তাঁকে ঘিরে এমন উন্মাদনার মধ্যেও কোহলি বড্ড একা!
১৫ মিনিট পার হয়ে গেছে। প্রশ্ন করতে চেয়ে তখনো হাত উঁচিয়ে আছেন অনেক সাংবাদিক। বিরাট কোহলির সংবাদ সম্মেলন বলে কথা। যেন ‘শেষ’ বলে কোনো শব্দ নেই। মিডিয়া ম্যানেজার আনন্দ সুব্রামানিয়াম অনুরোধ রাখতে রাখতে ক্লান্ত।
বহু কষ্টে যখন সংবাদ সম্মেলন শেষ হলো, তখন হুড়মুড় করে সাংবাদিকদের একটা দল এগিয়ে গেল কোহলির দিকে। কোহলির সঙ্গে সেলফি তুলতে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন প্রত্যেকে। কোহলিও প্রত্যেকের আবদার মেটালেন।
দৃশ্যটা দেখতে দেখতে ‘কোহলি-মহিমা’ যেন নতুন করে বুঝলাম। এই সেই কোহলি, যাঁর জন্য সাংবাদিকেরাও পেশাদারত্ব ভুলে হয়ে যান ভক্ত। যাঁর সঙ্গে একটি মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দী করে নিতেই এত আগ্রহ সবার! অথচ এই কোহলিই একটু আগে সংবাদ সম্মেলনে বলছিলেন তাঁর দুঃসময়ের একাকিত্বের কথা।
কোহলির মুখেই শুনুন সে কথা, ‘টেস্টের নেতৃত্ব ছাড়ার পর কেবল একজন মানুষের কাছ থেকেই মেসেজ পেয়েছি, যার সঙ্গে আগে খেলেছি...তিনি হলেন এম এস ধোনি। অনেকের কাছেই আমার ফোন নম্বর আছে। টিভিতে কত লোকে পরামর্শ দেন আমাকে, কত কথা বলেন! কিন্তু যতজনের কাছে আমার নম্বর আছে, আর কেউ একটা মেসেজ দেননি।’
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে পিনপতন নীরবতা। একঝাঁক সাংবাদিকের চোখ তাকিয়ে কোহলির চোখ বরাবর। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে কোহলি আরও যোগ করেন, ‘এই যে শ্রদ্ধাবোধ, এ রকম যোগাযোগ, এটা যখন খাঁটি হয়, তখন এভাবেই ফুটে ওঠে। কারণ, দুই দিকেই একটা নির্ভরতা থাকে। তার আমার কাছে কিছু চাওয়া-পাওয়া নেই, আমারও নেই তার কাছে। আমার কেউ পরস্পরকে নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি না। আমি স্রেফ এটাই বলতে পারি, যখন কাউকে কিছু বলতে চাই, আমি ব্যক্তিগতভাবেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করি, এমনকি সেটা যদি তাকে সহায়তা করার ব্যাপারও হয়।’
কোহলি পাঞ্জাবি মিউজিক পছন্দ করেন। তাঁকে অনেক সাক্ষাৎকারে পাঞ্জাবি মিউজিকের কথা বলতে শুনেছি। কিন্তু কাল ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের পর দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের সংবাদ সম্মেলনকক্ষে তাঁকে দেখার পর মনে হলো, কোহলি হয়তো রবীন্দ্রনাথের ‘একলা চলো রে’ও শুনেছেন।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আলোকবর্তিকায় প্রতিনিয়ত জীবনযাপন করে অভ্যস্ত কোহলিকে দেখে মনে হবে না, তাঁর নিজের কোনো জীবন আছে। ক্রিকেট মাঠে হাজার হাজার দর্শকের মুখে নিজের নাম শুনে অভ্যস্ত তিনি। তাঁর প্রতিটি কথা জায়গা করে নেয় খবরের শিরোনামে। ভারতীয় ক্রিকেটের পোস্টারবয়ের যে আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা, সেটির ধারেকাছে বিশ্ব ক্রিকেটের অন্য কেউই নেই। নিজের নামটা এত মানুষের মুখে শুনতে শুনতে হয়তো নিজের মনের কথাটাই শোনা বন্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি।
