ভাস্কর্যে তো মূর্ত হয়ে আছেনই, থাকবেন সব সময়। ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে নিজের নামাঙ্কিত স্ট্যান্ডের পাশেই যে ভাস্কর্য উন্মোচিত হয়েছে ১৫ দিন আগে। স্টেডিয়ামের অন্য প্রান্তে এদিন তিনি সশরীরও উপস্থিত।
তাঁর যে রেকর্ডকে অবিনশ্বর বলে ধরে নিয়েছিল প্রায় সবাই, সেই রেকর্ডকেই অতীত হয়ে যেতে দেখলেন শচীন টেন্ডুলকার। দেখলেন তাঁকেই আদর্শ মেনে বেড়ে ওঠা ব্যাটসম্যানের তাঁকে ছাড়িয়ে যাওয়া। সেটির উদ্যাপনও। আনন্দে লাফিয়ে ওঠার পর হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন বিরাট কোহলি। উঠে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে দুই হাত তুলে মাথা ঝুঁকিয়ে কুর্নিশ করলেন গ্যালারির উদ্দেশে। সেখানে জীবনসঙ্গী আনুশকা শর্মা দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছেন। তালি দিচ্ছেন শচীন টেন্ডুলকারও।
কুর্নিশটা কি তাহলে আনুশকা না শচীনকে? নাকি দুজনকেই? আনুশকা খেলা দেখতে এসেছেন, কোহলি রান করতে পারেননি—এই ঘটনা যতবার ঘটেছে, প্রায় ততবারই এর দায় নিতে হয়েছে আনুশকাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কুৎসিত সব আক্রমণের প্রতিবাদে অনেকবারই মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছেন কোহলি। স্মরণীয় এ অর্জনের দিনে সুখে-দুঃখে পাশে থাকার জন্য আনুশকাকে তাই কৃতজ্ঞতা জানাতেই পারেন।
কোহলির মুখ থেকে পরে অবশ্যই আসল তথ্যটা জানা যাবে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে সবাই ধরে নিলেন, কুর্নিশটা তিনি শচীন টেন্ডুলকারকেই করেছেন। টেন্ডুলকার যে তাঁর কাছে ব্যাটিংয়ের শেষ কথা। ১০ দিন আগে শচীনের ৪৯ ওয়ানডে সেঞ্চুরির রেকর্ড ছোঁয়ার পর আবারও যা জানিয়ে দিয়েছেন। এক্সে (সাবেক টুইটার) শচীন ততক্ষণে ভাইরাল হয়ে গেছেন...‘৪৯ থেকে ৫০-এ আসতে আমার ৩৬৫ দিন লেগেছে। আশা করি, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই ৪৯ থেকে ৫০-এ গিয়ে তুমি আমার রেকর্ডটা ভেঙে দেবে।’
সেটাই করলেন বিরাট কোহলি। ৪৯ থেকে ৫০-এ যেতে লাগল মাত্র ১০ দিন। উপলক্ষগুলোও বেছে নিচ্ছেন কী দারুণ! ৪৯তম সেঞ্চুরিতে শচীনকে ছোঁয়া নিজের ৩৫তম জন্মদিনে। ওয়ানডেতে ৫০ সেঞ্চুরির প্রথম কীর্তিতে সেই রেকর্ড নিজের করে নেওয়া এমন এক ম্যাচে, যে ধরনের ম্যাচে তিনি রান করতে পারেন না বলেই সবাই জেনে এসেছেন এত দিন। এত বড় ব্যাটসম্যান, অথচ আইসিসি টুর্নামেন্টের নকআউট ম্যাচে কিনা হাফ সেঞ্চুরিই নেই! বিরাট কোহলির এই সেঞ্চুরি তাই শুধু রেকর্ড ভাঙার নয়, একটা অপবাদ থেকে মুক্তি পাওয়ারও।
সেই মুক্তিও কী একটা ম্যাচে! দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল। সেই সেমিফাইনাল হচ্ছে আবার তাঁর আইডলের শহরে। এখন যা তাঁর নিজের শহরও। দিল্লি থেকে অনেক দিনই তো ঠিকানা করে নিয়েছেন মুম্বাইকে।
সেই রেকর্ডের প্রত্যক্ষদর্শীর তালিকায় তারকাদ্যুতি ছড়ানো নাম তো শুধু শচীন টেন্ডুলকার একাই নন। ধারাভাষ্যকার হিসেবে সুনীল গাভাস্কারের থাকারই কথা। তবে কোহলির আরেক হিরো ভিভ রিচার্ডস তো না-ও থাকতে পারতেন। মুম্বাইয়ে এত বড় ক্রিকেট ম্যাচ হলে বলিউডের নায়ক-নায়িকারা থাকবেন, এটাও স্বাভাবিক। রনবীর কাপুর আর জন আব্রাহামের কথা জানা গেল। কে জানে, হয়তো ছিলেন আরও কেউ কেউ। তাই বলে ডেভিড বেকহামও? ফুটবলারের পরিচয় ছাপিয়ে যাওয়া ইংলিশ তারকা ভারতে এসেছেন ইউনিসেফের একটা কাজে। বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে গ্ল্যামার যোগ করার এ সুযোগ কেন ছাড়বেন আয়োজকেরা! এত সব তারকা দর্শক...কোহলির রেকর্ড ভাঙা সেঞ্চুরি এদিক থেকেও তো একটু অন্যরকম।
