ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানো ফন বিকের কি মনে পড়েছে নানার কথা

ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে ম্যাচসেরা ফন বিকের মুখে সোনার হাসি। হাসিটা অবশ্য ভালো নাও লাগতে পারে ক্যারিবিয়ানদেরছবি: টুইটার

স্যামি গুলেনকে চেনেন? চেনা একটু কঠিনই বটে। পরিচয়টা দিয়ে ফেলি—স্যামি গুলেন একজন টেস্ট ক্রিকেটার। লোগান ফন বিকের আন্তর্জাতিক অভিষেকের (২০১৪) আগের বছর পাড়ি জমান পরপারে। ওহ, বলাই হয়নি স্যামি গুলেনের সঙ্গে ফন বিকের রক্তের সম্পর্ক। আর কে না জানে রক্ত কথা বলে!

এ কথা মুখের কথা নয়, স্বভাব–আচরণ এবং কাজে প্রকাশ পায়। ৬৭ বছর আগে স্যামি গুলেন যে কাজটা করেছিলেন, কাল তাঁর নাতি ফন বিকও ঠিক তা–ই করেছেন।

আরও পড়ুন

ফন বিকের মায়ের বাবা স্যামি গুলেনের জন্ম ওয়েস্ট ইন্ডিজে। ১৯৫১-৫৬–এর মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ৫টি টেস্ট খেলেছেন। এরপর নিউজিল্যান্ডে পাড়ি জমিয়ে কিউইদের হয়েও ৩টি টেস্ট খেলেন সাবেক এই উইকেটকিপার। সব কটি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে।

এর মধ্যে ১৯৫৬ সালে অকল্যান্ডে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে নিউজিল্যান্ডের প্রথম টেস্ট জয়েও স্যামি গুলেনের অবদান ছিল। আলফ ভ্যালেন্টাইনকে স্টাম্পড করেছিলেন আর তাতেই জয় নিশ্চিত হয়েছিল নিউজিল্যান্ডের। রক্ত যে কথা বলে এবং সেটা কী কথা—তা এতক্ষণে নিশ্চয়ই ধরে ফেলেছেন!

বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে কাল হারারেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে সুপার ওভারে হারিয়েছে নেদারল্যান্ডস। ক্যারিবিয়ানরা ৬ উইকেটে ৩৭৪ রান তুলেও ম্যাচটা জিততে পারেনি শেষ দিকে ফন বিকের ১৪ বলে ২৮ রানের ইনিংসে। ম্যাচ টাই হওয়ার পর অবশ্য ওই ইনিংসটা সবার ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। সুপার ওভারে ফন বিক একাই তুলেছেন ৩০—সব বলেই বাউন্ডারি! ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাড়া করতে নেমে তুলেছে মাত্র ৮ রান। ডাচদের এই অবিস্মরণীয় জয়ে ফন বিকের অবদানই টেনে এনেছে তাঁর দাদা স্যাম গুলেনকে।

কিন্তু এখন দাদার প্রসঙ্গ থাক। এখন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার গল্প হোক। টি–টোয়েন্টি আসার পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ–ই তো এমন ব্যাটিং শিখিয়েছে। ইনিংসের শেষ দিকে বোলাররা অফ স্টাম্পের বাইরে ইয়র্কার লেংথে করলেও ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানরা কীভাবে রান তুলে ফেলেন! শাফল করে একটু সরে এসে মিড উইকেট সীমানা পার করার দক্ষতাটা ক্যারিবীয়দেরই বেশি। কাইরন পোলার্ড, আন্দ্রে রাসেল, নিকোলাস পুরানদের এভাবেই দেখা গেছে দিনের পর দিন। কিন্তু কাল হারারের তাকাসিংঙ্গা স্পোর্টস গ্রাউন্ডে রাসেল–পুরানরা কী দেখলেন? তাঁদের ব্যাটিংটাই করলেন লোগান ফক বিক নামের এক ‘ফ্লাইং ডাচম্যান’, আর তাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিশ্বকাপে খেলার আশা এখন সুতোয় ঝুলছে।

আরও পড়ুন

ডাচদের শেষ ওভারে ৯ রান করতে হতো। ৮ রান তোলার পর শেষ বলে আউট হন ফন বিক। ১৪ বলে তাঁর ২৮ রানের ইনিংসটি নিয়ে আসলে কথা বলার তেমন সুযোগ নেই। কারণ, আসল ঘটনা ঘটেছে এরপর সুপার ওভারে। জেসন হোল্ডারের করা সুপার ওভারে বিক একাই তুলেছেন ৩০ রান। বল ধরে ধরে বললে—৪, ৬, ৪, ৬, ৬, ৪!

