এই জয়ে তাঁদের অবদানও ভুলে যাবেন না
টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে কিছু ‘কমন’ কথা আছে। এর মধ্যে খুবই পরিচিত কথাটা সুনীল গাভাস্কারের। এখনো টেস্ট ম্যাচে ধারাভাষ্যে এলে ভারী গলায় তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘দিনের প্রথম ঘণ্টা বোলারকে দাও। বাকি দিনটা নিজের করে নাও।’
গাভাস্কার টেস্ট ক্রিকেটে ওপেন করেছেন সত্তর ও আশির দশকে। এরপর টেস্ট ক্রিকেট অনেক রং বদলেছে। সময় যত গড়িয়েছে, টেস্ট ক্রিকেটে রানরেটও বেড়েছে। কিন্তু টিকে থেকে নতুন বলটা কিছুটা পুরোনো করার চেষ্টা করা, প্রতিপক্ষ দলের সেরা বোলারদের প্রথম স্পেলটা নিরাপদে কাটিয়ে দেওয়ার মতো সেই পুরোনো কৌশল এখনো কার্যকর।
বাংলাদেশ দলের জন্য এই শিক্ষাটা নতুনই। টেস্ট দলটাও যে নতুন। এই দলের ওপেনারদের টেস্ট ক্রিকেটের জগতে পদচারণ বেশি দিনের নয়। রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে দলের দুই ওপেনার সাদমান ইসলাম (১৪) ও জাকির হাসান (৮) মিলে টেস্ট খেলেছেন ২২টি। চোটের কারণে ছিটকে যাওয়া মাহমুদুল হাসান ১৩টি।
তাঁরা কেউই তামিম ইকবাল নন। বাংলাদেশ ক্রিকেটে ওপেনিং মানেই তামিম। টেস্ট ক্রিকেটে পাঁচ হাজারের বেশি রান করা তামিমের ব্যাটিং দর্শনটা ছিল পরিষ্কার—নতুন বলে প্রতি-আক্রমণ।
জাকিররা সে তুলনায় ভিন্ন। টেস্ট দলের তিন ওপেনারের মধ্যে কেউই তামিমের মতো বাউন্ডারি মারার দক্ষতা নিয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আসেননি। জাকির-সাদমানরা ব্যাটিং করেন টেস্ট ক্রিকেটের প্রথাগত মেজাজে। ইনিংসের শুরুতে সময় নেবেন, বল পুরোনো হওয়ার অপেক্ষা করবেন। বাজে বলের ফায়দা নিয়ে খুঁজে নেবেন বাউন্ডারি। তিন ওপেনারই তাঁদের ছোট্ট টেস্ট ক্যারিয়ারে যা সাফল্য পেয়েছেন, তা সেই ‘পুরোনো’ ক্রিকেট খেলেই।
রাওয়ালপিন্ডি টেস্টেও তা-ই হলো। রোমাঞ্চকর এ ম্যাচের স্কোরকার্ডে তাকালে তারকা পারফরমারদের ছড়াছড়ি দেখতে পাবেন। মুশফিকুর রহিমের ১৯১, সাদমানের ৯৩, মুমিনুল হক ও লিটনের ফিফটির সঙ্গে সঙ্গে মিরাজ-সাকিবের অলরাউন্ড পারফরম্যান্স—কী ছিল না এই টেস্টে!
কিন্তু ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের ঝলকানির পরও জাকির-সাদমানের ৩১ রানের ছোট্ট উদ্বোধনী জুটির কথাটা দলের মধ্যে বারবার আলোচিত হচ্ছে। মুমিনুল, মুশফিক ও নাজমুল প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের ৫৬৫ রানের পাহাড় গড়ার কৃতিত্বটা এই দুজনকেও দিচ্ছেন।
পাকিস্তানের ৬ উইকেটে ৪৪৮ রানের ইনিংস ঘোষণার পর তৃতীয় দিন শেষ বিকেলে ১২ ওভারের জন্য ব্যাটিং করতে হয়েছিল জাকির-সাদমানদের, সব মিলিয়ে দুজন ক্রিজে ছিলেন ১৬.৫ ওভার। যা নতুন বলটা কিছুটা নরম করতে সাহায্য করেছে। দুজনের মধ্যে সাদমানের ব্যাট থেকে এসেছে ৯৩ রানের ইনিংস। রাওয়ালপিন্ডির উইকেটে পাকিস্তানের চার পেসারকে সামলানো সম্ভব, এ বার্তাও দিয়েছে ওপেনিং জুটি।
শুধু রাওয়ালপিন্ডি নয়, গত বছরের ডিসেম্বরে সিলেটে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট জয়েও খুঁজে পাবেন ওপেনারদের অবদান। টিম সাউদির দলের বিপক্ষে উদ্বোধনী জুটি থেকে এসেছে ৩৯ রান, মাহমুদুল ও জাকির সে টেস্টের প্রথম ইনিংসে খেলেছেন ১২.৩ ওভার। মাহমুদুলের ব্যাট থেকে এসেছে ৮৬ রান। বাংলাদেশের চেয়ে র্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা দলের বিপক্ষে আরেকটি জয় খুঁজতে গেলে যেতে হবে ২০২২ সালের মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টে। সে টেস্টে মাহমুদুল ও সাদমানের উদ্বোধনী জুটি বাংলাদেশ দলকে ৪৩ রান এনে দিয়েছিল। দুজন মিলে ব্যাটিং করেছিলেন ১৮.১ ওভার। মাহমুদুল সেই টেস্টে খেলেছেন ৭৮ রানের ইনিংস।
টেস্টের হাইলাইটস প্যাকেজে ওপেনারদের এই মন্থরগতির ইনিংসগুলো জায়গা করে নেবে না। কিন্তু টেস্ট ম্যাচ জেতা-হারা নির্ভর করে, যা হাইলাইটস প্যাকেজে নেই তার ওপর। সাদমানদের উইকেট না দেওয়ার দৃঢ়চেতা মনোভাব, ফরোয়ার্ড ডিফেন্স, বল ছাড়ার মতো একঘেয়ে ব্যাটিং-দক্ষতা মুশফিক-লিটনদের বড় রানের মঞ্চ গড়ে দেয়। মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানরা যখন ক্রিজে আসেন, তখন বল অনেকটাই পুরোনো, প্রতিপক্ষের বোলাররাও একটু ক্লান্ত। ব্যাটিংয়ের জন্য এর চেয়ে আদর্শ অবস্থা আর কী হতে পারে!