শচীনের শততম সেঞ্চুরির মতো এটাও কি একটা রেকর্ড নয়!

শচীন টেন্ডুলকারএএফপি
সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি! আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত একজনই তা করতে পেরেছেন—শচীন টেন্ডুলকার। ভারতীয় কিংবদন্তি তাঁর শততম সেঞ্চুরির মাইলফলক স্পর্শ করেছিলেন ১৩ বছর আগের এই দিনে, ২০১২ সালের ১৬ মার্চে। মিরপুরে সেই ম্যাচে ভারতের প্রতিপক্ষ ছিল বাংলাদেশ। এশিয়া কাপের গ্রুপ পর্বের ম্যাচটিতে শেষ পর্যন্ত ৫ উইকেটে জিতেছিল বাংলাদেশ। তবে ম্যাচটা বছর ঘুরে আসতেই আলোচনায় আসে টেন্ডুলকারের ১০০তম সেঞ্চুরির কারণে। পরদিনের প্রথম আলোয় প্রকাশিত উৎপল শুভ্রর লেখাটি শচীন টেন্ডুলকারের অর্জনের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত একটা তৃপ্তির কথাও বলেছিল...

এক শ সেঞ্চুরি কি নতুন রেকর্ড? রেকর্ড তো অবশ্যই। আবার রেকর্ডও নয়।

রেকর্ড হয় রেকর্ড ভাঙলে। শচীন টেন্ডুলকার তো কারও রেকর্ড ভাঙেননি। সবার ওপরেই ছিলেন। নিজেকে আরেকটু ওপরে তুলে নিলেন, এই যা!

অনেক দিনই শচীন টেন্ডুলকারের অন্য নাম, নিজেকে নিরন্তর ছাড়িয়ে যাওয়ার লড়াই। সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি সেই লড়াইয়ে স্মরণীয়তম জয়। ব্যাটিং রেকর্ডের এভারেস্টে আরোহণ। এখানেও পাল্টা প্রশ্ন, এভারেস্ট? এভারেস্টে তো বসে আছেন সেই কবে থেকেই।

স্মরণীয়তম সেঞ্চুরি হতে পারে, তবে টেন্ডুলকারের সেরা সেঞ্চুরির তালিকায় এটি থাকবে না। তাঁর ৪৯টি ওয়ানডে সেঞ্চুরির মধ্যে এটি ধীরতম, এটাই অনেক কিছু বলে। তার পরও কারণ শুধু এটিই নয়। স্ট্রোক প্লের ছটায় বর্ণিল কোনো শিল্পীকে নয়, মিরপুর এদিন দেখল পরিশ্রমী এক শ্রমিককে। যার কাছে কাজটা শেষ করাই বড় কথা। কীভাবে তা শেষ হলো, তাতে কিছু যায়-আসে না।

সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি অবিশ্বাস্য এক অর্জন। টেন্ডুলকারের নিজেরও হয়তো এমনই মনে হতে শুরু করেছিল। এ কারণেই ৯৯ থেকে ১০০ ছুঁতে এত দিন লেগে গেল। এ কারণেই কালও আশির ঘরে গিয়ে এমন কম্পমান। ভারত হেরে যাওয়ায় টেন্ডুলকারের এই সেঞ্চুরি নিয়ে নিশ্চিত অনেক প্রশ্ন উঠবে। নিজের ‘জয়’ নিশ্চিত করতে গিয়ে দলকে পরাজয় উপহার দিলেন কি না, এমন চরম অপ্রীতিকর প্রশ্নও।

গত এক বছরের টেন্ডুলকারকে দেখে থাকলে সেঞ্চুরি পাওয়ার জন্য এই ব্যাকুলতা কোনো বিস্ময় নয়। বিস্ময় ‘সিন্দাবাদের ভূত’টা ঘাড় থেকে নামানোর পর অমন উদযাপন।

শততম সেঞ্চুরির মাইলফলক স্পর্শ করার পর শচীন টেন্ডুলকার
এএফপি

উদযাপন? উদযাপনটা করলেন কোথায়? শততম সেঞ্চুরি পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে এত কথা, ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো শুধুই রেকর্ডের জন্য খেলে যাওয়ার অপবাদ—সেঞ্চুরির পর একটুও উচ্ছ্বাস না দেখানো কি সবকিছুর নীরব প্রতিবাদ? এক হাতে হেলমেট আর আরেক হাতে ব্যাট নিয়ে আকাশে বাবাকে খোঁজার সেই চেনা দৃশ্যটা বাদ দিলে কারও মনে সংশয় জাগতেই পারত, সত্যিই সেঞ্চুরি করেছেন তো টেন্ডুলকার! সেটিও আবার এমন ইতিহাস গড়া সেঞ্চুরি!

