বুমরার সঙ্গে লাগল কনস্টাসের, সিডনির কুরুক্ষেত্র কি থামাতে পারবেন শরফুদ্দৌলা
সিডনি কি আগামীকাল কুরুক্ষেত্র হবে? আজ দিনের খেলার শেষ ১৫ মিনিটের খেলায় তেমনই মনে হলো।
ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা। সেখানে মহাভারতের যুদ্ধের প্রসঙ্গ টানাটা বাড়াবাড়ি মনে হতেই পারে। তবে আজ সিডনি টেস্টের প্রথম দিনে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসে চোখ রাখলেই ব্যাপারটি ধরতে পারা সম্ভব। অ্যাডিলেডে ট্রাভিস হেড–মোহাম্মদ সিরাজ বাদানুবাদে উসকে ওঠা আগুনটা মেলবোর্নে হলকা দিয়ে জ্বলে ওঠার পর আজ সিডনির শেষ বিকেলে ভালোই পুড়িয়েছে। কী? সময়।
যশপ্রীত বুমরা যেভাবে এগিয়ে গিয়েছিলেন স্যাম কনস্টাসের প্রতি! উসমান খাজা আউট হওয়ার পর ভারতের খেলোয়াড়েরা যেভাবে কনস্টাসের সামনে অগ্নিমূর্তিতে উল্লাস করলেন—এসব দেখে শঙ্কা জাগতেই পারে, ক্রিকেট খেলাটা আগামীকাল সিডনিতে ‘জেন্টলম্যানস গেম’ না–ও থাকতে পারে!
কিংবা ক্রিকেটীয় ভাষায় বলা যায়, সিডনি টেস্ট জমে গেল প্রথম দিনেই। ভারত প্রথম ইনিংসে ১৮৫ রানে অলআউট হওয়ার পর অস্ট্রেলিয়া ১ উইকেটে ৯ রানে দিনের খেলা শেষ করেছে। এই স্কোরকার্ড দেখে আগুনে উত্তাপটা আসলে বোঝা যায় না। চাইলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপস দেখতে পারেন।
অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসের প্রথম বলেই কনস্টাস যেভাবে এগিয়ে এসে চার মেরে বোলার বুমরার চোখে চোখ রাখলেন, আগুনটা লাগল কি সেখান থেকেই? নাকি মেলবোর্ন টেস্টে কনস্টাসের কাঁধে কোহলির ধাক্কা? সূত্রপাত যেটাই হোক, সিডনিতে টইটম্বুর গ্যালারির বাইরেও দর্শক যে কাল থেকে বাড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সন্দেহ নেই চোখ থাকবে কনস্টাসের ওপরও। আজ সকালে মাঠে নেমেই ইতিহাস গড়েছেন এই ১৯ বছর ৯৩ দিন বয়সী ওপেনার। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এসসিজি) সর্বকনিষ্ঠ অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে টেস্ট খেলার ১১৭ বছরের পুরোনো রেকর্ডটি ভেঙেছেন। দিয়েছেন বিনোদনও।
বুমরার করা প্রথম ওভারে দ্বিতীয়বার এগিয়ে গিয়ে বল ব্যাটে না লাগাতে পারায় সিডনির প্রেসবক্সে হাসিতে ফেটেও পড়েন ভারতের এক সাংবাদিক। তবে ৮ বলে ৭ রানে অপরাজিত থাকা কনস্টাসকে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি চোখে চোখে রাখবে ভারতের ক্রিকেট দল। পান থেকে একটু চুন খসলেই হলো...ব্যস, আগুন লেগে যেতে পারে!
কেন? সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে জেনে নিন ক্রিকেট খেলাটা কত নির্মম। গত পরশুই অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজের উপস্থিতিতে কনস্টাসের মা–বাবার সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন বুমরা। আর আজ কিনা তেড়েফুঁড়ে গেলেন বয়সে এক যুগের ছোট ছেলেটির প্রতি?
অবশ্য ১৯ বছর বয়সী কোনো ছেলে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে নেমে প্রতিপক্ষের প্রতি ব্যাটে–মুখে (মেলবোর্নে প্রথম টেস্ট থেকেই) অমন মারমুখো ভঙ্গিতে থাকলে কেউ–ই আসলে বিশ্বাস করবে না, টেস্ট ক্রিকেটে এটা তাঁর মাত্র ষষ্ঠ দিন!
