প্রিয় বাংলাদেশ, এমন দাপটই দেখতে চায় সবাই
ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখন ধুঁকছে। ৪৮ বলে পেরোতে হবে ১০৮ রানের পর্বত। হাতে মাত্র ৪ উইকেট থাকায় লক্ষ্যটা সেন্ট ভিনসেন্টের শীর্ষ চূড়া লা সুফিয়েরের চেয়েও দূর্লঙ্ঘ্য মনে হচ্ছিল। ধারাভাষ্যকক্ষে ইয়ান বিশপ তখন মাইক্রোফোন হাতে। অনেকটাই বক্তৃতার সুরে যা বললেন তাঁর সারসংক্ষেপ এমন, বাংলাদেশের এই দলটাই ভবিষ্যত। প্রতিভার ছড়াছড়ি। বোলিং ইউনিটটি অবিশ্বাস্য। কোচ ফিল সিমন্সকে সময় দিন। ভাবুন, এগোতে চাইলে এটাই ভিত। এখন না হলে আর কখনোই নয়!
বিশপ হয়তো জেনেও যেটা উল্লেখ করেননি, এটা বাংলাদেশের পূর্ণশক্তির টি-টোয়েন্টি দল নয়। সাকিব আল হাসান নেই, তাওহিদ হৃদয় ও মোস্তাফিজুর রহমানও নেই। কিন্তু বিশপদের দলটা পূর্ণ শক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আইসিসি টি-টোয়েন্টি র্যা ঙ্কিংয়ে চতুর্থ। এমন একটা দলকে তাঁদেরই মাঠে ৩-০ তে ধবলধোলাই করল কি না, পুরো শক্তির দল নিয়ে মাঠে নামতে না পারা র্যাঙ্কিংয়ে নবম বাংলাদেশ! লম্বা লাইনটি হজম করা শেষ হলে দয়া করে একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখুন।
ভাবুন, এমন বাংলাদেশকেই দেখতে চায় কি না, বাংলাদেশ ক্রিকেট! যাঁরা, যে কোনো পরিস্থিতি থেকে জয় ছিনিয়ে আনতে যেমন মরিয়া, তেমনি সুযোগ পেলে প্রথম ইনিংসেই প্রতিপক্ষকে স্রেফ খুন করে ফেলতে পারে!
সেন্ট ভিনসেন্টের এই আর্নস ভেলেই প্রথম ম্যাচে ১৪৭ তুলে ৭ রানে জিতেছে বাংলাদেশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পুরো ২০ ওভার খেলতে দেয়নি। হাসান মাহমুদ শেষ ওভারে ১০ রান দেওয়ার চ্যালেঞ্জ জিতেছেন আবারও। এই মাঠেই পরের ম্যাচে ১২৯ তুলে বাংলাদেশ জিতেছে ২৭ রানে। এবারও পুরো ২০ ওভার খেলতে পারেনি স্বাগতিকেরা। ভাবা যায়! বোলারদের কী অবিশ্বাস্য সম্মিলিত পারফরম্যান্স! আপনি বলবেন, দুটি ম্যাচের উইকেটই ব্যাটিংয়ের জন্য কঠিন ছিল। সে তো বটেই। তবে একই উইকেটে কিন্তু বাংলাদেশও ব্যাটিং করেছে, বোলিংও। পার্থক্য ছিল ওই কথাটির স্বার্থক প্রয়োগে, বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচাগ্র মেদিনী।
ক্যারিবিয়ান সেই মেদিনীকে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানেরা স্রেফ পুড়িয়ে দিয়েছেন আজ তৃতীয় ম্যাচে। সেই আর্নস ভেলেই আজ ব্যাটিংয়ের জন্য উইকেট একটু সহজ ছিল। মানে কিছুটা ব্যাটিংবান্ধব। প্রতিপক্ষের কন্ডিশন কাজে লাগাতে না পারার যে চিরায়ত আক্ষেপ এই দেশের ক্রিকেটে, সেটা আজ জাকের আলীর ব্যাটিং দেখে মনেই হয়নি। মনে হয়নি পারভেজের ২ ছক্কায় ২১ বলে ৩৯ দেখেও। বিশপ বলছিলেন, এই ছেলে পাওয়ারে বিশ্বাসী। আর জাকের? ধারাভাষ্যকার স্যামুয়েল বদ্রি জাকেরের ব্যাটিংকে সারসংক্ষেপ করেছেন সবচেয়ে ভালো---‘দ্য ক্যারিবিয়ান ক্রিপ্টোনাইট শো।’
জাকেরের ৪১ বলে অপরাজিত ৭২ আসলেই সুপারম্যানসুলভ ইনিংস। তবে চরিত্রটা যে মানুষেরই তৈরি, আর কে না জানে মানুষের অসম্ভব বলে কিছু নেই। আর্নস ভেলের টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৭ উইকেটে ১৮৯ ওঠার পর বাংলাদেশের বোলাররাও যেন অমন অদম্য রক্তমাংসের বুদ্ধিমান মানুষেই হয়ে উঠেছিলেন। ব্যাটিংবান্ধব এই উইকেটে একটি-দুটি জুটি টিকে গেলে এই রানও কিছু মনে হবে না, জানতেন তাঁরা। তাই ফাঁসটা কোনোভাবেই কেউ আলগা করেননি।