কাল কোহলি নিজেই তা বলছিলেন, ‘খেলা চালিয়ে যাওয়ার সময় অনেক সময় এটা মনে থাকে না। লোকে আপনার জন্য গর্জন করছে, এত খ্যাতি, মূল উপলব্ধিটা অনেক সময় হারিয়ে যায়। খেলার জন্য সেই তাড়না, সেই শুদ্ধতা, খেলার নিখাদ আনন্দটুকু হারিয়ে যায়। আমার জন্য তা পুনরায় খুঁজে পাওয়া জরুরি ছিল।’
খেলার আনন্দ হারিয়ে ফেললে প্রিয় খেলাটাকেও বিস্বাদ লাগে। যার প্রভাব পড়ে পারফরম্যান্সেও। কোহলির মতো বড় ক্রিকেটারের ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছে। সে জন্য এশিয়া কাপের আগে এক মাস সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিয়েছেন। ‘সম্পূর্ণ’ দিয়ে কোহলি বোঝাচ্ছেন ক্রিকেট ব্যাটটা পর্যন্ত এক মাস না ধরার কথা, ‘এক মাস ব্যাট ধরব না, আগে এটা আমি ভাবতেও পারতাম না। কিন্তু পরিস্থিতিই এমন হয়ে গিয়েছিল যে বিরতি নিতেই হতো। শারীরিক ব্যাপারের চেয়েও এটা জরুরি ছিল মানসিক কারণে। এক মাস বিরতির পর ব্যাট হাতে নেওয়ার সময় পুরোনো সেই অনুভূতি ফিরে আসে, যে ভালোবাসা থেকে খেলাটা শুরু করেছিলাম।’
এবারের এশিয়া কাপে সেই পুরোনো কোহলির প্রত্যাবর্তনে হয়তো এটাই বড় ভূমিকা পালন করেছে। এশিয়া কাপে এখন পর্যন্ত তিন ইনিংস খেলেছেন। তিনটিতেই পুরোনো সেই কোহলি ফিরে আসার ইঙ্গিত, ‘আমি জানি, ভালো অবস্থায় থাকলে দলের জন্য কতটা কী করতে পারি। খারাপ অবস্থায় থেকে খেলা আমার বা দলের কারও জন্যই ভালো নয়। আমার মনে হয়, কেউ যদি নেতিবাচক অবস্থায় থাকে বা মানসিকভাবে বাজে অবস্থায় থাকে, এটা থেকে পালিয়ে বেড়ানো উচিত নয়। বরং বিরতি নেওয়া খারাপ কিছু নয়। এড়িয়ে যেতে চাইলেই হতাশা বাড়বে। আমি এটা উপলব্ধি করেছি ও উপকৃত হয়েছি। এখন আমি খুশি, রোমাঞ্চিত, ক্রিকেট খেলতে আবার মজা পাচ্ছি। আমার জন্য এটাই ছিল জরুরি।’
কোহলির ফর্মে ফেরা বিশ্ব ক্রিকেটের জন্যও জরুরি ছিল। কাল পাকিস্তান-ভারত ম্যাচের কথাই ধরুন। কোহলিকে চার-ছক্কা মারতে দেখে দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম উপচে পড়া দর্শকেরা যেন লাফিয়ে ২২ গজে নামা বাকি রাখছিলেন। এই মুহূর্তে ক্রিকেট মাঠে এমন উন্মাদনার জন্ম একমাত্র কোহলিই দিতে পারেন।
কিন্তু ফর্ম থাকুক আর না থাকুক, কোহলির মতো তারকাদের জীবনটাই একাকিত্বে ঠাসা। তারকাখ্যাতির যে উচ্চতায় তাঁর অবস্থান, খুব কম ক্রিকেটারই যে সে জায়গায় গিয়েছেন! কাল রাতে সাংবাদিকদের সঙ্গে সেলফি-পর্ব শেষে কোহলি যখন ড্রেসিংরুমে ফিরে যাচ্ছেন, তখনো তাঁকে দেখে যেমন মনে হলো: লোকটি বড্ড একা!