সম্ভবত বুমরারও বিশ্বাস হয়নি। অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসে ২.৫ ওভারে মেজাজটা তাঁর খারাপ হয়েছিল স্ট্রাইকে থাকা উসমান খাজার ওপর। বোলিং মার্ক থেকে দৌড় শুরু করেছিলেন। তাকিয়ে দেখেন খাজা প্রস্তুতই হননি। ওদিকে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। শেষ বিকেলে একটা উইকেট নিয়ে নিতে পারলে মন্দ হয় না! বুমরার মনে হয়েছে, অস্ট্রেলিয়া ইচ্ছা করেই সময় নষ্ট করছে।
দুই হাত উঁচিয়ে বিরক্তি প্রকাশের ভঙ্গি করেন খাজার প্রতি। কিন্তু নন স্ট্রাইকে থাকা কনস্টাস কিনা ঘাড় ঘুরিয়ে তাঁকে কিছু একটা বলে বসলেন! যেটাকে ভারতের সমর্থকেরা বলতে পারেন, একদম পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়ার চেষ্টা। যদিও অস্ট্রেলিয়ান সমর্থকদের অন্য কিছু ভাবার সুযোগ আছে—ঝগড়া–বিবাদে সময় নষ্ট করে দিনের শেষ ভাগের কম আলোয় বেশি বল না খেলার শিল্প!
সে যাহোক, কনস্টাস ঘাড় ঘুরিয়ে মুখ খুলতেই বুমরা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। দুই হাত উঁচিয়েই এগিয়ে কিছু একটা বলতে বলতে এগিয়ে যান কনস্টাসের প্রতি। কী বলেছেন, তা জানা না গেলেও কল্পনায় সুরটা ধরা যায়, তুমি বাপু এখানে নাক গলানোর কে? কনস্টাসও এগিয়ে গিয়েছিলেন দুই পা। ঠিক তখনই শান্তির বার্তা নিয়ে দুজনের মাঝে এক বাংলাদেশির আবির্ভাব। মাঠের আম্পায়ার শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে দুজনকে ঠান্ডা করে তাঁদের নিজ নিজ জায়গায় পাঠিয়ে দেন।
কিন্তু তৃতীয় ওভারের শেষ বলের পর পরিস্থিতি আর নিয়ন্ত্রণে ছিল না। খাজাকে স্লিপে ক্যাচ বানিয়েই বুমরা তেড়ে গিয়েছিলেন কনস্টাসের প্রতি, কয়েক পা এগিয়েই সম্ভবত তাঁর মনে পড়েছে আম্পায়ার এখনো মাঠে, তাই অগ্নিমূর্তি মিইয়ে আসে। ভারতের নীতীশ কুমার থেকে বাকিরাও কনস্টাসকে তাক করে উদ্যাপন শুরু করেন। স্লিপ থেকে বুনো উল্লাস করতে করতে দৌড়ে আসেন কোহলি, উদ্যাপনে যোগ দেওয়ার আগে একবার অগ্নিদৃষ্টি হেনেছেন কনস্টাসের প্রতি। চালাক ছেলে কনস্টাস স্রেফ আর কথা না বাড়িয়ে ড্রেসিংরুমের পথে হাঁটা ধরেন। অথচ ঝামেলার শুরুটা ছিল খাজার সঙ্গে। কনস্টাসের সেখানে আসারই কথা নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খাজার উইকেট উদ্যাপনের কেন্দ্রবিন্দু সেই কনস্টাসই!
দিনের খেলা শেষে সাংবাদিকদের কাছে সময় নষ্টের অভিযোগটি তুলেছেন ভারতের উইকেটকিপার–ব্যাটসম্যান ঋষভ পন্ত। কনস্টাস ও খাজাকে নিয়ে তাঁর দাবি, ‘তারা সময় নষ্ট করতে চেয়েছে। যশপ্রীতের সঙ্গে তার (কনস্টাস) কথা বলা দেখে আমার এটাই মনে হয়েছে। সে কিছু একটা বলেছে। আমি শুনিনি। কিন্তু আমার মনে হয় সে এটাই করতে চেয়েছে। সময় নষ্ট করা, যেন আমরা আরও একটি ওভার বোলিং করতে না পারি।’
সিডনিতে অভিষিক্ত বো ওয়েবস্টারের অবশ্য কনস্টাসকে নিয়ে ভাবনাটা অন্য রকম, ‘সে খুব আত্মবিশ্বাসী তরুণ। এই বয়সী তরুণেরা এমনই করে, মুখের ওপর কিছু বলে দেওয়া কিংবা কোনো কিছুতে জড়াতে তারা দ্বিধা করে না। আশা করি, আগামীকাল তার দিনটা ভালো যাবে।’
গোটা ভারত অন্তত তা চায় না। ভারতের খেলোয়াড়েরা অন্তত তা হতে না দেওয়ার সব রকম চেষ্টাই করবেন। বাজি ধরতে পারেন।