তাসকিন বরাবরের মতোই তাঁর প্রথম ওভারে ব্রেক-থ্রু এনে দেওয়ার পর মেহেদী হাসান দ্বিতীয় ওভারেই হেনেছেন আঘাত। ফল? ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২ ওভারে ২ উইকেটে ৭। চেপে ধরার এই ভিতটা পেয়ে যাওয়ার পর তৃতীয় ও চতুর্থ ওভারে মোট ২১ রান তুলে ফাঁস আলগা করার চেষ্টা করেছিলেন পুরান-চার্লস। কিন্তু ষষ্ঠ ওভারে আবারও মেহেদীতে আউট পুরান, এবার বোল্ড। পরের ওভারে তিন বলের মধ্যে আউট চেজ ও জনসন চার্লস। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৭ ওভার শেষে ৫ উইকেটে ৪৭। এরপর ম্যাচের ভাগ্যটা যেন নির্ধারিতই হয়ে গিয়েছিল।
সেই ভাগ্য নির্ধারণে একট মুহূর্ত থেকে বুঝে নিতে পারেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের চেয়ে ম্যাচে বেশি মনোযোগি ছিলেন বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা। ১৮ বলে ২৩ করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকা চার্লসের রান আউটের মুহূর্তটি। ঢিমেতালে দৌড়াচ্ছিলেন এই ওপেনার। প্রয়োজন ছিল সরাসরি থ্রোয়ে স্টাম্প ভাঙা। রিশাদ সেটা করেছেন।
রিশাদ ফাঁস পরিয়েছেন ক্যারিবিয়ান অধিনায়ক রোভম্যান পাওয়েলের গলায়ও। ১২ বলে ২ করা পাওয়েল শেষ পর্যন্ত রিশাদের ফাঁসেই ডুবেছেন। ম্যাচের বাকিটা বর্ণণা না করলেও চলে। কারণ আগের দুটো ম্যাচেও দেখা গেছে একই দৃশ্য। পাওয়ার প্লে-তে ওয়েস্ট ইন্ডিজের তিন-চারটি উইকেট ফেলার পর ফাঁস পরানো হয়েছে তাদের গলায়। তাতে হাঁসফাঁস করতে করতে কেউ ছিঁড়ে বের হওয়ায় চেষ্টায় আউট হয়েছেন, কেউ বা ফাঁসটা গলায় নিয়েই পথ ধরেছেন ড্রেসিংরুমের।
পার্থক্যটা হলো, বাংলাদেশের বোলাররা আজ সেটা করে দেখিয়েছেন ব্যাটিংবান্ধব উইকেটে। যেটা ক্যারিবিয়ান বোলাররা বাংলাদেশের ইনিংসে পারেননি।
রানখরায় থাকা লিটন ১৩ বলে ১৪-ও আজ আপনার ভালো লাগার কথা। কারণ পারভেজের সঙ্গে তাঁর ৪.৪ ওভারের জুটিতে উঠেছে ৪৪। পারভেজের মারা দুটি ছক্কাতেই বিশপের কণ্ঠে ঝরেছে মুগ্ধতা। এমনকি ১৩ বলের ব্যবধানে মিরাজ, শামীম ও মেহেদী আউট হওয়ার পরও বাংলাদেশের ইতিবাচক মানসিকতার ব্যাটিংয়ের ধারা কিন্তু বদলায়নি। এই বদলটাই তো দেখতে চান আপনি!
সুপারম্যানসুলভ ব্যাটিংয়ে সেটারই পূর্ণরুপ দিয়েছেন জাকের। সেখানেও কী নাটক কম হয়েছে! ১৪.৩ ওভারে রান আউট হয়ে রাগে গজরাতে গজরাতে জাকের ফিরে গিয়েছিলেন ড্রেসিংরুমে। কিন্তু তৃতীয় আম্পায়ার ভিডিও রিপ্লেতে দেখলেন জাকের নয়, অন্য প্রান্তে শামীম আউট। আপনি বলবেন জাকেরের সৌভাগ্য। আসলে দ্রুত ক্রিজে ব্যাট প্লেস করার কর্তব্যজ্ঞানই জাকেরকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। সেটা অন্য ভাষায় গেম সেন্স।
সেই জাকের ক্রিজে ফেরার এক বল পর মেহেদীও আউট! পরের গল্পটা অনেকটাই সুপারম্যান যেমন একাই পৃথিবীকে বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন, তেমনি জাকেরও নিজ কাঁধে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন প্রথম ইনিংসেই জয়ের সুবাস পাওয়ার বন্দরে।
প্রথম বাউন্ডারির আগে তাঁর রান ছিল ১৩ বলে ১০। এরপর ধীরে ধীরে বাড়ল শটের রেঞ্জ। শেষ ১০ ওভারে বাংলাদেশের তোলা ১১৩ রানের মধ্যে জাকেরের একারই ৩৫ বলে ৬৮! শেষ ৫ ওভারে বাংলাদেশের তোলা ৭৫ রানের মধ্যে ২৩ বলে ৫৪ জাকেরের। ক্যারিবিয়ান ধারাভাষ্যকারেরা বলতে বাধ্য হয়েছেন ‘অ্যা সুপারস্টার ইন মেকিং!’
