মানুষ কি শেষটাই বেশি মনে রাখে! হয়তো তা–ই। তাইজুল ইসলামের হাতে ম্যাচসেরার পুরস্কারকেও কি তাহলে এ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়! সাদা চোখে দেখলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়ে এই বাঁহাতি স্পিনারই কিংস্টন টেস্টে বাংলাদেশের জয়ের নায়ক। যোগ হবে প্রথম ইনিংসের উইকেটও। একটিই উইকেট, তবে সেটি মহামূল্যবান। অ্যান্টিগায় প্রথম টেস্টের সেঞ্চুরিয়ান জাস্টিন গ্রিভসকে যা ২ রানের বেশি করতে দেয়নি।
এ তো শুধু বোলার তাইজুল। তবে তাঁর অবদান তো শুধু বোলিংয়েই শেষ নয়। দুই ইনিংসে রান করেছেন ১৬ আর ১৪। এ আর এমন কী? রানসংখ্যায় হয়তো বড় কিছু নয়, কিন্তু এখানে রানের চেয়েও যে গুরুত্ববহ উইকেটে টিকে থাকার প্রতিজ্ঞা। ৩০ রান করতে বল খেলেছেন ১১৬টি। শেষ দিকে ৪১ আর ৩৪ রানের দুটি জুটি হতে পেরেছে তো এ কারণেই। ম্যাচসেরার স্বীকৃতি তাই তাইজুল পেতেই পারেন।
কিন্তু জাকের আলীও কি সেটি পেতে পারতেন না? ৯১ রানের যে ইনিংসটি খেলেছেন, সাহসে–বীরত্বে–শৌর্যে তা অংশ হয়ে গেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট–রূপকথার। চার–ছয়ের ফুলঝুরি ছুটিয়ে ম্যাচটাকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব তো মাত্র তৃতীয় টেস্ট খেলতে নামা এই ব্যাটসম্যানেরই। চতুর্থ দিন সকালে বাংলাদেশের ৭৫ রানের ৬২–ই তাঁর ব্যাট থেকে। জাকেরের কল্যাণে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৮৭ রানের লক্ষ্য ছুড়ে দিয়েই কি এই টেস্ট জয়ে ফেবারিট হয়ে যায়নি বাংলাদেশ!
কিংস্টনের এই স্যাবাইনা পার্ক অনেক ক্রিকেট ইতিহাসের সাক্ষী। কিন্তু এই মাঠে ২১২ রানের বেশি করে কখনো জেতেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জেতেনি বলে কখনোই জিতবে না, এমন কোনো কথা নেই। রেকর্ড জিনিসটাই ভাঙার জন্য, কিন্তু তা কি প্রতিদিন ভাঙে! ওয়েস্ট ইন্ডিজকে রেকর্ড গড়ার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েই তো বাংলাদেশ বিজয়মঞ্চে এক পা দিয়ে রেখেছে। অবিস্মরণীয় এই ইনিংসের কারণে জাকের আলী কেন তাহলে বাংলাদেশের জয়ের নায়ক নন!
আক্ষরিক অর্থে টেস্টের শেষটা যাঁর হাতে, সেই নাহিদ রানাই–বা কেন নয়! গত পরশু বাংলাদেশ সময় ভোররাতে শামার জোসেফকে বোল্ড করার মাধ্যমে এই ফাস্ট বোলারই সূচনা করেছেন বিজয়োৎসবের। দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁর একটিই উইকেট। তবে এই টেস্টের সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র হয়ে গেছেন তো প্রথম ইনিংসেই।
কিংবদন্তি সব ফাস্ট বোলারের জন্মভূমি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। যাদের ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায় পাতায় গতির ঝড় তোলার আশ্চর্য সব গল্প। এর অনেকগুলোই মঞ্চস্থ হয়েছে কিংস্টনের এই স্যাবাইনা পার্কে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফাস্ট বোলাররা ব্যাটসম্যানদের মাথায়–শরীরে আগুনের গোলা ছুড়ছেন, আর বন্য উল্লাসে ফেটে পড়ছে স্যাবাইনা পার্কের গ্যালারি—ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্বর্ণযুগে সবচেয়ে শিহরণ জাগানো মুহূর্তগুলোর মধ্যে এটাও থাকে।
রোচের কাঁধে দুবার ছোবল দিয়েছে নাহিদ রানার বাউন্সার। যা দেখে বিশপের মতো ক্যারিবীয় সাবেকদের ‘টেস্টিং ইয়োর ওন মেডিসিন’ কথাটা মনে না পড়ে পারেই না।
