দিন–তারিখ ঠিক হয়ে আছে। ফতুল্লা ও বিকেএসপিতে প্রিমিয়ার ডিভিশন মহিলা ক্রিকেট লিগ শুরু হবে ২৩ মে থেকে। ১০ মে লিগের ১১টি ক্লাবকে পাঠানো বিসিবির মহিলা উইংয়ের চিঠিতে সে রকমই বলা। তার আগে গতকাল ও আজ মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের বিসিবি কার্যালয়ে হয়ে গেছে লিগের দলবদলও। তবে দলবদলের জন্য পর্যাপ্ত সময় না পাওয়ার অভিযোগে অ্যাজাক্স স্পোর্টিং ক্লাব ও শেখ রাসেল স্পোর্টস ডেভেলপমেন্ট একাডেমি লিগে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের এমন সিদ্ধান্তে লিগে খেলার সুযোগ পাবেন না অন্তত ২৮–৩০ জন নারী ক্রিকেটার।
দলবদল পেছানোর দাবি ছিল লিগের ১১ ক্লাবেরই। মহিলা উইংয়ের পাঠানো ১০ মের চিঠি উদ্ধৃত করে ১২ মে ১১টি ক্লাব মহিলা উইং প্রধান শফিউল আলম চৌধুরী বরাবর যৌথ চিঠি দেয়। যাতে বলা হয়, এত অল্প সময়ের মধ্যে তাদের পক্ষে দলবদল করে লিগে অংশ নেওয়া ‘দুঃসাধ্য ব্যাপার’। তীব্র দাবদাহে মহিলা, শিশু ও বয়স্কদের ঘর থেকে বের না হতে স্বাস্থ্য ও আবহাওয়া অধিদপ্তরের নির্দেশনা আছে জানিয়ে ঈদুল আজহার পর যেকোনো সময়ে দলবদল ও লিগ আয়োজনের অনুরোধ করে ক্লাবগুলো।
এই চিঠির পরও দলবদল হয়ে যাওয়ায় গতকাল পাঁচ ক্লাবের প্রতিনিধির স্বাক্ষরিত আরেকটি চিঠি দেওয়া হয় বিসিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরী বরাবর। আগের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে মহিলা উইংয়ের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করে বিসিবির প্রধান নির্বাহীর নির্দেশনা চাওয়া হয় এই চিঠিতে। এতে স্বাক্ষর করেন খেলাঘর সমাজ কল্যাণ সমিতি, শেখ রাসেল স্পোর্টস ডেভেলপমেন্ট একাডেমি, কেরানীগঞ্জ ক্রিকেট একাডেমি, সিটি ক্লাব, গুলশান ইয়ুথ ক্লাব ও অ্যাজাক্স স্পোর্টিং ক্লাবের প্রতিনিধি।
পরে অন্যরা দলবদলে অংশ নিলেও অ্যাজাক্স স্পোর্টিং ও শেখ রাসেল স্পোর্টস ডেভেলপমেন্ট একাডেমি তা নেয়নি। এই দুটি দল লিগ খেলবে না বলেও নিশ্চিত করেছে প্রথম আলোকে। অ্যাজাক্সের সভাপতি মনির হোসেন ক্লাবের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে বলেছেন, ‘বোর্ডের কাছে আমরা ৪–৫ দিন সময় চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা সেদিকে কর্ণপাত করেনি। আমাদের চিঠির জবাবও দেয়নি। সব মিলিয়ে বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে আমরা লিগে অংশ নিতে পারছি না।’
একই কথা বলেছেন শেখ রাসেল স্পোর্টস ডেভেলপমেন্ট একাডেমির সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান পলাশ। মেয়েদের ক্রিকেট নিয়ে বিসিবির প্রতি একরকম ক্ষোভই প্রকাশ করলেন তিনি, ‘খেলোয়াড় সংগ্রহ করতে অনেক সময় লাগে। এভাবে অল্প কয় দিনের নোটিশে দলবদল দিলে কীভাবে হবে! এ রকম দায়সারা লিগ আয়োজন করে ভালো কিছু হবে না।’
মেয়েদের ক্রিকেটে দল গড়া একটা পণ্ডশ্রম।
মেয়েদের ক্রিকেটে দল গঠন করাটাকে পণ্ডশ্রম বলেও মনে করেন পলাশ, ‘একটা ভালো দল গঠন করতে এক কোটি টাকার মতো খরচ হয়। অথচ বিসিবি অংশগ্রহণ ফি দেয় মাত্র এক–দেড় লাখ টাকা। বিকেএসপি যেতে বাসভাড়া দেয় ৮–১০ হাজার টাকা, যেখানে খরচ হয় ১৭–১৮ হাজার টাকা। যেসব ক্লাব শুধু মেয়েদের ক্রিকেটে দল করে, তাদের এখান থেকে কোনো প্রাপ্তি নেই। আম্পায়ারিং নিয়েও অনেক সমস্যা। সব মিলিয়ে মেয়েদের ক্রিকেটে আমাদের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। মেয়েদের ক্রিকেটে দল গড়া একটা পণ্ডশ্রম।’