রেকর্ড তো আর একটা নয়। এক সেঞ্চুরিতে তিন তিনটা রেকর্ড। আশ্চর্যই বলতে হবে, বাকি দুটি রেকর্ডের হাতবদলও শচীন টেন্ডুলকার টু কোহলি। দিনটাই কি তাহলে মুকুটবদলের! কোহলির সেঞ্চুরির পরপরই ওয়াসিম আকরাম টুইট করেছেন, ‘আমরা এখন বিরাট-যুগে বাস করছি। অভিনন্দন সম্রাট’, এটিকে তাই খুবই যথার্থ বলে মনে হচ্ছে।
তা সেই রেকর্ড দুটি কী? দুটিই বিশ্বকাপের রেকর্ড। ২০০৩ বিশ্বকাপে শচীন টেন্ডুলকারের ৬৭৩ এত দিন এক বিশ্বকাপে কোনো ব্যাটসম্যানের সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড হয়ে ছিল। ৮০ রান করেই যা ভেঙে দিয়েছেন কোহলি। ১১৭ রানে আউট হয়ে ফেরার সময় এই বিশ্বকাপে কোহলির রান হয়ে গেছে ৭১১। তিন সেঞ্চুরির দুটিতেই অপরাজিত বলে গড় ১০০ ছাড়ানো (১০১.৫৭), স্ট্রাইক রেট ৯০.৫০।
আরেকটি রেকর্ডে টেন্ডুলকারের সঙ্গে সাকিবও ছিলেন এত দিন। এক বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি পঞ্চাশোর্ধ রানের ইনিংস খেলার রেকর্ডটিকে ৭ থেকে ৮ বানিয়ে দিয়েছেন কোহলি। গ্যালারিতে তারার মেলার কথা বলছিলাম। তারকা না হতে পারেন, তবে বিরাট কোহলির কাছে গ্যালারির আরেকজন দর্শকের উপস্থিতিরও অনেক বড় তাৎপর্য। যাঁকে তিনিই এই সেমিফাইনাল দেখতে দিল্লি থেকে উড়িয়ে এনেছেন। তাঁর ছেলেবেলার কোচ রাজকুমার শর্মা। সেঞ্চুরি তো আর বলে-কয়ে হয় না। তারপরও কেন যেন মনে হয়, দিনটাকে মনে মনে এভাবেই সাজিয়েছিলেন কোহলি। এ জন্যই হয়তো কোচকেও চেয়েছেন মাঠে।
তা ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরির মালিকের কাছে সেঞ্চুরি তো ডালভাতই হওয়ার কথা। কী বলছেন, বিরাট কোহলিকে এ কথা বলতে যাবেন না যেন! এই সেঞ্চুরিই কেমন সোনার হরিণ হয়ে উঠেছিল, সেই স্মৃতিতে তো একটুও ধুলা পড়েনি এখনো। গত সেপ্টেম্বরের ৮ তারিখে এশিয়া কাপে সেঞ্চুরির পর কোহলির সেই বাঁধভাঙা হাসি কি মনে পড়ছে? যে হাসিতে আনন্দের সঙ্গে একটু অবিশ্বাসও হয়তো মিশে ছিল! অবশেষে আমি আবার সেঞ্চুরি পেয়েছি। ১০২০ দিন পর সেঞ্চুরির দেখা পেলে এমনই তো হওয়ার কথা। সেই দিন থেকে হিসাব করলে ৬৭ দিনের মধ্যে ৪টি সেঞ্চুরি।
এই ওয়াংখেড়েতেই বিশ্বকাপ জয়ের পর শচীন টেন্ডুলকারকে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন কোহলি। পরে যা বলেছিলেন, তা ঢুকে গেছে ক্রিকেটের অমর বাণীগুলোর মধ্যে। এত বছর যে লোকটা ভারতের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন, তাঁকে তো আমাদের কাঁধে তুলে নেওয়াই উচিত। এই ওয়াংখেড়েতেই শেষ টেস্ট খেলার পর আবার সতীর্থদের কাঁধে শচীন টেন্ডুলকার। গ্যালারি থেকে ‘সাচিন–সাচিন’ বলে চিৎকার।
আর এদিন যেখান থেকে কোহলি-কোহলি কোরাস। শুধু সেঞ্চুরির পরই নয়, নিউজিল্যান্ড যখন ব্যাটিং করছে, তখনো। দুই ইনিংসের বিরতির সময় মাঠে দাঁড়িয়ে বিশ্বকাপের অফিশিয়াল সম্প্রচারকারীদের সাক্ষাৎকার দিয়েছেন টেন্ডুলকার। কী বলেছেন, প্রেসবক্স থেকে তা শোনার উপায় ছিল না। তবে মূল কথাটা তো বলে দিয়েছেন এক্সেই। ভারতের ড্রেসিংরুমে প্রথম ঢোকার দিনে ভারতের অন্য খেলোয়াড়েরা মজা করে কোহলিকে দিয়ে শচীন টেন্ডুলকারের পা ছুঁইয়ে ছিলেন। যাতে শচীনও অনেক হেসেছিলেন। সেই কোহলিই দক্ষতা আর নিবেদন দিয়ে পায়ের বদলে তাঁর হৃদয় ছুঁয়ে ফেলেছেন। এসব বলার পর শচীন টেন্ডুলকারের শেষ লাইন—তরুণ সেই ছেলেটা এখন পরিণত ‘বিরাট’ খেলোয়াড়ে।
এত সব রেকর্ডের চেয়েও বিরাট কোহলির কাছে হয়তো এই কথাটার মূল্য বেশি।