খেলায় চলছে জুয়ার বিজ্ঞাপন, দেখেও দেখছে না কেউ

টেলিভিশনে খেলা দেখা যেন এখন আর শুধু খেলা দেখাই নয়, সঙ্গে বাজি ধরার চটকদার বিজ্ঞাপন দেখাও! চাইলে খেলা দেখতে দেখতেই কেউ একটা ম্যাচ বা ম্যাচের কোনো অংশ নিয়ে বাজি ধরে ফেলতে পারেন। বাজি মানে জুয়া বা বেটিং।

ধরুন একজন ব্যাটসম্যান ব্যাট করছেন, তিনি কত রানে আউট হবেন, কারও সেটা নিয়ে বাজি ধরার ইচ্ছা হলো। কোনো সমস্যা নেই। টিভি পর্দায় তো ভেসে উঠছে অমুক ডট কম, তমুক ডট কমের ‘সারোগেট’ বা ছদ্মবেশী বিজ্ঞাপন। মুঠোফোন হাতে নিয়ে একটায় ঢুকে গেলেই হলো।

আরও পড়ুন

খেলার মধ্যে বেটিং সাইটের সারোগেট বিজ্ঞাপন দেখানোর উদ্দেশ্য মূলত দর্শকদের জুয়ার প্রলোভনে ফেলা। বিশ্বের অনেক দেশে বেটিং বৈধ হলেও বাংলাদেশের আইনে যেকোনো ধরনের জুয়া ও বাজি ধরা নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ এসবের প্রচার-প্রচারণাও।

তারপরও এখানে টেলিভিশন চ্যানেল, ওয়েবসাইট, ইউটিউব চ্যানেল এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন আসে, তবে আসে একটু ভিন্ন উপস্থাপনায় বা ছদ্মবেশ ও ছলচাতুরীর মাধ্যমে। যা দেখে যে কেউ বুঝবেন, এসব আসলে বেটিং ওয়েবসাইটেরই প্রচার।

আইনি ঝামেলা এড়ানোর জন্য বিজ্ঞাপনগুলোতে শুধু বানানে বা ওয়েবসাইট ঠিকানায় দু-একটি অক্ষরের তারতম্য রেখে দেওয়া হয়। যাতে সমস্যায় পড়লে অজুহাত দেয়া যায়, এটা তো বেটিং ওয়েবসাইটের বিজ্ঞাপন নয়। কখনো মূল বেটিং সাইটের নামের সঙ্গে ‘নিউজ’ কথাটা জুড়ে দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা হয়, এটা আসলে একটা সংবাদ ওয়েবসাইটের বিজ্ঞাপন। ২০২২ সালে বেটিং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বেট উইনার যেমন সাকিব আল হাসানকে পণ্যদূত করতে গিয়ে হয়ে গিয়েছিল ‘বেট উইনার নিউজ।’

আমার জানামতে, আমরা সরাসরি কোনো বেটিংয়ের বিজ্ঞাপন চালাই না। আমরা সারোগেট বিজ্ঞাপন অথবা নিউজ পোর্টালের বিজ্ঞাপন চালাই। এগুলোর কোনোটাই সরাসরি বেটিংয়ে নেই।
ইশতিয়াক সাদেক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, টি স্পোর্টস

বাংলাদেশে বেটিং–সংক্রান্ত যেকোনো কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ বলে কাছাকাছি নামের একটা কিছুর বিজ্ঞাপন দিয়ে দর্শকদের মাথায় শুধু ওই সাইটের নাম ঢুকিয়ে দেওয়াই লক্ষ্য থাকে বিজ্ঞাপনদাতাদের। এরপর মস্তিষ্কে ঢুকে যাওয়া বেটিংয়ের ঘুণপোকা ‘টার্গেট’কে এগিয়ে নিয়ে যায় ‘অভীষ্ট’ লক্ষ্যের দিকে।

সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে এসব বেটিং সাইটের চলে লুকোচুরি খেলা। আজ একটা বন্ধ করা হয় তো কাল আরও কয়েকটা চলে আসে। আর এভাবে অনলাইন বেটিং সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে অনেকটা মাদকের নেশার মতো। আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও খেলার মধ্যে দেখানো হচ্ছে বেটিং–সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সারোগেট বা ছদ্মবেশী বিজ্ঞাপন।

অনলাইনে জুয়ার বিস্তার নিয়ে গত বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। জুয়ার কারণে নানা সামাজিক সমস্যার কথা উল্লেখ সংস্থাটি বলেছে, অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা পাচার হয়।

বিষয়টি একই দিন জাতীয় সংসদেও আলোচনায় ওঠে। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এক সংসদ সদস্যের প্রশ্নের লিখিত উত্তরে জানান, অনলাইন জুয়া, হুন্ডিসহ অপরাধমূলক বিভিন্ন কারণে দেশ থেকে মুদ্রা (টাকা) পাচার হচ্ছে।

আদালতের নির্দেশ

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদে জুয়া খেলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারপরও লুকিয়ে-ছাপিয়ে জুয়া খেলা হয়ে আসছে। এখন তা রূপ নিয়েছে ডিজিটাল সংস্করণ ‘অনলাইন বেটিং’য়ে। ডিজিটাল জুয়ার সামাজিক প্রভাবও ‘অ্যানালগ জুয়ার’ মতোই নেতিবাচক। সারোগেট বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ হয়ে অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে অতীতের মতোই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ।

২০২২ সালের ১১ ডিসেম্বর এ–সংক্রান্ত এক রিট আবেদনে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ইন্টারনেটভিত্তিক জুয়ার বিজ্ঞাপন ও সারোগেট বিজ্ঞাপন অপসারণ ও প্রচার বন্ধের নির্দেশনা চাওয়া হয়। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ ডিসেম্বর এ বিষয়ে রুল জারি করেন আদালত।

রুলে জানতে চাওয়া হয় অবৈধ অনলাইন বেটিং বা জুয়ার বিজ্ঞাপন সম্প্রচার বন্ধ বা অপসারণে ব্যর্থতা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না এবং অবিলম্বে এসব বিজ্ঞাপনের সম্প্রচার, প্রচার বন্ধ বা অপসারণে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না। রুলের জবাব দিতে বলা হয় ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব, তথ্যসচিব, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যানকে।

বেটিং বা বেটিংয়ের প্রচারের বিরুদ্ধে বিসিবি বরাবরই জিরো টলারেন্স অবস্থানে আছে। আমাদের অবস্থান এখনো আগের মতোই।
নিজাম উদ্দিন চৌধুরী, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বিসিবি

সে ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালের ১১ জুলাই এক আদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও টেলিভিশন; বিশেষ করে খেলার চ্যানেলসহ ডিজিটাল ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অনলাইন বাজি ও জুয়ার বিজ্ঞাপন বন্ধে বিটিআরসিকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে যেসব আর্থিক পরিষেবার মাধ্যমে বেটিং ওয়েবসাইটের অর্থ আদান-প্রদান হয়, সেগুলোর গেটওয়ে এবং চ্যানেল বন্ধেরও নির্দেশনা দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন

তবু চলছে বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন

২০২২ সালে সাকিব আল হাসান বেটিং–সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইট ‘বেট উইনার নিউজের’ পণ্যদূত হয়ে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। দেশের আইনে জুয়া বা জুয়ার প্রচারণা নিষিদ্ধ বলে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও (বিসিবি) তখন নিয়েছিল শক্ত অবস্থান। বিসিবির চাপে সাকিব বেট উইনারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

অথচ বছর দেড়েক ধরে দেশের টেলিভিশন চ্যানেল এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বেটিং–সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের যে দুটি বেসরকারি চ্যানেল খেলা দেখায়, আদালতের নিষেধাজ্ঞার পরও সেই টি স্পোর্টস ও গাজী টিভি খেলার মধ্যে নিয়মিত এসব বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। বাংলাদেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ বিপিএলই হোক কিংবা ঘরের মাঠের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অথবা টি স্পোর্টস ও গাজী টিভিতে প্রচারিত আইপিএলের ম্যাচ; খেলার মধ্যে টেলিভিশনের পর্দায় একটু পরপরই ভেসে উঠছে বেটিং–সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন।