কিন্তু টেস্ট সিরিজের সেই ৯১ দিয়ে জাকের এই দেশের সমর্থখদের মনের মণিকোঠায় আসন করে নিয়েছেন আগেই। আজ যেটা করলেন সেটাকে স্রেফ নতুন দিনের দর্শন দেওয়া বলা যায়। ছক্কা মেরে বল স্টেডিয়ামের বাইরে পাঠিয়েছেন দুবার। শেষ ওভারে তিন ছক্কায় একাই তুলেছেন ২৫! টি-টোয়েন্টি তো বটেই, ওয়ানডেতেও বাংলাদেশ এর আগে শেষ ওভারে কখনো ২৫ তুলেছে কি না, সেটা গবেষণার বিষয়।ধারাভাষ্যকারেরাই বলছিলেন, সম্ভবত না!
জাকেরের এই ৪১ বলে ৭২ আসলে ‘হোয়েন অ্যা ম্যান বিকামস সুপারম্যান।’ আর বোলারদের অবিশ্বাস্য বোলিং আসলে ক্যারিবিয়ান সুপারম্যানসুলভ ব্যাটসম্যানদের বুদ্ধিমান মানুষের কাছে হেরে যাওয়ার এক হিরণ্ময় উদাহরণ। আর সেই উদাহরণ তৈরি করেই টি-টোয়েন্টিতে প্রথমবারের মতো তিন ম্যাচের সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ধবলধোলাই করল বাংলাদেশ।
সংস্করণ যেটাই হোক, আমি জানতাম ক্যারিবিয়ানরা খুব কঠিনভাবে চড়াও হবে। এখানে বিশ্কাপে খেলেছি, কিন্তু ভালো খেলিনি। তাই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম এই সিরিজ নিয়ে।ম্যাচসেরা জাকের আলী
বলতে পারেন, এ এক নতুন বাংলাদেশ! বলতে পারেন, তলা থেকে উঠে এসে ফণা তুলে ছোবল মারার এ এক অনন্য তৃপ্তি। অধিনায়ক লিটন সেই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেই ম্যাচ শেষে বললেন, ‘ওদের পাওয়ারহিটার ছিল, কিন্তু আমরা ১৮০ (১৮৯) ডিফেন্ড করেছি। এটা বড় অর্জন। এখন আমরা সত্যিই ভালো খেলছি। আবার যখন খেলব, তখন্ও ভালো খেলা দরকার।’
লিটনের এই পরেরবারও ভালো খেলার মানসিকতার পেছনের গল্পটা আপনি খুঁজে নিতে পারেন, ম্যাচসেরা জাকেরর কথায়, ‘সংস্করণ যেটাই হোক, আমি জানতাম ক্যারিবিয়ানরা খুব কঠিনভাবে চড়াও হবে। এখানে বিশ্কাপে খেলেছি, কিন্তু ভালো খেলিনি। তাই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম এই সিরিজ নিয়ে।’
প্রিয় বাংলাদেশ দল, এই নতুন বাংলাদেশই সবাই দেখতে চায়। হার-জিত যাই হোক, হারের আগের হার নয়, জয়ের আগে উদযাপন নয়!
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১৮৯/৭ (জাকের ৭২*, পারভেজ ৩৯, মিরাজ ২৯, তানজিম ১৭, লিটন ১৪; শেফার্ড ২/৩০, চেজ ১/১৫, মোতি ১/৩০)।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ১৬.৪ ওভারে ১০৯ (শেফার্ড ৩৩, চার্লস ২৩, পুরান ১৫, মোতি ১২; রিশাদ ৩/২১, মেহেদী ২/১৩, তাসকিন ২/৩০, তানজিম ১/৩১, হাসান ১/৯)
ফল: বাংলাদেশ ৮০ রানে জয়ী।
ম্যাচসেরা: জাকের আলী (বাংলাদেশ)
সিরিজসেরা: মেহেদী হাসান (বাংলাদেশ)
সিরিজ: তিন ম্যাচের সিরিজ ৩-০ ব্যবধানে জিতল বাংলাদেশ।