বল টেম্পারিংয়ের কলঙ্ক ভুলিয়ে যেভাবে স্মিথের পুনরুত্থান
২০১৮ কেপটাউন টেস্টে অস্ট্রেলিয়া দলের বল বিকৃতি-কাণ্ড ক্রিকেট-বিশ্ব নাড়িয়ে দিয়েছিল। পিটার স্মিথ তো কষ্ট সইতে না পেরে সব ক্রিকেটসামগ্রী বাড়ির গ্যারেজে ছুড়ে মেরেছিলেন। টিভি ক্যামেরায় সেই দৃশ্য ধরা পড়তেই তিনি বলতে শুরু করেন, ‘সে এখন ভালো থাকবে, সে টিকে থাকবে, সে বেঁচে থাকবে ...।’
প্রশ্ন উঠতে পারে—এই পিটার স্মিথ আবার কে? কার কথাই বা বলছিলেন তিনি? পিটার হলেন স্টিভেন স্মিথের বাবা। অস্ট্রেলিয়ার সে সময়ের অধিনায়ক স্মিথ আর সহ-অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নারের নির্দেশেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে কেপটাউন টেস্টে সিরিশ কাগজ দিয়ে বল বিকৃত করেছিলেন ক্যামেরন ব্যানক্রফট।
অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় স্মিথ, ওয়ার্নার ও ব্যানক্রফটকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এক বছরের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। স্মিথের নেতৃত্ব কেড়ে নেওয়া হয় চিরতরে। জরুরি ভিত্তিতে ডেকে পাঠানো হয় দেশে।
সিডনি বিমানবন্দরে পৌঁছে অনুতপ্ত স্মিথ কান্নায় ভেঙে পড়েন। সংবাদমাধ্যমের চোখ এড়িয়ে যেতে পারেননি কিছুতেই। জীবনের সবচেয়ে কঠিন সংবাদ সম্মেলনে পাশে পেয়েছিলেন বাবা পিটারকে। পিঠে হাত বুলিয়ে পিটার ছেলেকে সান্ত্বনা দিতে থাকলেও স্মিথের কান্না থামানো যায়নি।
সে দিনের ওই দৃশ্য দেখে কজন ভেবেছিলেন, আবার রুদ্ররূপে দেখা দেবেন স্মিথ! কলঙ্ক ভুলিয়ে লিখবেন পুনরুত্থানের গল্প। তাঁর ঘোরতর সমালোচকেরাও হয়তো ভাবেননি নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফেরার পর ব্যাটিংকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যাবেন স্মিথ।
২০১৮ সালের মার্চে নিষেধাজ্ঞা পাওয়া স্মিথ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরেন ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপ দিয়ে। সেমিফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ডের কাছে হেরে শিরোপা ধরে রাখার স্বপ্ন শেষ হয়ে যায় অস্ট্রেলিয়ার। রান সংগ্রাহকদের তালিকায় স্মিথেরও নাম ছিল না শীর্ষ দশে। তবে প্রত্যাবর্তনের টুর্নামেন্টে ৩৭.৯০ গড়ে ৩৭৯ রান একেবারেই মন্দ নয়। করেছিলেন ৪টি ফিফটি। ৭৩, ৬৯, ৭৩ ও ৮৫ রানের ইনিংসগুলোর প্রতিটিতে ছিল আত্মবিশ্বাসের ছাপ। শুধু সেঞ্চুরিতে রূপান্তর করতে পারেননি, এই যা।
স্মিথের নিজেকে ফিরে পাওয়ার শুরু ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর থেকে। ওই বছরই অ্যাশেজ সিরিজ খেলতে নামে অস্ট্রেলিয়া, যেটাকে তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা সিরিজ বিবেচনা করা হয়। ইংল্যান্ডের কঠিন উইকেটগুলোতে ৪ ম্যাচে ১১০.৫৭ গড়ে ৭৭৪ রান, ভাবা যায়! চোটের কারণে হেডিংলি টেস্ট থেকে ছিটকে না গেলে হয়তো অ্যাশেজে হাজার রানের কীর্তি গড়তেন ডানহাতি এ ব্যাটসম্যান। তবে ৭ ইনিংসে যা করেছেন, সেটাই তাঁর পুনরুত্থানের জন্য যথেষ্ট ছিল।
ঈর্ষণীয় এই সাফল্যের পরও পুরোপুরি তৃপ্ত হতে পারছিলেন না স্মিথ। দেশে ফিরেই নিজের খেলাকে অন্য মাত্রায় নিতে কাজ শুরু করে দেন। বিশেষ করে দীর্ঘ ভ্রমণের ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবার মাঠে নামার পর প্রতিপক্ষ বোলাররা লেগ সাইডে ফিল্ডিং সাজিয়ে লাগাতার শট বলে তাঁকে আউট করার চেষ্টা করতেন। ব্যাটিং স্ট্যান্সের সময় দু–তিন ধাপ বাঁ দিকে চলে আসায় মিডল আর লেগ স্টাম্প পুরোপুরি অরক্ষিত থাকত তাঁর।