হোল্ডারকে দোষারোপ করার সুযোগ সামান্যই। বেচারা অফ স্টাম্পের বাইরে ইয়র্কার লেংথেই বল করার চেষ্টা করেছেন। আর ফন বিক ক্রিজের পেছনে সরে গিয়ে লং অন, মিড উইকেট ও ডিপ মিড উইকেট দিয়ে বল বাউন্ডারি পার করেছেন। যেহেতু সেদিকে বাউন্ডারির সীমানা তুলনামূলক ছোট, ফন বিক তাই শক্তি, দক্ষতা ও উপস্থিত বুদ্ধির প্রয়োগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সুপার ওভারে সর্বোচ্চ রান তোলার রেকর্ড গড়ে ফেলেন। ওই এক ওভারে তাঁর ব্যাটিং দেখে মনে হয়েছে খুনে মেজাজে থাকা কোনো ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানের ব্যাটিংয়ের কার্বন কপি! এখন সেই ‘কপি’ নিয়ে কাটাছেঁড়া হওয়াই স্বাভাবিক।

সুপার ওভারে এই রান তাড়া করতে পারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তাতে ক্যারিবিয়ানদের নিয়েই কথা হচ্ছে বেশি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সুপার সিক্সে উঠেছে শূন্য পয়েন্ট নিয়ে। যেখানে সুপার সিক্সে ওঠা গ্রুপ ‘এ’–এর জিম্বাবুয়ের পয়েন্ট ৪, নেদারল্যান্ডসের ২। একসময়ের পরাক্রমশালী দলটি বিশ্বকাপে খেলতে পারবে কি না, সেটাই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। তাতে গোকুলে বেড়ে ওঠা ডাচদের নায়ক লোগান ফন বিক যেন একটু আড়ালে। যদিও তা হওয়ার কথা নয়। নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে ডাচরা কখনো এমন বিস্ফোরক ব্যাটিং দেখেনি। ফন বিককে তাই ডাচরা এমনিতেই মনে রাখবেন।

আরও পড়ুন

৩২ বছর বয়সী এই অলরাউন্ডার জানিয়েছেন, ম্যাচের অমন পরিস্থিতি থেকে এর আগে অনেকবারই হারতে হয়েছে, কিন্তু এবার নিজের দক্ষতার ওপর আস্থা রেখে দলকে পার করাতে পেরেছেন। ডাচরা ৬ উইকেটে ৩২৫ রানে থাকতে ক্রিজে এসেছিলেন। শেষ ৩ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ৪২ রান। ফন বিক এখান থেকে দলকে ম্যাচ টাই করানোর পর সুপার ওভারেও দলকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে গেছেন—কিছু কিছু সংবাদমাধ্যম যে তাঁকে ‘সুপারম্যান’ আখ্যা দিয়েছে, সেটা মোটেও অত্যুক্তি নয়। ফন বিক নিজে কী বলছেন?

স্যামি গুলেন (১৯২৪–২০১৩)
ছবি: টুইটার

বিক বলছেন, ‘আমি অনেক দিন ধরেই খেলছি। অমন পরিস্থিতি থেকে যত ম্যাচ হেরেছি, সেসব বিচারে বলতে পারি শেষ পর্যন্ত জিততে পারাটা খুব তৃপ্তিদায়ক। আমি শুধু নিজের দক্ষতার ওপর আস্থা রেখেছি—(বোলার) বাজে বল করলে মারব। তবে শেষ বলে মিড উইকেটে ওই শটে গড়বড় করে ফেলাটা ছিল হতাশাজনক।’

বিক বোঝাতে চেয়েছেন, ডাচদের ইনিংসে শেষ ওভারের শেষ বলটির আগে জয়ের সুযোগ ছিল। শেষ বলে একটি রান নিলেই ম্যাচটা জিতে নিত ডাচরা। তখন আর সুপার ওভারের দরকার হতো না। মিড উইকেটে ক্যাচ দিয়ে আউট হওয়া বিক অবশ্য সুপার ওভারেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছেন ওই মিড উইকেট দিয়েই একের পর এক বাউন্ডারিতে! এই যে দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাসের পারদ, সেটা কিন্তু একদিনে চড়েনি। বিকের মুখেই শুনুন, ‘ভালো লাগছে যে একটু দায়মোচন করতে পেরেছি। ৪৯তম ওভারে ভেবেছিলাম, সুযোগটা নেব। মারব। ১৮–১৯ মাস ধরে আমরা এটারই চর্চা করছি। এখন ভারতে বিশ্বকাপে খেলার ভালো সুযোগ আছে আমাদের।’