১০-২০ ওভারের ক্রিকেট যখন সোনার খনি
একসময় ছিল শুধু টেস্ট ক্রিকেট। এরপর এল ওয়ানডে। তারপর টি-টোয়েন্টি।
ক্রিকেট আরও নানাভাবে খেলা হয়। তবে আপাতত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে স্বীকৃত সংস্করণ এই তিনটাই। এবার টি-টেন ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাওয়া হচ্ছে। বিবিসি জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) কাছে টি-টেনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চেয়েছে সংস্থাটির অন্তত দুটি পূর্ণ সদস্যদেশ। জিম্বাবুয়ের হারারেতে ১০ থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত চলা আইসিসির সর্বশেষ বোর্ড মিটিংয়ে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
যদিও আইসিসি চেয়ারম্যান জয় শাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকের আনুষ্ঠানিক আলোচ্যসূচিতে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল না, তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে এটি উত্থাপন করা হয়েছিল। বলা হচ্ছে, বৈঠকে উপস্থিত বেশির ভাগ সদস্যের কাছ থেকে তেমন সমর্থন পাওয়া যায়নি। তবে যদি ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আরও সমর্থন আসে, তাহলে বিষয়টি আবারও বিবেচনা করা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে হয়তো একসময় ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক সংস্করণ তিনটি থেকে বেড়ে চারটি হবে, টি-টেনের পরিসংখ্যানও যোগ হবে ক্রিকেটারদের আন্তর্জাতিক প্রোফাইলে।
কেন তিনটি সংস্করণ থাকার পরও টি-টেনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা চলছে, তা বোঝা অবশ্য কঠিন কিছু না। এমনিতে এখন বিশ্বের কয়েকটি দেশে টি-টেন লিগ হয়। সেখানে বিভিন্ন দেশের ক্রিকেটাররাও খেলেন। তবে যেহেতু আন্তর্জাতিক সংস্করণ নয়, এর কদর এতটা তৈরি হয়নি এখনো। যখন সেই কদর তৈরি হবে, স্বাভাবিকভাবেই এর প্রসার বাড়বে। আর প্রসার বাড়লে তখন উন্মুক্ত হবে ক্রিকেট বাণিজ্যের নতুন আরও একটি দিগন্ত। যে বাণিজ্য এখন প্রায় পুরোটাই দখল করে রেখেছে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। এর পাশাপাশি যদি টি-টেনেরও উত্থান হয়, তাহলে ১০ ও ২০ ওভারের এই দুই সংস্করণ হয়ে উঠবে ক্রিকেট–সাম্রাজ্যে সোনার খনি।
আইপিএল: ক্রিকেট-অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু
২০ ওভারের ক্রিকেট যে ক্রিকেট-বাণিজ্যে বিশাল এক সোনার খনি হতে পারে, সেটা প্রথম দেখিয়েছিল আইপিএল। ২০০৮ সালে শুরু হওয়া ভারতের এই ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি লিগ ক্রিকেট-ব্যবসাকে একেবারে খোলনলচে বদলে দেয়। ঝলমলে স্টেডিয়াম, নিলাম, বড় বড় স্পনসর প্রতিষ্ঠান, সিনেমার তারকার উপস্থিতি, বিদেশি ক্রিকেটার—সব মিলে এক দুর্দান্ত প্যাকেজ। সেই প্যাকেজ দর্শক লুফে নেন। শুরু হয় কোটি কোটি টাকার খেলা।
যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক স্বতন্ত্র বিনিয়োগ ব্যাংক এবং আর্থিক পরিষেবা প্রতিষ্ঠান হৌলিহান লোকির একটি গবেষণা অনুসারে, ২০২৪ সাল পর্যন্ত আইপিএলের মোট মূল্য ১ হাজার ৬৪০ কোটি মার্কিন ডলার। সর্বশেষ এর প্রচারস্বত্ব বিক্রি হয়েছে ৬০২ কোটি ডলারে। আইপিএলের প্রতি ম্যাচ থেকে এখন গড় আয় প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (শীর্ষে আমেরিকার এনএফএল)। টাটা গ্রুপ ২০২৪ থেকে ২০২৮ পর্যন্ত আইপিএলের টাইটেল স্পনসর, যারা প্রতিবছরের জন্য দিচ্ছে ৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার করে।