বেটিং কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় এসব চ্যানেলে দেখানো হচ্ছে খেলার টক শোও। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের হোম সিরিজে এই ধারা শুরু হয় ২০২২ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে। বিপিএলে প্রথম এ ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার হয় ২০২২–২৩ মৌসুমের আসরে, যা এ বছরের বিপিএলে আরো বেড়েছে।

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কাছ থেকে দুই মৌসুমের (এ বছর অনুষ্ঠিত দশম বিপিএল এবং আগামী বিপিএল) জন্য ৫৬ কোটি টাকায় বিপিএলের সম্প্রচারস্বত্ব কিনেছে মিলেনিয়াম মিডিয়া লিমিটেড, গাজী স্যাটেলাইট টিভি লিমিটেড, বেনটেক ও এশিয়াটিক এমইসি নামের চারটি প্রতিষ্ঠানের মিলিত কনসোর্টিয়াম। মিলেনিয়াম মিডিয়া এই কনসোর্টিয়ামের নেতৃত্বে। বিসিবির হোম সিরিজের সম্প্রচারস্বত্বও বর্তমানে তাদের মালিকানায়।

বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টি স্পোর্টস ও গাজী টিভি এবং কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে খেলা সম্প্রচার করছে এই কনসোর্টিয়াম। বিসিবির সঙ্গে তাদের দুটি (বিপিএল ও হোম সিরিজ) চুক্তিতেই পরিষ্কার বলা আছে, টেলিভিশনে খেলা সম্প্রচারের সময় বেটিং–সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না।

টেলিভিশন চ্যানেলে বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন আসে সরাসরি এজেন্টদের মাধ্যমে। সম্প্রচারকারী চ্যানেলের তাই সুযোগ থাকে যাচাই-বাছাই করে বিজ্ঞাপন নেওয়ার। সেটি যে তারা করছে না, তা বিজ্ঞাপন প্রচার থেকেই বোঝা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে টেলিভিশনে দেখানো একেকটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে সব মিলিয়ে বেটিং–সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সারোগেট বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়েছে সর্বোচ্চ ১২ থেকে ১৫ মিনিট পর্যন্ত।  

আরও পড়ুন

সম্প্রচারস্বত্বাধিকারীদের নানা অজুহাত

বেটিং সাইটের সারোগেট বিজ্ঞাপন প্রচারের ব্যাপারে জানতে চাইলে মিলেনিয়াম মিডিয়ার পক্ষে টি স্পোর্টসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইশতিয়াক সাদেক বলেন, ‘আমার জানামতে, আমরা সরাসরি কোনো বেটিংয়ের বিজ্ঞাপন চালাই না। আমরা সারোগেট বিজ্ঞাপন অথবা নিউজ পোর্টালের বিজ্ঞাপন চালাই। এগুলোর কোনোটাই সরাসরি বেটিংয়ে নেই। যদি সারোগেট বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকে, সেটাও আমরা চালাব না।’

এশিয়াটিক এমইসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোর্শেদ আলমও সরাসরি এর দায় নিতে চাননি। সম্প্রতি তিনি এই প্রতিবেদককে মুঠোফোনে বলেন, ‘বিষয়টা (বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন) আমাদের অন্য পার্টনাররা দেখেন। এ ব্যাপারে আমার পরিষ্কার ধারণা নেই।’

তিনি দাবি করেন, ‘শুধু ক্রিকেটেই নয়, আমরা বাংলাদেশেই বেটিং–সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বিজ্ঞাপন এজেন্সি হতে রাজি নই। আমাদের কাছে একটা বেটিং কোম্পানি এসেছিল তাদের এজেন্ট হিসেবে মিডিয়াতে বিজ্ঞাপন করার জন্য। এশিয়াটিক কিছু নীতি মেনে ব্যবসা করে। সেই নীতি মেনেই আমরা সেসব প্রত্যাখ্যান করেছি।’

