁজে নিলেন তাঁকে। জার্সিতে সই দিলেন, দশ মিনিট কথা বললেন। ওই দ্বাদশ খেলোয়াড়ের এখনকার অফিসে এখনো শোভা পায় মুরালি ও ওয়ার্নের অটোগ্রাফ সংবলিত সেই জার্সি। আর মনের কোণে যে সেই ১০ মিনিট যত্নে রাখা, সেটিও অনুমান করে নিতে পারি আমরা।
মাঠের মধ্যে ছুটে আসছে বিয়ারের বোতল, গলফের বল। আম্পায়াররা খেলা বন্ধ করে দিলেন। ইংল্যান্ড অধিনায়ক অ্যালেক স্টুয়ার্ট ড্রেসিংরুমের দিকে ইশারা করছিলেন একজনকে ডেকে পাঠাতে। এক হাত উল্টো দিকে ঘুরিয়ে আনছিলেন —লেগ স্পিন মানেই তো ওয়ার্ন।
জেমস অ্যান্ডারসনের বন্ধু, বিবিসি রেডিওর হোস্ট গ্রেগ জেমসের কাছে যেমন এখনো তরতাজা ৮ বছর বয়সে ওয়ার্নের সঙ্গে কাটানো ১ মিনিট। ইংল্যান্ড সেদিন অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছিল, স্বাভাবিকভাবেই অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের মেজাজ ঠিক স্বাগতিক দর্শকদের সঙ্গে সময় কাটানোর মতো ফুরফুরে ছিল না। কিন্তু ওয়ার্ন তো আলাদা। জেমস তাই ঠিকই প্রথম কোনো ক্রিকেটারের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। মিলেছিল অটোগ্রাফও।
অস্ট্রেলীয় ওয়ার্নের অবশ্য ইংল্যান্ডের সঙ্গে সম্পর্কটা বরাবরই ঘনিষ্ঠ। একসময় তো সে দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসই শুরু করে দিয়েছিলেন প্রায়। সেটি হয়নি তখনকার স্ত্রী সিমোন কালাহানের সঙ্গে সম্পর্কটা ছিন্ন হয়ে যাওয়ায়। ২০০৫ অ্যাশেজে ওয়ার্নের স্পর্শকাতর ওই জায়গাটায় খোঁচা দেওয়ার সুযোগটা ছাড়েননি ইংলিশ সমর্থকেরা। সেই তাঁরাই অ্যাশেজের শেষ দিকে গিয়ে যখন বুঝেছেন, ওয়ার্নকে আর তাঁদের মাটিতে খেলতে দেখবেন না, গেয়ে উঠেছেন, ‘উইশ ইউ ওয়্যার ইংলিশ’! ইংলিশদের আফসোস, ওয়ার্ন ‘যদি তাদের হতেন!’
ওয়ার্ন হাসতে হাসতে তখন ভঙ্গি করেছেন, তিনি শুনতে পাচ্ছেন না। এরপর ঠিকই হ্যাটটা খুলে হাতে নিয়েছেন।
প্রায় এক যুগ পর, ওয়ার্ন ইংল্যান্ডের জার্সি পরেছিলেন। মাঠে নয়, ধারাভাষ্যকক্ষে। ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির গ্রুপ পর্বে অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ডকে হারাবে, সৌরভ গাঙ্গুলীর সঙ্গে এমন বাজিতে হারার পর। তারও বছর পাঁচেক পর, ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে একটা মিম পোস্ট করবেন ওয়ার্নের সঙ্গে ছবি তোলা সেই ভাই, ওয়ার্নের সেই ছবির ওপরে ক্যাপশনে লেখা—দ্য গ্রেটেস্ট ক্রিকেটার এভার টু ওয়্যার অ্যান ইংল্যান্ড জার্সি।
ওই পোস্টের দিন চারেক পর কোন সংবাদ আসবে থাইল্যান্ড থেকে, আমরা যদি জানতাম!
****
লিভিংস্টোন এখনো ২৩ নম্বর জার্সি পরেই খেলেন। অবশ্য কখনো মেলবোর্ন স্টারসের হয়ে খেললে একটু ঝামেলায় পড়বেন—২৩ নম্বর জার্সিটা অবসরে পাঠিয়েছে বিগ ব্যাশের দলটি।
হাসারাঙ্গার আদর্শ ওয়ার্ন কখনো অস্ট্রেলিয়াকে নেতৃত্ব দেননি, যেমন শ্রীলঙ্কাকে দেননি মুরালিধরন। তবে এই লেগ স্পিনার এখন শ্রীলঙ্কার টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক।
ক্রেনের আক্ষেপটা থেকে যাবে, আর কখনোই ওয়ার্নের সঙ্গে কাজ করতে পারবেন না বলে। লন্ডন স্পিরিটে এক মৌসুম ওয়ার্নের কোচিংয়ে খেলেছিলেন। ইংলিশ লেগ স্পিনারের মতে, লন্ডন ছিল তখন স্পিনারদের কাছে স্বপ্নের এক জায়গা। তবে তৃপ্তিটা রয়ে গেছে—তিনি ওয়ার্নের সঙ্গে কাজ করেছেন। তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা সময় ছিল ওই মাস দেড়েক, যা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।
হ্যাটজগলু অবশ্য ওয়ার্নের সঙ্গে এমন কাজ করার সুযোগ পাননি। ওয়ার্ন নেই, তাঁর পরামর্শ স্মরণ করে এরপরও ইংল্যান্ড যাবেন কি না—এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন। ইংল্যান্ড যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এক বন্ধুর কথা শুনে, ‘আর যা-ই হোক, অ্যাকাউন্ট্যান্টদের জন্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদার শেষকৃত্য হয় না কিন্তু!’
