কোহলির ‘নিষিদ্ধ প্রেম’ ইমরান হাশমির যে দৃশ্যকে মনে করিয়ে দেয়

বল ব্যাট ছুঁয়ে চলে গেছে স্লিপ ফিল্ডারের কাছে কিংবা উইকেটকিপারের গ্লাভসে। পেছন ফিরে তা দেখছেন কোহলি। বোর্ডার–গাভাস্কার সিরিজে এ যেন চিরায়ত দৃশ্যএএফপি

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক নেটিজেনের দাবি খুব পরিষ্কার। রোহিত শর্মা যদি ভারতের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে টেস্ট সিরিজের মাঝে বাদ পড়তে পারেন, তাহলে বিরাট কোহলির প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট ম্যাচের মাঝে বাদ পড়া উচিত।

কেন এমন দাবি, সেটা হয়তো আপনি এতক্ষণে জানেন বা বুঝতে পেরেছেন। সিডনি টেস্টে আজ প্রথম দিনে ৬৯ বলে ১৭ রানে আউট হয়েছেন কোহলি। হ্যাঁ, রান পাচ্ছেন না—সেই সমস্যা তো আছেই। তবে এর চেয়েও সম্ভবত বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে যেভাবে আউট হচ্ছেন। বোর্ডার–গাভাস্কার সিরিজে এ পর্যন্ত ৯ বার ব্যাটিংয়ে নেমেছে ভারত। কোহলি এর মধ্যে ৮ ইনিংসে ব্যাট করার সুযোগ পেয়েছেন। পার্থে ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসে অপরাজিত সেঞ্চুরিটি বাদ দিলে ৭ বার আউট হয়েছেন কোহলি। প্রতিবার একইভাবে। রসিকতা করে কেউ কেউ বলতে পারেন, রানখরায় থাকা রোহিত তবু বিভিন্ন শট খেলতে গিয়ে বিভিন্নভাবে আউট হচ্ছেন, কিন্তু কোহলি? একটা সিরিজের মাঝে বছর বদলে যেতে পারে, কিন্তু কোহলির ‘নিষিদ্ধ প্রেম’–এর টানে ‘ঘর’ ভাঙার অভ্যাসটা আর গেলই না!

আরও পড়ুন

নিষিদ্ধ প্রেম এবং ঘর ভাঙার ব্যাখ্যা দেওয়ার আগে একটি পরিসংখ্যান দেওয়া যাক। এই সিরিজে কোহলি যে সাতবার আউট হয়েছেন, তার প্রতিটি আউটই অফ স্টাম্পের বাইরে হয় উইকেটকিপার, নয় স্লিপে ক্যাচ দিয়ে।

অফ স্টাম্পের বাইরের বলে কোহলির দুর্বলতা নতুন কিছু নয়। তবে ক্রিকেটে খুব প্রচলিত একটি কথাই হলো, ব্যাটসম্যানের যে জায়গাটা সবচেয়ে শক্তির, সেটাই তাঁর দুর্বলতা। কারণ, ওই জায়গায় বল করলে খেলবেনই—বড় মাপের ব্যাটসম্যানদের জন্য ব্যাপারটা সামর্থ্যের পাশাপাশি ‘ইগো’র সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত। কোহলিও তা–ই। তাঁর কাভার ড্রাইভ, ব্যাক ফুট ড্রাইভ কিংবা কাট—এসবই ছবির মতো সুন্দর। আবার এই অফ স্টাম্পের বাইরের বলই খেলতে গিয়ে তাঁর ক্যাচ দিয়ে আউট হওয়ার ছবিটাও সবচেয়ে পরিচিত। আর এটাই কোহলির নিষিদ্ধ প্রেম।

বোল্যান্ডের বলে আউট হওয়ার পর অসহায়ের মতো অস্ট্রেলিয়ানদের উদ্‌যাপন দেখছেন কোহলি
এএফপি

কোহলি স্লিপে কতবার ক্যাচ দিয়ে আউট হয়েছেন, সেই হিসাব বের করা মুশকিল। তবে শুধু উইকেটকিপারের কাছে তাঁর ক্যাচ দেওয়ার পরিসংখ্যান এমন—২০৯ ইনিংসের টেস্ট ক্যারিয়ারে এভাবে আউট হয়েছেন ৪৪ বার। পেসারদের বিপক্ষেই ৩৯ বার। আর পুরো ক্যারিয়ার ৬০৯ ইনিংসে উইকেটকিপারকে ক্যাচ দিয়ে আউট হয়েছেন ১০৯ বার। পেসারদের বিপক্ষেই ৯৬ বার।