মূলত এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘদিন পরিশ্রম করে গেছেন স্মিথ। শেষ পর্যন্ত সফলও হয়েছেন। গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে ক্রিজে আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে করা ‘ট্রেডমার্ক শাফল’ বাদ দিয়ে দেন স্মিথ। শুধু অফ স্টাম্পের অনেক বাইরের বলগুলোকে আগের ভঙ্গিতে খেলে থাকেন। তাঁর এই নতুন ব্যাটিংশৈলীকে বলা হচ্ছে ‘স্মিথের দ্বিতীয় সংস্করণ বা স্মিথ ২.০’।
নতুন ব্যাটিং স্ট্যান্সের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়ার পর টেস্ট–ওয়েনডের পাশাপাশি টি–টোয়েন্টিতেও বোলারদের জন্য আরও বড় হুমকি হয়ে উঠেছেন স্মিথ। এবারের বিগ ব্যাশ লিগে ওপেনিংয়ে নেমে তাঁর জোড়া সেঞ্চুরি সে কথাই বলছে। একটিতে ৫৬ বলে ১০১, অন্যটিতে ৬৬ বলে অপরাজিত ১২৫। দুবারই স্ট্রাইক রেট ১৮০–এর ওপরে! নতুন বছরে খেলা একমাত্র টেস্ট ইনিংসেও করেছেন সেঞ্চুরি।
নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার পর আরও পরিণত ক্রিকেট খেলছেন স্মিথ। কেপটাউনে কলঙ্কমাখা টেস্টের পর ১০১ ইনিংসে ৪৫১১ রান করেছেন স্মিথ। গড় ৫১.২৬, যা তাঁর ক্যারিয়ারের গড়ের চেয়ে বেশি। এ সময়ে স্ট্রাইক রেটও বেড়েছে। ২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে ছিল ৬৪.৯২, পরের পাঁচ বছরে ৬৬.১৪।
নিজের ব্যাটিংকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যাওয়া স্মিথ কাঙ্ক্ষিত পুরস্কারটাও পেয়েছেন। গতকাল অস্ট্রেলিয়ার বর্ষসেরা ক্রিকেটারের স্বীকৃতি অ্যালান বোর্ডার মেডেল জিতেছেন ৩৩ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান। নিজেকে নিয়ে গেছেন বিশ্বকাপজয়ী সাবেক দুই অধিনায়ক রিকি পন্টিং ও মাইকেল ক্লার্কের পাশে। পন্টিং–ক্লার্কের মতো স্মিথও যে বর্ষসেরার স্বীকৃতি পেয়েছেন চারবার!
কাল পুরস্কার নিতে এসে স্মিথ জানিয়েছেন, কীভাবে ব্যাটিংকে নতুন রূপ দিয়েছেন, ‘খুব সম্ভবত ২০১৯ অ্যাশেজ খেলে ফেরার পর এটা নিয়ে কাজ শুরু করি। শুনতে অদ্ভুত লাগতে পারে। তবে আমি অনুভব করেছি, আমার মন সঠিক জায়গাতেই ছিল। আমি পরিকল্পনা অনুযায়ী খেলতে পেরেছি। যদিও খুব বেশি বড় শট খেলতে পারিনি। পরে এটাকেও ছোটখাটো দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করেছি।’
২০১৪–১৫ মৌসুমে ক্যারিয়ারের সেরা সময় কাটিয়েছেন স্মিথ। নিজেকে আগের জায়গায় নিতে সে সময়ের ভিডিও পর্যবেক্ষণ করেছেন তিনি, ‘আপনারা হয়তো বিশ্বাস করবেন না, আমি দীর্ঘ সময় ধরে ফুটেজ দেখেছি। বিশেষ করে ২০১৫ সালের ইনিংসগুলোর। ওই সময় ভারতের বিপক্ষে সিরিজে আমার সেরা ব্যাটিং করেছি, এরপর বিশ্বকাপেও। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে আমাকে অতীতে ফিরে যেতে হয়েছে।’
স্মিথের সামনে এখন দুটি বড় চ্যালেঞ্জ। ভারতের মাটিতে বোর্ডার–গাভাস্কার ট্রফি পুনরুদ্ধারের অভিযান শেষে ইংল্যান্ডে অ্যাশেজের ‘ছাইদানি’ ধরে রাখার লড়াই।
২০০৪ সালের পর ভারতে টেস্ট সিরিজ জিততে না পারা অস্ট্রেলিয়া এবার আক্ষেপ ঘোচাতে চেয়ে থাকবে স্মিথের ব্যাটের দিকে। একসময় আইসিসি টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে থাকা ব্যাটসম্যান তাঁর কথায় দলকে ভরসা জুগিয়েছেন, ‘উপমহাদেশের কিছু উইকেটের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছি। স্পিন সহায়ক পিচ এখন বেশ উপভোগ করি। ভারতে ফ্ল্যাট উইকেটও বানানো হয়। সুযোগ পেলেই বড় ইনিংস খেলতে হবে। এই বার্তা আমি সতীর্থদের কাছে পৌঁছে দেব।’
সকালের সূর্য দেখে নাকি বোঝা যায়, দিনটি কেমন যাবে। বিগ ব্যাশে টানা দুটি সেঞ্চুরি আর টেস্টে এক ইনিংস খেলে সেঞ্চুরি—২০২৩ সালটা স্মিথ যেভাবে শুরু করেছেন, তাতে বছর শেষে তাঁর ৩.০ সংস্করণ দেখলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।