সেই স্যাবাইনা পার্কেই বাংলাদেশের এক বোলারের গতির ঝড়ে নাস্তানাবুদ ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানরা, উইকেটের সঙ্গে শরীর বাঁচানো নিয়েও যাঁদের ভুগতে হচ্ছে চরম উৎকণ্ঠায়—নাহিদ রানার কল্যাণে এই টেস্টে তা কোনো বিচ্ছিন্ন দৃশ্য হয়ে থাকেনি। যখনই বল হাতে নিয়েছেন, কাঁপিয়ে দিয়েছেন ব্যাটসম্যানদের। এতটাই যে একসময় বিশ্বের দ্রুততম বোলার ইয়ান বিশপ ধারাভাষ্যে প্রশংসার সংকটে পড়ে গেছেন। নাহিদ রানাকে ঘোষণা করে দিয়েছেন বিশ্ব ক্রিকেটেরই ভবিষ্যৎ সুপারস্টার বলে।
মাত্র ১৬৪ রান করেও প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ যে ১৮ রানের লিড নিতে পেরেছে, তা তো নিষ্পাপ মুখের এই তরুণের হানা শক্তিশেলের কারণেই। শক্তিশেলই তো! ৫ উইকেট তো স্কোরকার্ডেই লেখা আছে।
তবে লেখা নেই প্রতিপক্ষের মূল ফাস্ট বোলার কেমার রোচকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুতে অনেকটা সময় বাইরে বসিয়ে রেখে ব্যাটসম্যানদের কাজটা কীভাবে একটু সহজ করে দিয়েছেন। রোচের কাঁধে দুবার ছোবল দিয়েছে নাহিদ রানার বাউন্সার। যা দেখে বিশপের মতো ক্যারিবীয় সাবেকদের ‘টেস্টিং ইয়োর ওন মেডিসিন’ কথাটা মনে না পড়ে পারেই না। দুই ইনিংসে ৬ উইকেটের সঙ্গে ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানদের মনে ভয় ছড়িয়ে দেওয়া নাহিদ রানাও তো এই টেস্টের নায়ক।
এভাবে বললে কথা আসলে শেষ হতে চাইবে না। মেহেদী হাসান মিরাজের কথা আসবে, আসবেন এই টেস্টে সবচেয়ে বেশি রান করা সাদমান ইসলাম, ব্যাটিংয়ে তেমন কিছু করতে না পারলেও দুর্দান্ত কিপিংয়ের কারণে লিটন দাস। নিয়মিত অধিনায়ক নাজমুল হোসেনের চোটের কারণে এই সিরিজে অধিনায়ক মিরাজ।
অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপেও অধিনায়কত্ব করেছেন, তবে টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে তো একেবারেই নতুন। মাত্রই দ্বিতীয় টেস্ট, তার ওপর প্রথম টেস্টে গোহারা হেরেছে দল। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোয় মিরাজের অধিনায়কত্বের ভূমিকা কীভাবে অস্বীকার করবেন! বোলার পরিবর্তন, ফিল্ডিং সাজানোতে মুনসিয়ানা তো চোখে পড়েছেই। বোলিংয়ে মাত্র ১ উইকেট নেওয়ার ‘ব্যর্থতা’ পুষিয়ে দিয়েছেন ব্যাটিংয়ে মাঝারি কিন্তু দারুণ গুরুত্বপূর্ণ দুটি ইনিংস খেলে। বিশেষ করে দ্বিতীয় ইনিংসে ৩৯ বলে ৪২ রানের ইনিংসটা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে চমকে দেওয়ার কাজটাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছে।
মিরাজ এগিয়ে নিয়ে গেছেন মানেই অন্য কেউ তা শুরু করেছেন। শুনতে একটু অদ্ভুতই শোনাবে এই টেস্টের মেজাজটাই বদলে দিয়ে পাল্লাটা বাংলাদেশের দিকে হেলিয়ে দেওয়ার কাজটা করেছে ২৮ রানের ছোট্ট একটা ইনিংস। মুমিনুলের অসুস্থতার কারণে প্রথমবারের মতো ৩ নম্বরে নেমেছেন শাহাদাত। নেমেই ছড়িয়ে দিয়েছেন ইতিবাচকতার বার্তা। যে টেস্টে এর আগে কোনো বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যানের স্ট্রাইক রেট ৫০ ছাড়ায়নি, সেখানে শাহাদাতের ওই ২৮ রান মাত্র ২৬ বলে। ক্রিকেটে রানসংখ্যার চেয়ে রানটা কীভাবে করা হলো, তা যে কখনো কখনো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তার বড় একটা প্রমাণ ১০৭ স্ট্রাইক রেটের ওই ইনিংস।
এ এক আশ্চর্য টেস্ট ম্যাচ! এক জয়ে যেখানে অনেক নায়ক।