যোগাযোগ করা হলে কনসোর্টিয়ামের অন্য দুই অংশীদার গাজী গ্রুপ ও বেনটেক লিমিটেডের কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

দু-একটা ছাড়া বেশির ভাগ বোর্ডই এখন সারোগেট অনুমোদন করে দিয়েছে। ভবিষ্যতে হতেও পারে (বাংলাদেশে)।
ইসমাইল হায়দার মল্লিক, বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্যসচিব

কনসোর্টিয়াম–সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দাবি করেছেন, বিপিএল নিয়ে বিভিন্ন বিতর্কের কারণে এই টুর্নামেন্টের খেলা সম্প্রচারে স্থানীয় বিজ্ঞাপন পাওয়া যায় না। সে কারণেই তাদের বেটিং–সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হয়। কিন্তু এসব বিজ্ঞাপন প্রচার করেও নাকি এবারের বিপিএলে প্রত্যাশিত মুনাফা হয়নি।

বিসিবির ‘জিরো টলারেন্স’, তবে…

বেটিং–সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রচার করায় ২০২৩ সালের ১২ জানুয়ারি সেই সময়ের সম্প্রচারস্বত্বাধিকারী কনসোর্টিয়ামকে বিসিবি সতর্কতামূলক চিঠি দেওয়ার পর তা বন্ধ হয়। বিসিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরী স্বাক্ষরিত চিঠিতে ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে চুক্তির শর্ত মনে করিয়ে দিয়ে বলা হয়েছিল, বিপিএলের খেলা সম্প্রচারের সময় বেটিং ও অনলাইন বেটিং (সারোগেট এবং নন–সারোগেট) সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রচার চালানোর সুযোগ নেই। এর ব্যত্যয় ঘটলে কালোতালিকাভুক্ত করাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও সতর্ক করা হয় চিঠিতে।

এ ব্যাপারে বিসিবির অবস্থান আগের মতোই কঠোর বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন নিজাম উদ্দিন চৌধুরী, ‘বেটিং বা বেটিংয়ের প্রচারের বিরুদ্ধে বিসিবি বরাবরই জিরো টলারেন্স অবস্থানে আছে। আমাদের অবস্থান এখনো আগের মতোই।’ তবে তিনি বলেন, ‘ক্রিকেট বোর্ডের কাজ দেশের ক্রিকেট পরিচালনা করা। আমরা চাইলেও এসব (বেটিংয়ের বিজ্ঞাপন প্রচার) বন্ধ করতে পারব না। বড় জোর সতর্ক করতে পারি। এসব দেখার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ আছে।’

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা রাষ্ট্রের অন্যান্য সংস্থা থেকে এ ধরনের কোনো অনুরোধ এলে আমরা সেদিকে দৃষ্টি দিই। সরকারের অনুমোদনে নিবন্ধিত কোনো সাইটে আপত্তিকর কোনো বিষয় রিপোর্ট হলে সে ব্যাপারে বিটিআরসি সংশ্লিষ্ট বিভাগের মতামতের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে
ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ খলিল-উর-রহমান, মহাপরিচালক (সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিসেস), বিটিআরসি

এর আগে গত ১৯ জানুয়ারি দশম বিপিএল শুরুর এক দিন আগে বিসিবি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্যসচিব ইসমাইল হায়দার মল্লিক বলেছিলেন, ‘আমরা কখনোই বেটিং সাইটকে অনুমোদন দিই না।’

বেটিং সাইটের সারোগেট বিজ্ঞাপন বন্ধ করায় ‘ভালো ব্যবসা হয়নি’ অজুহাতে ২০২২–২৩ মৌসুমে সম্প্রচারস্বত্বের ওই সময়ের মালিকেরা বিসিবির কাছ থেকে ১০ কোটি টাকার মতো আর্থিক ছাড় পেয়েছিলেন বলেও জানান মল্লিক। ভবিষ্যতে এ ক্ষেত্রে বিসিবির নমনীয় হওয়ার আভাস পাওয়া গিয়েছিল তাঁর কথায়, ‘দু-একটা ছাড়া বেশির ভাগ বোর্ডই এখন সারোগেট অনুমোদন করে দিয়েছে। ভবিষ্যতে হতেও পারে (বাংলাদেশে)।’

