সৌরভ গাঙ্গুলীকে টপকে সর্বকনিষ্ঠ: এক স্কুলছাত্রের ক্রিকেটের প্রতি নিবেদনের গল্প

বাংলা ক্রিকেট দলের ব্যাটসম্যান অঙ্কিত চ্যাটার্জিছবি: সিএবি

দৃষ্টিনন্দন কাভার ড্রাইভে কাল অঙ্কিত চ্যাটার্জি যখন হরিয়ানার পেসার অংশুল কম্বোজের বলটাকে সীমানাছাড়া করলেন, তা যেন সৌরভ গাঙ্গুলীর স্মৃতি ফিরিয়ে আনল।

ভারতীয় ক্রিকেটে অফসাইডে শট খেলায় সৌরভের জুড়ি মেলা ভার। তাঁর কাভার ড্রাইভগুলো এখনো ক্রিকেট অনুরাগীদের চোখে ভাসে। সেই শটেই অঙ্কিত পেলেন রঞ্জি ট্রফিতে প্রথম রান। এর আগেই অবশ্য ভারতের সাবেক অধিনায়কের প্রায় ৩৫ বছর আগের রেকর্ড ভেঙেছেন।

সৌরভকে ছাড়িয়ে অঙ্কিতই এখন রঞ্জি ট্রফিতে পশ্চিমবঙ্গ ক্রিকেট দলের (বাংলা ক্রিকেট দল নামে পরিচিত) সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার। কাল কল্যাণীর মাঠে বাংলার অভিজ্ঞ উইকেটকিপার–ব্যাটসম্যান ঋদ্ধিমান সাহা যখন অঙ্কিতের মাথায় ক্যাপ পরিয়ে দিলেন, তখন তাঁর বয়স ১৫ বছর ৩৬১ দিন। অর্থাৎ ১৬তম জন্মদিনের ঠিক ৫ দিন আগে বাংলার হয়ে রঞ্জিতে অভিষেক অঙ্কিতের।

ভারতীয় ক্রিকেটে অফসাইডের রাজা মনে করা হয় সৌরভ গাঙ্গুলীকে
ছবি: ফেসবুক

ভারতের অন্যতম সফল অধিনায়ক সৌরভের রঞ্জিতে অভিষেক হয়েছিল ১৭ বছর ২৫৭ দিন বয়সে, ১৯৮৯–৯০ মৌসুমের ফাইনালে। কলকাতার ইডেন গার্ডেনের সেই ম্যাচে দিল্লির সঙ্গে ড্র করে শিরোপা জিতেছিল সৌরভের বাংলা। তবে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে বাংলার হয়ে খেলা দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার অঙ্কিত চ্যাটার্জি। ১৯৬০–৬১ মৌসুমে ১৫ বছর ১৯৪ দিন বয়সে অভিষেক হয়েছিল অম্বর রায়ের।

কাল প্রথম ইনিংসে হরিয়ানাকে ১৫৭ রানে গুটিয়ে দেওয়ার পর শেষ বিকেলে ব্যাট করতে নেমেছিল বাংলা। স্বাগতিকেরা ৫ ওভারে ১ উইকেট হারিয়ে করেছিল ১০ রান। অভিষিক্ত ওপেনার অঙ্কিত অপরাজিত ছিলেন ৫ রানে। আজ দ্বিতীয় দিনে ইনিংসটিকে আরেকটু বড় করছেন এই কিশোর। আউট হওয়ার আগে করেছেন ২৯ রান।

আমার কাছে এটা খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। গত রাতে (পরশু) আমার ঘুমও ভালো হয়েছে। ব্যাটিংয়ের সময় আক্রমাত্মক হতে চাইনি। প্রথম বলটা মারার মতো ছিল, তাই মেরেছি
অঙ্কিত চ্যাটার্জি, রঞ্জি ট্রফিতে বাংলার সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার

অঙ্কিত চ্যাটার্জির মধ্যে বিশেষ কিছু খুঁজে পেয়েছেন বলেই হয়তো বাংলার নির্বাচকেরা এত অল্প বয়সেই তাঁকে রঞ্জি ট্রফিতে খেলানোর যোগ্য মনে করেছেন। এমন প্রতিভাবান সবারই উঠে আসার পেছনে কোনো গল্প থাকে। অঙ্কিতের গল্পটা কঠিন পরিশ্রমের, খেলার প্রতি গভীর ভালোবাসা, আত্মত্যাগ ও নিবেদনের।

জন্ম পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকা বনগাঁওয়ে। বর্তমানে বনগাঁও উচ্চবিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ছেন। যখন পুরো পৃথিবী ঘুমিয়ে থাকে, তখন তিনি ঘুম থেকে ওঠেন।

রঞ্জি ট্রফিতে অঙ্কিত চ্যাটার্জিকে অভিষেকের ক্যাপ পরিয়ে দেন ঋদ্ধিমান সাহা
ছবি: সিএবি

রাত সাড়ে ৩টায় রেলস্টেশনে ছুটতে হয় শিয়ালদহগামী ভোর ৪টা ২৫ মিনিটের ট্রেন ধরার জন্য। শিয়ালদহ যেতে লাগে ২ ঘণ্টা, সেখান থেকে কলকাতা ময়দানে (গড়ের মাঠ নামেও পরিচিত) যেতে লাগে আরও ৩০ মিনিট। এরপর শুরু হয় অনুশীলন।

আরও পড়ুন

প্রতিদিন কাজিনদের নিয়ে বনগাঁও থেকে কলকাতা ময়দানে অনুশীলন করতে যান অঙ্কিত। সেখান থেকে ফিরে পড়শোনা শেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ৯টা পার। এরপর আবার ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে ট্রেন ধরতে ছোটা। তিন বছর ধরে এভাবেই চলছে অঙ্কিতের জীবন। কাল সেই পরিশ্রমেরই যেন পুরস্কার পেলেন অঙ্কিত।