কেন নিষিদ্ধ প্রেম বলা হচ্ছে, এবার সেই ব্যাখ্যায় আসা যাক। পার্থে ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসে অপরাজিত ১০০ ছাড়া বাকি ৭ ইনিংসের একটিতেও কোহলি বলার মতো রান পাননি—৫, ৭, ১১, ৩, ৩৬, ৫, ১৭। ওই সেঞ্চুরিটি ছাড়া বাকি ৭ ইনিংসে মাত্র ৮৪ রান।

আরও পড়ুন

প্রতিটি ইনিংসেই কোহলি আউট হয়েছেন অফ স্টাম্পের বাইরের বলে ড্রাইভ, ডিফেন্স, খোঁচা, ছাড়বেন না খেলবেন সেই দ্বিধায় ভুগে শেষ পর্যন্ত ছুঁয়ে দেওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে। তবে এটাও বলা উচিত, শটগুলো খেলতে গিয়ে কোহলি যদি আউট না হতেন, যদি রানও পেতেন, তাহলে কিন্তু ঘটতো উল্টোটা। বিশ্লেষক থেকে সাধারণ সমর্থকেরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠতেন।

যেহেতু তা হয়নি, আর বিশ্লেষকেরা বারবার বলছেন, ওখানে (অফ স্টাম্পের বাইরে) আপাতত ব্যাটে–বলে ঠিকঠাক হচ্ছে না; তা–ই ছেড়ে খেলাই ভালো। আর সেই প্রসঙ্গে ২০০৪ সালে এই সিডনিতেই শচীন টেন্ডুলকারের কাভার ড্রাইভবিহীন ২৪১ রানের ইনিংসটির উদাহরণও তাঁরা টেনেছেন। সে সিরিজেও টেন্ডুলকার অফ স্টাম্পের বাইরে বারবার আউট হওয়ার পর সিডনিতে এসে ওই লাইনের বল ছাড়ার ধ্যানে বসে (পড়ুন দাঁড়িয়ে) একটি কাভার ড্রাইভও খেলেননি। মানে সামর্থ্য ও ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও লোভটা সামলেছিলেন। অফ স্টাম্পের বাইরের বল খেলার প্রতি যতই ভালোবাসা থাকুক, টেন্ডুলকার জানতেন ‘ফাঁদ’টা ওখানেই পাতা হয়েছে, জায়গাটা তাই আপাতত নিষিদ্ধ। কোহলির ক্ষেত্রেও তা–ই নয় কি?

মাথা নিচু করে কোহলির ড্রেসিংরুমে ফেরার দৃশ্য ভারতের সমর্থকদের নিশ্চয়ই ভালো লাগেনি
এএফপি

গোটা দুনিয়া জানে, অফ স্টাম্পের বাইরের বলে কোহলি কত ভালো এবং চোখ জুড়িয়ে খেলেন। আবার গোটা দুনিয়া এটাও জানে, ওখানে যেহেতু সে এত ভালো, তাই ওখানকার বলগুলো ছাড়তে পারবে না বলেই দুর্বলতাটাও ঠিক ওখানেই! অস্ট্রেলিয়াও তাই সিরিজজুড়ে ফাঁদটা পেতে রেখেছে ওখানেই। কিন্তু কোহলি যেন সেই দুর্বিনীত প্রেমিক, যে মৃত্যুভীতি থাকায় ওই জায়গার প্রতি প্রেমটা আপাতত নিষিদ্ধ জেনেও তা জয় করতে বারবার ‘আত্মহত্যা’য়ও কুণ্ঠা করেন না! সেটাও এমন যে, আজ নিজের খেলা প্রথম বলটাই ছিল অফ স্টাম্পের বাইরে এবং যথারীতি তা খেলতে গিয়ে স্লিপে ক্যাচ দিয়েছিলেন।

ভাগ্যিস, ভিডিও রিপ্লেতে তৃতীয় আম্পায়ার দেখেছিলেন বল স্টিভেন স্মিথের হাতে থাকতেই মাটি ছুঁয়েছিল। নইলে স্কট বোল্যান্ডের বলে তখনই আউট, যেটা হয়েছেন পরে একই বোলারের বিপক্ষে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে (৩১.৩ ওভার)।

এমন সব আউট যদি হয় আত্মহত্যা, তাহলে ঘর ভাঙাটা হলো আউটের পর ক্রিজ ছেড়ে যাওয়া। ওই জায়গাটা তো ব্যাটসম্যানদের ঘরই, তাই না?

আরও পড়ুন

আসলে বড় মাপের ব্যাটসম্যানদের ভেতরে একরকম তাড়না থাকে—নিজের কোনো টেকনিক নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হলে সেটা সঠিক প্রমাণের চেষ্টা, কিংবা ‘আমি এটা পারি’—বোঝাতে সেটাই করে দেখিয়ে দেওয়ার ইচ্ছাও হতে পারে। কিন্তু সর্বকালের অন্যতম সেরাদের কাতারে ঢুকে পড়া কোহলির কি দেখানোর কিছু বাকি আছে?