কেন বন্ধ হচ্ছে না বেটিংয়ের বিজ্ঞাপন

বেটিং প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন টেলিভিশনে দেখানো হলেও সেসব যেন চোখে পড়ছে না সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর! এ ব্যাপারে একধরনের উদাসীনতাই যেন কাজ করছে তাদের মধ্যে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংক্ষুব্ধ কেউ যদি কোনো চ্যানেলে এ ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচারের অভিযোগ আনেন, তাহলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট চ্যানেলের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। অভিযোগ প্রমাণিত হলে নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

এখন পর্যন্ত এ রকম কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এর আগে কয়েকটি চ্যানেলকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে, জরিমানাও করা হয়েছে।’

মাহবুবা নাসরিন এসব জুয়ার বিজ্ঞাপনের আরও সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাবও দেখতে পান। তাঁর শঙ্কা, বাংলাদেশে এর বিস্তার থামাতে না পারলে সেটি খেলোয়াড়দের মনোজগতে কালো ছায়া ফেলতে পারে, যা তাঁদের উসকে দিতে পারে ম্যাচ গড়াপেটার প্রলোভনের দিকেও।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) মহাপরিচালক (সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিসেস) ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ খলিল-উর-রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিটিআরসি স্বপ্রণোদিত হয়ে অনলাইনে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। ২০২৩ সালে তারা বহু বেটিং সাইট (১ হাজার ৪০০–এর বেশি), অ্যাপ এবং বেটিংয়ে উৎসাহ জোগানো কনটেন্ট বা আধেয় প্রচার বন্ধ করেছে।

তবে টেলিভিশনে বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন বন্ধ করার ক্ষমতা সরাসরি বিটিআরসির হাতে নেই। খলিল-উর-রহমান বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা রাষ্ট্রের অন্যান্য সংস্থা থেকে এ ধরনের কোনো অনুরোধ এলে আমরা সেদিকে দৃষ্টি দিই। সরকারের অনুমোদনে নিবন্ধিত কোনো সাইটে আপত্তিকর কোনো বিষয় রিপোর্ট হলে সে ব্যাপারে বিটিআরসি সংশ্লিষ্ট বিভাগের মতামতের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।’

আরও পড়ুন

সমাজে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব

গ্রাম্য বাজার থেকে শুরু করে শহরের পাড়া-মহল্লার চা–দোকান—সর্বত্রই চলছে অনলাইন বেটিংয়ের চর্চা। অনেকেই অনলাইন বেটিংয়ে আসক্ত হয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। এ নিয়ে পারিবারিক অশান্তি, মারামারি, এমনকি খুনখারাবির ঘটনাও আছে।

সমাজবিজ্ঞানী এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ উপাচার্য মাহবুবা নাসরীন মনে করেন, বেটিং-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ না হলে দেশের কিশোর তরুণ প্রজন্ম খেলার চেয়েও বেটিংয়ের দিকে বেশি ঝুঁকে যেতে পারে।

সম্প্রতি তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে জুয়া খেলা আগে ক্লাব বা ঘরের মধ্যে সীমিত ছিল।গত কয়েক বছরে আমরা দেখছি ডিজিটাল মাধ্যম এবং খেলার সময় টেলিভিশনেও জুয়া খেলার বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে। এটা ক্ষতিকর। কারণ, এতে কিশোর-তরুণসমাজ সেদিকে বেশি ঝুঁকে যেতে পারে।’

মাহবুবা নাসরীন এসব জুয়ার বিজ্ঞাপনের আরও সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাবও দেখতে পান। তাঁর শঙ্কা, বাংলাদেশে এর বিস্তার থামাতে না পারলে সেটি খেলোয়াড়দের মনোজগতে কালো ছায়া ফেলতে পারে, যা তাঁদের উসকে দিতে পারে ম্যাচ গড়াপেটার প্রলোভনের দিকেও।