হ্যাটজগলু হানড্রেডে ঠিকই খেলেছেন। সুনীল নারাইনের বদলি হিসেবে ওভাল ইনভিন্সিবলসের হয়ে। একসময় ওয়ার্নের মতো ক্ল্যাসিক্যাল লেগ স্পিনের চেষ্টা করতেন, কিন্তু ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতা তাতে একটু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হ্যাটজগলু তাই বদলে ফেলেন অ্যাকশন। পরে ব্লাস্টে খেলেছেন গ্ল্যামারগনের হয়ে। খেলে ফেলেছেন সিপিএল, পিএসএলের মতো লিগেও। এখনো কোনো কিছু নিয়ে হতাশা ঘিরে ধরলে তাঁর ভরসা ফোনের ফেবারিট সেকশনে সেভ করে রাখা ৫ মিনিটের একটি ভিডিও ক্লিপ। সেখানে তিনি বোলিং করছেন, আর ধারাভাষ্য দিচ্ছেন ওয়ার্ন।
কিংয়ের হ্যাটট্রিক না পাওয়ার আক্ষেপ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। হানড্রেডে ট্রেন্ট রকেটসের হয়ে সেটি পেয়ে যান ম্যানচেস্টার অরিজিনালসের বিপক্ষে। ওল্ড ট্রাফোর্ডে, যে মাঠে অ্যাশেজে করা নিজের প্রথম বলটা বদলে দিয়েছিল ওয়ার্নের জীবনটাই। হয়তো ক্রিকেটই। কিংয়ের জীবনে এখনো প্রতিদিনের মন্ত্র—বলটা ঘোরাও, জীবন উপভোগ করো।
রেহান হুট করেই কদিন আগে হয়ে পড়েছিলেন ইংল্যান্ডের সবচেয়ে ‘অভিজ্ঞ’ স্পিনার। মেডেন করা ‘বোরিং’, এমন কথা বলেও এসেছেন আলোচনায়। ওয়ার্ন যেমন আজীবন বলে গেছেন, ম্যাচের আগে ওয়ার্ম-আপ ‘ফালতু’।
এমসিজির গ্রেট সাউদার্ন স্ট্যান্ডের নামকরণ করা হয়েছে ওয়ার্নের নামে। যে গ্যালারিতে বসে ওয়ার্ন অ্যাশেজের খেলা দেখতেন ভাই আর বাবার সঙ্গে বসে, যে গ্যালারিকে একবার শান্ত করেছিলেন মাথায় হেলমেট আর পায়ে স্যান্ডেল চেপে, যে গ্যালারির সামনে নিয়েছিলেন ৭০০তম উইকেট।
স্কাই স্পোর্টসে ওয়ার্নের ছবি এখনো থাকে ধারাভাষ্যকক্ষে। কোল্ডপ্লে তাদের কনসার্টে ওয়ার্নকে স্মরণ করে, রাসেল ক্রো, এড শিরান বা মিক জ্যাগারও হয়তো মিস করেন ওয়ার্নকে। ইংল্যান্ডের মাটিতে ওয়ার্ন শেষ টেস্টটা খেলেছিলেন ওভালে, সেখানে কোনো এক জায়গায় বিশেষ এক উদ্দেশ্যে গেলে আপনি দেখতে পাবেন ছোট একটা ফলক—শেন ওয়ার্ন স্মোকিং কর্নার।
ব্রিস্টলে একসময় ক্লাব ক্রিকেট খেলতে গিয়ে কোনো এক পরিবারকে বাগানের এক ছোট জলাশয় খুঁড়তে সহায়তা করেছিলেন তখনকার অখ্যাত ওয়ার্ন। সে পরিবার তাদের ওই পুকুরের নাম বদলে রেখেছে ওয়ার্নের নামে।
আর ফেসবুকের কাভার ফটোতে এখনো ওয়ার্নের ছবি ঝুলিয়ে রাখা আপনি হয়তো মাঝে মাঝেই আশ্রয় খোঁজেন ওয়ার্নের অবসরের পর মাইকেল আথারটনের একটা লেখায়। যার শেষ কয়েকটা লাইন, ‘এভরি লেগ স্পিনার উইল বি কম্পেয়ারড টু ওয়ার্ন…উই উইল নেভার সি এনিথিং ক্লোজার টু পারফেকশন।’
কারণ একটা পর্যায়ে গিয়ে আমরা মেনেই নিই, ক্রিকেটের মতো জীবনেও ওয়ার্ন হয়তো একজনই আসেন।