গ্রেট ব্যাটসম্যান বলেই হয়তো সিডনিতে আরেকবার একই চেষ্টা করেছিলেন। সেটা একটু অন্যভাবে। সিরিজের আগের টেস্টগুলোয় বাঁ পা–টা একটু ভেতরে (লং অনের দিকে) ঢুকিয়ে স্ট্যান্স নিয়েছেন। ওভাবে অফ স্টাম্পের বাইরের বল খেলা কঠিন। কারণ, বলের কাছে যেতে ফুটওয়ার্কের দূরত্বটা বেশি হয়—সেটা বুঝেই হয়তো সিডনিতে বাঁ পা–টা একদম নন–স্ট্রাইকের স্টাম্প সোজা রেখে দাঁড়িয়েছিলেন। এই স্টান্সে অফ স্টাম্পের বাইরের বল খেলতে বাঁ পা–টা বলের কাছাকাছি নিতে আগের স্টান্সের চেয়ে কম সময় লাগে। সঙ্গে নিপাট ধৈর্যও ছিল। টেস্টে বাউন্ডারি ছাড়া তাঁর এই ৬৯ বলের ইনিংসটাই ছিল সবচেয়ে দীর্ঘ। তবু লোভটা সামলাতে পারলেন না। কিংবা জিদের বশে ফাঁদটাও জয় করা হলো না! টেন্ডুলকার জিতেছিলেন ত্যাগ করে, কোহলিও জিততে চাইছেন, তবে ঠিক উল্টোটা করে।

কোহলি কি শেষটা দেখে ফেলছেন
এএফপি

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাই নির্মম রসিকতা চলছে। কোহলিকে দেখে কারও কারও বলিউডের একসময়ের আলোচিত নায়ক ইমরান হাশমিকে মনে পড়ছে। ২০০৩ থেকে প্রায় এক দশক ভীষণ আলোচিত হয়ে ওঠা হাশমির সিনেমায় নায়িকাকে চুম্বনের দৃশ্য থাকতই। বোর্ডার–গাভাস্কার সিরিজে কোহলির বার বার স্লিপে ক্যাচ দেওয়া দেখে এক্সে এক নেটিজেন তাই লিখেছেন, ‘কোহলি লাভস স্লিপস লাইক হাশমি লাভস লিপস।’

এক সাক্ষাৎকারে হাশমি একবার বলেছিলেন, তাঁর স্ত্রী পারভিন সাহানি একসময় তাঁর চুম্বনের দৃশ্য পছন্দ করতেন না। সে জন্য স্ত্রীর কাছে মারও খেয়েছেন, ‘এখন চুম্বনের দৃশ্য দেখলে সে খুব একটা মারে না। আগে তো ব্যাগ দিয়ে পেটাত।’

নেটের এই জালের মতোই নিজের মনোজগতে অফ স্টাম্পের বাইরের বল খেলে আউট হওয়ার খাঁচায় বন্দী হয়েছেন কোহলি
এএফপি

কোহলির অফ স্টাম্পের বাইরের বলের প্রতি অতিশয় প্রেমে আনুশকা শর্মার প্রতিক্রিয়াটা জানা যায়নি। তবে বিশ্লেষক থেকে সমর্থকদের ব্যাপারটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে কোহলিকে নিয়ে। এই সিরিজেই মেলবোর্ন টেস্টে ধারাভাষ্যকারেরা বলেছেন, ৩৬ বছর বয়সী কোহলিকে কি মেলবোর্নে শেষবারের মতো দেখা গেল? ভারতের কেউ কেউ সাহস করে তাঁর অবসর নেওয়ার প্রসঙ্গও তুলেছেন। ঝামেলা হলো, চলচ্চিত্র ও ক্রিকেটের আলাদা দুই ভুবনে সফলতা বিচারে কোহলির সঙ্গে হাশমির তুলনাই চলে না। ভারতের ওই রুপালি জগৎ থেকে তাঁর সঙ্গে তুলনায় আসতে পারেন, অমিতাভ বচ্চন কিংবা শাহরুখ খানদের মতো কিংবদন্তি।

অমিতাভ–শাহরুখরা ব্যর্থতা থেকে বার বার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা ফিরে আসতে জানেন। কোহলিও জানেন ও পারেন। বাকিটা সময়ের হাতে। সময়ই বলে দেবে, কোহলি নিষিদ্ধ প্রেমে ডুবে ‘ডন’ নাকি ‘বাজিগর’ হয়ে ফিরবেন!