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সামনে মেয়েদের দলের আন্তর্জাতিক ব্যস্ততা আছে। এ সময়ে লিগ পেছানো কঠিন। ক্লাবগুলো যে রকম তাদের সীমাবদ্ধতার কথা বলেছে, তারাও নিশ্চয়ই বিসিবির সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করবে।’
জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসিসি ইমার্জিং কাপ খেলতে হংকংয়ে যাবে মেয়েদের একটা দল। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে ভারতের জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের আসার কথা বাংলাদেশে। কাজেই ক্লাবগুলোর যেমন তড়িঘড়ি করে দলবদল করতে সমস্যা হয়েছে, বিসিবির জন্যও কঠিন লিগ পেছানো।
১২ মে মহিলা উইং প্রধানকে ক্লাবগুলোর দেওয়া চিঠিটা পড়লে অবশ্য মনে হতে পারে লিগ নিয়ে তাদের হঠাৎ প্রতিবাদী হয়ে ওঠার আরও কারণ আছে। কারণ, ওই চিঠিতেই তারা এমন কিছু দাবিও তুলে ধরা হয়েছিল, যেগুলো ঠিক লিগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। যার অন্যতম প্রিমিয়ার ডিভিশন মহিলা ক্রিকেট লিগের সব ক্লাবকে বিসিবির কাউন্সিলরশিপ প্রদান ও দেশের মাটিতে হওয়া যেকোনো আন্তর্জাতিক সিরিজে ক্লাব প্রতিনিধিদের একটি করে অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড ও ম্যাচপ্রতি কমপক্ষে ২৫টি টিকিট দেওয়া। এ ছাড়া লিগের অংশগ্রহণ ফিসহ যাতায়াত, পোশাক ও থাকা-খাওয়ার বরাদ্দ বাড়ানো এবং প্রত্যেক দলে প্রথম বিভাগ লিগের তিনজন খেলোয়াড় খেলানোর অনুমতিও চেয়েছিল ক্লাবগুলো।
অ্যাজাক্সের দুই খেলোয়াড়কে আমি গতকাল রাতে আমার দলে নিয়েছি। আমার খারাপ লাগছে যে অনেক খেলোয়াড় বাইরে রয়ে গেছে, যারা এখনো দল পায়নি। আমার বিশ্বাস বিসিবি বিষয়টা শক্তভাবে দেখবে।
লিগ নিয়ে দুটি ক্লাব ও বিসিবির এই টানাপোড়েনে অসহায় অবস্থা ক্রিকেটারদের। দুটি ক্লাবের অংশ না নেওয়া মানে অন্তত ২৮–৩০ জন ক্রিকেটারের লিগে খেলতে না পারা, খেলা থেকে তাদের বছরের মূল আয়টা না হওয়া। এবারও আবাহনীতেই থেকে যাওয়া জাতীয় নারী দলের পেসার জাহানারা আলমের কথায় ফুটে উঠল সেই হতাশা। মিরপুরে আজ সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, ‘দুটি দল খেলতে আসছে না, এটা খুবই খারাপ একটা বিষয় মেয়েদের ক্রিকেটের জন্য। প্রত্যেক খেলোয়াড় সারা বছর আশা নিয়ে থাকে। অক্লান্ত পরিশ্রম করে। তারা নিজেরা টাকা খরচ করে অনুশীলন করে। তারা অপেক্ষা করে থাকে বছর শেষে প্রিমিয়ার লিগ খেলবে, সেখান থেকে যে টাকাটা আসবে, তা দিয়ে তারা পরের বছর অনুশীলন করবে।’
অ্যাজাক্সের দুই খেলোয়াড়কে নিজের দলে নিয়ে নিয়েছেন জানিয়ে জাহানারা বলেন, ‘অ্যাজাক্সের দুই খেলোয়াড়কে আমি গতকাল রাতে আমার দলে নিয়েছি। আমার খারাপ লাগছে যে অনেক খেলোয়াড় বাইরে রয়ে গেছে, যারা এখনো দল পায়নি। আমার বিশ্বাস বিসিবি বিষয়টা শক্তভাবে দেখবে। ভবিষ্যতে যেন কোনো ক্লাব এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি না করে।’
একই দাবি জাতীয় দলের আরেক ক্রিকেটার রুমানা আহমেদের। মোহামেডানের এই ক্রিকেটার বেশ কড়াভাবেই বললেন, ‘মেয়েদের দল যদি গঠন না করে, তাহলে এসব ক্লাব যেন ক্রিকেটের ধারেকাছে না আসে। কারণ, এভাবে অনেক সম্ভাবনাময় ক্রিকেটারের ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে। আপনারা যদি মেয়েগুলোর কান্না শুনতেন! বোর্ডের উচিত কিছু করা।’
রুমানা জানান, অ্যাজাক্স না খেলার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় জাতীয় দলের ক্রিকেটার খাদিজা তুল কুবরারও লিগে খেলা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। পরে মোহামেডান কর্মকর্তাদের অনুরোধ করে কুবরাকে দলে নেওয়া হয়েছে।