গত এক বছর কত হাজার লেখাই না হয়েছে এ নিয়ে। কোনো সেঞ্চুরি না-হওয়া নিয়ে কি এত লেখা-এত কথা হয়েছে কোনো দিন! হ্যাঁ, হয়েছে। এখানেও সেই নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই। শততম সেঞ্চুরি না-পাওয়া নিয়ে যত লেখা হয়েছে, টেন্ডুলকারের ওয়ানডে সেঞ্চুরি না-পাওয়া নিয়ে সম্ভবত তার চেয়ে বেশিই হয়েছে। ৯৯তম ও শততম সেঞ্চুরির মাঝে টেস্ট ও ওয়ানডে মিলিয়ে ‘মাত্র’ ৩৩টি ইনিংস।

ওয়ানডেতে প্রথম সেঞ্চুরির জন্য টেন্ডুলকারের অপেক্ষা ৭৯তম ম্যাচ পর্যন্ত
এএফপি

আর ওয়ানডেতে প্রথম সেঞ্চুরির জন্য টেন্ডুলকারের অপেক্ষা ৭৯তম ম্যাচ পর্যন্ত। তত দিনে টেস্টে ৭টি সেঞ্চুরি হয়ে গেছে। কালজয়ী এক প্রতিভার আবির্ভাব ঘটেছে, এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ সবাই। টেন্ডুলকারের ওয়ানডে-সেঞ্চুরি না পাওয়া তাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল রীতিমতো এক রহস্য। কত হাজার হাজার শব্দই না লেখা হয়েছে সেই রহস্য নিয়ে!

টেন্ডুলকার যখন আশির ঘরে, প্রেসবক্সে দাঁড়িয়ে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের মুখগুলো দেখছিলাম। না, এঁরা কেউ ১৯৯৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবের প্রেসবক্সে ছিলেন না। তা হলে কি আমিও একটা ‘রেকর্ড’ করে ফেললাম! আমার আবার কী রেকর্ড? কেন, টেন্ডুলকারের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি ও শততম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি দুটিই প্রেসবক্সে বসে দেখা একমাত্র সাংবাদিক আমি—এটিকে কি রেকর্ড বলে দাবি করা যায় না?

আরও পড়ুন

রেকর্ড হরেক রকম হয়। আমার ‘রেকর্ড’টাই যেমন কোনো রেকর্ড বইয়ে থাকবে না। এই লেখার পাঠকদের বাইরে কেউ তা জানবেও না কোনো দিন। কী আফসোস! কী আফসোস!

আসলে রসিকতা। নিছকই পাকেচক্রে ঘটে যাওয়া এই ‘কীর্তি’ নিয়ে বড়াই করার কী আছে! প্রসঙ্গটা এল টেন্ডুলকারের শততম সেঞ্চুরি দেখতে দেখতে মনটা বারবার সাড়ে সতেরো বছর আগের কলম্বোতে ফিরে যাচ্ছিল বলে। সেটিও এমন দিবা-রাত্রির ম্যাচ। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সে দিনও প্রথমে ব্যাটিং করেছিল ভারত। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বদলে যাওয়া রূপটাও মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই দিনটি।

শচীনকে শততম সেঞ্চুরির জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছেন মাশরাফি
এএফপি

শ্রীলঙ্কায় ওই সিঙ্গার ওয়ার্ল্ড সিরিজে ম্যাচের আগে-পরে কোনো আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের বালাই ছিল না। টেন্ডুলকারের পরম আরাধ্য প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি পাওয়ার পরও সংবাদ সম্মেলন হয়নি। এখন তো ম্যাচের আগে-পরে সাংবাদিকদের ড্রেসিংরুমের আশপাশেও যাওয়ার সুযোগ নেই। আর টেন্ডুলকারের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি পাওয়ার প্রতিক্রিয়াটা নিতে আমরা চলে গিয়েছিলাম ড্রেসিংরুমের সিঁড়িতে।

আমরা মানে চার বঙ্গসন্তান—আমি আর কলকাতার তিন সাংবাদিক। টেন্ডুলকারের প্রতিক্রিয়াটা ছিল চমকে দেওয়ার মতো। এত সাধনায় পাওয়া সেঞ্চুরি—কোথায় বলবেন, ‘আমি খুব খুশি’, ‘মাথার ওপর থেকে একটা পাহাড় নেমে গেল’; উল্টো দাবি করলেন, ‘না, না, আমি এটা নিয়ে ভাবিইনি।’ ওয়ানডেতে প্রথম সেঞ্চুরি নিয়ে তাঁর চেয়ে সংবাদমাধ্যমই নাকি বেশি চিন্তিত ছিল, কথাবার্তায় এমন একটা সুর।

প্রেসবক্সে টিভির সাউন্ড অফ থাকে। কাল শততম সেঞ্চুরির পর তাৎক্ষণিক সাক্ষাৎকারে টেন্ডুলকার কী বললেন, সেটি তাই শোনা হয়নি। তবে কে যেন শুনে এসে বললেন, টেন্ডুলকার নাকি বলেছেন ‘মিডিয়াই এ নিয়ে বেশি চিন্তিত ছিল।’ টেন্ডুলকারের কথা টেন্ডুলকার বলেছেন। কেউ তা বিশ্বাস করে থাকলে হাত তুলুন প্লিজ!

আরও পড়ুন