বছর চারেক আগের কথা। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ জিতে এসেছে। বিরাট এই অর্জন উপলক্ষে বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্ট বিভাগে মিষ্টি বিতরণ চলছিল। সেখানে ছিলেন গেম ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান খালেদ মাহমুদ ও অনূর্ধ্ব-১৯ দলের প্রধান কোচ নাভিদ নেওয়াজ। দুজন মিলে আকবর আলীর দলের সাফল্যের গল্প শোনাচ্ছিলেন। কথায় কথায় এল সে দলের সদস্য তাওহিদ হৃদয়ের প্রসঙ্গ। তরুণ এই ব্যাটসম্যানকে নিয়ে মাহমুদ প্রথম যে কথাটা বললেন, তা মাথায় গেঁথে যাওয়ার মতো। একগাল হেসে হাত বুকে রেখে বাংলাদেশ দলের সাবেক এই অধিনায়ক বললেন, ‘হৃদয় আমার দলের “হৃদয়”।’ বাংলায় বলা কথাটা পাশে বসা শ্রীলঙ্কান কোচ নেওয়াজকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেও শোনালেন মাহমুদ। নেওয়াজও মাথা নেড়ে সায় দিলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই।’
২০২০ সালের সেই হৃদয় এখন বাংলাদেশ দলেরও হৃদয়। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি দলে তো অবশ্যই। রান–খরায় ভুগতে থাকা ব্যাটিং অর্ডারে রানে আছেন শুধু হৃদয়ই। নিজের প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই সে ছাপ রেখেছেন এই ডানহাতি। ২০ বলে ১টি চার ও ৪টি ছক্কায় ২০০ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ৪০ রান। ডালাসে শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশের সে ম্যাচে ২০০ স্ট্রাইক রেটে খেলা একমাত্র ব্যাটসম্যান হৃদয়ই। শ্রীলঙ্কার চেয়ে বেশি ছক্কা সেদিন হৃদয় মেরেছেন। এ বছরের শুরু থেকেই তিনি দারুণ ফর্মে। ১২ ম্যাচ খেলা হৃদয় ১১ ইনিংসে ব্যাট করে ৩৭ গড়ে রান করেছেন ৩০৩, যা বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ। তাঁর ১৪১ স্ট্রাইক রেটের ধারেকাছে নেই কোনো বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান। হৃদয়কে টি-টোয়েন্টি দলের ‘হৃদয়’ না বলে কি উপায় আছে!
বাংলাদেশ দলের ব্যাটিংয়ে তাঁর হৃদয়ের গুরুত্ব শুধু রান কিংবা স্ট্রাইক রেটে বোঝানো যাবে না। ব্যাটিং অর্ডারে তাঁর জায়গা ৪ কিংবা ৫ নম্বরে, বাঁহাতি ব্যাটসম্যানে ঠাসা টপ অর্ডারে ডানহাতি ব্যাটসম্যান হওয়ায় হৃদয়ের গুরুত্ব এমনিতেই বেড়ে যায়। মাঝের ওভারের স্পিন বোলিংয়ের বিপক্ষে সাধারণত রানের গতি কমে আছে। টি-টোয়েন্টি ম্যাচের জেতা-হারাও নির্ভর করে দলগুলো মাঝের ওভারে কেমন করে। হৃদয় এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে বড় আস্থার জায়গা।
দলের বিপদে তিনি ধরে খেলেন, দরকার হলে মেরেও খেলেন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচেই হৃদয়ের এই দুই রূপ দেখা গেছে। সেদিন প্রথম বাউন্ডারি মারার আগে ৮ বল খেলে ৮ রান করেছেন হৃদয়, পরের ১২ বলে করেছেন ৩২ রান। হৃদয়ের মুখেই শুনুন তাঁর পরিস্থিতি বুঝে খেলার কৌশলের কথা, ‘ম্যাচে ওই মুহূর্তে ম্যাচের কী চাহিদা থাকে, সে অনুযায়ী খেলার চেষ্টা করি। যদি অবস্থা এমন থাকে যে এক ওভারে দুই-তিনটা ছক্কা দরকার, তাহলে ছয় মারব। যদি দলের চাহিদা থাকে এক ওভারে ছয়টা বল ডট দিতে হবে, তাহলে ছয়টা বলই ডট দেব।’
অথচ বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের সেই সুসময়ের পর এই হৃদয়কেই কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ঘরোয়া প্রতিযোগিতাগুলোর সেরা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় হৃদয়ের নাম থাকত তলানিতে। টি-টোয়েন্টির একমাত্র ঘরোয়া টুর্নামেন্ট বিপিএলের ২০২২ সালের আসরে ১০ ইনিংস খেলে ১৭ গড় ও ৯৭.৮৪ স্ট্রাইক রেটে মাত্র ১৩৬ রান করেছিলেন। সেই মৌসুমের ফাইনাল ম্যাচে ফরচুন বরিশালের হয়ে খেলা হৃদয় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের শহীদুল ইসলামের করা শেষ বলে ৩ রান নিতে পারেননি। কুমিল্লা সে ম্যাচ জিতে নেয় ১ রানে। হৃদয় হতাশায় মুষড়ে পড়েন মিরপুরের সবুজ ঘাসে।
সেই হতাশা থেকেই নিজেকে বদলে ফেলার প্রতিজ্ঞা করেন হৃদয়। সে সময়টার কথাই মনে করে হৃদয় বলছিলেন, ‘একটা সময় তো ছয় মারতে পারতাম না। যখন ছয় মারতে পারিনি, তখন অনেক কথা হয়েছে। এটাই বাস্তবতা। মানুষ চাইলে অনেক কিছুই সম্ভব। মন থেকে চাইলে, কঠোর পরিশ্রম করলে আমি বিশ্বাস করি সবকিছুই সম্ভব।’ সেই হৃদয়ই ব্যাটিং কৌশল পাল্টে ফিরে গেছেন বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের শুরুর দিকে স্টান্স ও ব্যাক লেফটে, বাড়িয়েছেন শট খেলার সামর্থ্য। লিকলিকে শরীর নিয়েও এত বড় বড় ছক্কা মারার রহস্য ওই কৌশলই, ‘আমাকে সবাই বলে, তোমার গায়ে কিছু নেই, কীভাবে এত বড় বড় ছয় মারো। এই প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচেও এই কথা শুনেছি। আমি বলেছি, আসলে ছয় মারতে তো খুব শরীরের জোর লাগে, তা নয়। টেকনিকটা আসল।’
টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে মেরে খেলার স্বাধীনতা পেয়েছেন হৃদয়। ‘লাইসেন্স টু কিল’ বলতে যা বোঝায়, হৃদয়কে সেটাই দেওয়া হয়েছে। সব গুলি লক্ষ্য ভেদ করবে না, কিন্তু গুলি চালিয়ে যেতে হবে। হৃদয় তা-ই করছেন!