আঙুলের চোটে পড়ায় বাংলার ওপেনার অভিমন্যু ঈশ্বরণ হরিয়ানার বিপক্ষে খেলতে পারছেন না। তাঁর জায়গায় অভিষেক হয় অঙ্কিতের। ঈশ্বরণের অনুপস্থিতিতে তাঁকে খেলতে হবে—এই খবর ম্যাচ শুরুর মাত্র দুই দিন আগে জানানো হয়েছে অঙ্কিতকে।

পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকা বনগাঁও থেকে উঠে এসেছেন অঙ্কিত চ্যাটার্জি
ছবি: ফেসবুক

এত অল্প বয়সে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক হতে চলার কথা ভেবে অনেকেরই স্নায়ুচাপে ভোগার কথা। কিন্তু অঙ্কিত বিন্দুমাত্র ঘাবড়ে যাননি। বরং এই বাঁহাতি ওপেনার বড় পরীক্ষা দেওয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত ছিলেন। নিজেকে চাপমুক্ত রাখার এই পাঠটা তাঁকে দিয়েছেন শৈশবের কোচ দোলন গোলদার।

কাল প্রথম দিনের খেলা শেষে বার্তা সংস্থা পিটিআইকে অঙ্কিত বলেছেন, ‘আমার কাছে এটা খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। গত রাতে (পরশু) আমার ঘুমও ভালো হয়েছে। ব্যাটিংয়ের সময় আক্রমাত্মক হতে চাইনি। প্রথম বলটা মারার মতো ছিল, তাই মেরেছি।’

অঙ্কিতের বাবা অনুপ চ্যাটার্জি পেশায় একজন ঠিকাদার। খেলার প্রতি ছেলের ঝোঁক দেখে ব্যাট কিনে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের বাড়ির পেছনে একটা বিশাল উঠান আছে। সেখানেই ও খেলত। আমি ওর মধ্যে খেলার প্রতি ভালোবাসা দেখেছিলাম।’ তা দেখেই সোনালি ক্রিকেট কোচিং সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন অনুপ। অঙ্কিত সেখানেই কোচ হিসেবে পান দোলনকে।

রঞ্জি ট্রফিতে নিজের প্রথম ইনিংসে ২৯ রানে আউট হয়েছেন অঙ্কিত চ্যাটার্জি
ছবি: এক্স

গর্বিত বাবা অনুপ আরও বলেন, ‘বাড়িতে ও একদমই বাচ্চা। এখনো ওর মা ওকে খাইয়ে দেয়। বাড়ি ফিরে আমরা মিষ্টি খেয়ে আনন্দ করব।’ শিষ্যকে নিয়ে কোচ দোলন বলেছেন, ‘ও খুব শান্ত বাচ্চা (ছেলে) ছিল। সব কথা মন দিয়ে শুনত। যতক্ষণ না বারণ করতাম, ততক্ষণ অনুশীলন চালিয়ে যেত।’

আরও পড়ুন

অঙ্কিত খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে উন্নতি করতে থাকে। বাংলা অনূর্ধ্ব–১৬ দলের হয়ে বিজয় মার্চেন্ট ট্রফিতে সবচেয়ে বেশি রান করেছিলেন। সেই পারফরম্যান্সের সুবাদে কোচ সৌরাশিস লাহিড়ীর অধীন বাংলা অনূর্ধ্ব–১৯ দলে জায়গা করে নেন। সেই দলের হয়ে বিনু মানকড় ট্রফিতে আসামের বিপক্ষে ৭৫ বলে সেঞ্চুরি করেন, মারেন ৯টি ছক্কা। তাঁর প্রতিটি ছক্কায় বল আশ্রয় নেয় গ্যালারিতে। এই মৌসুমে বিনু মানকড় ট্রফিতে ৪০০–এর বেশি রান করে বাংলার শীর্ষ রানসংগ্রাহক তিনিই।

কুচবিহার ট্রফিতেও ছন্দটা ধরে রাখেন অঙ্কিত। ইডেন গার্ডেনে শক্তিশালী মুম্বাইয়ের বিপক্ষে মাঠের চারপাশেই শট খেলেন, মধ্যাহ্নভোজ বিরতির আগেই সেঞ্চুরি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন।

কোচ লাহিড়ীর চোখে অঙ্কিত একজন নিঃস্বার্থ ক্রিকেটার, ‘সে একজন ভয়ডরহীন ক্রিকেটার, সব সময় দলের জন্য খেলে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রথম শটটাই খেলল কাভার ড্রাইভ। ওটাই ওর প্রিয় শট। বাঁহাতি ব্যাটসম্যান হওয়ায় দেখতেও ভালো লাগে।’

আরও অনেক দূর যেতে চান অঙ্কিত চ্যাটার্জি
ছবি: এক্স

বিরাট কোহলির অনেক ভক্ত অঙ্কিত চ্যাটার্জি। মাঠে কোহলির আগ্রাসী মানসিকতাও তাঁর ভীষণ পছন্দ। বাবা, কাজিন ও কোচদের জানিয়ে অঙ্কিত বলেছেন, ‘সবে শুরু। এখনো অনেকটা পথ বাকি।’

রঞ্জি ট্রফিতে হরিয়ানার বিপক্ষে বাংলার ম্যাচ শেষ আগামী রোববার। মঙ্গলবার ১৬ বছর পূর্ণ হবে অঙ্কিতের। বাড়ি ফিরে ছেলে জন্মদিনের কেক কাটবে, সেই অপেক্ষাতেই আছে পরিবার।