আইপিএলের সাফল্য দেখেই দেশে দেশে শুরু হয়েছে ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি লিগ। বিনিয়োগকারীরাও যথেষ্ট আগ্রহ দেখাচ্ছেন সেসব ফ্র্যাঞ্চাইজিতে টাকা ঢালতে। প্রতিষ্ঠিত আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকেরা এই অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সঙ্গে যোগ হয়েছেন টেক-বিলিয়নিয়ার এবং বলিউড তারকাসহ নতুন অনেক বিনিয়োগকারীও।
ভারত ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে
আইপিএলের দলগুলোর মালিকেরা এখন তাঁদের এই ব্যবসা শুধুই ভারতেই সীমাবদ্ধ রাখছেন না। দক্ষিণ আফ্রিকা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইংল্যান্ড ও আমেরিকার ক্রিকেট লিগে দল কিনেছেন তাঁদের অনেকে। মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের মালিক আম্বানি পরিবারের রিলায়েন্স গ্রুপ সম্প্রতি ইংল্যান্ডের টি-টেন লিগে ওভাল ইনভিনসিবলসের ৪৯ ভাগ মালিকানা কিনেছে ৭ কোটি ৪০ লাখ ডলারে। এ ছাড়া গ্রুপটির মালিকানায় দল আছে দক্ষিণ আফ্রিকার এসএ টি-টোয়েন্টি (এমআই কেপটাউন), সংযুক্ত আরব আমিরাতের আইএল টি-টোয়েন্টি (এমআই এমিরেটস) এবং যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ ক্রিকেটে (এমআই নিউইয়র্ক)।
কলকাতা নাইট রাইডার্সের মালিকপক্ষের দল আছে ক্যারিবিয়ান সুপার লিগ (ত্রিনবাগো নাইট রাইডার্স), আইএল টি–টোয়েন্টি (আবুধাবি নাইট রাইডার্স) ও মেজর লিগ ক্রিকেটে (লস অ্যাঞ্জেলেস নাইট রাইডার্স)। লক্ষ্ণৌ সুপার জায়ান্টসের মালিক প্রতিষ্ঠান আরপিএসজি কিনেছে ইংল্যান্ডের হান্ড্রেড লিগে ম্যানচেস্টার অরিজিনালসের ৭০ ভাগ মালিকানা, পাশাপাশি এসএ টি-টোয়েন্টির ডারবান সুপার জায়ান্টস ফ্র্যাঞ্চাইজি। সানরাইজার্স হায়দরাবাদের মালিক সান গ্রুপ ১২ কোটি ৫০ লাখ ডলারে কিনেছে হান্ড্রেডের নর্দার্ন সুপারচার্জার্স। এ ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকায় সানরাইজার্স ইস্টার্ন ক্যাপ নামেও দল আছে তাদের। দিল্লি ক্যাপিটালসের সহ-মালিক জিএমআর গ্রুপ হ্যাম্পশায়ারে বিনিয়োগ করেছে ১৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার। সংযুক্ত আরব আমিরাতে তাদের মালিকানায় আছে দুবাই ক্যাপিটালস।
আসছেন নতুন বিনিয়োগকারীরাও
১০ ওভার, ২০ ওভার ও ১০০ বলের ক্রিকেটের বাণিজ্যিক সম্ভাবনায় আকৃষ্ট হচ্ছেন বিশ্বের বড় বড় কোটিপতিও। গুগলের প্রধান নির্বাহী সুন্দর পিচাই এবং মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহী সত্য নাদেলার নেতৃত্বাধীন একটি বিলিয়নিয়ার প্রযুক্তি কনসোর্টিয়াম ১৮ কোটি ডলারে হান্ড্রেডের দল লন্ডন স্পিরিটের ৪৯ ভাগ মালিকানা কিনেছে।
এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৮৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হচ্ছে একটি পেশাদার ক্রিকেট লিগ প্রতিষ্ঠার জন্য। স্টেডিয়াম এবং প্রশিক্ষণ সুবিধা বিকাশের জন্য মেজর লিগ এরই মধ্যে সত্য নাদেলা এবং রস পেরোট জুনিয়রের মতো বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ১২ কোটি ডলার তহবিল পেয়েছে। ১২৮ বছর পর ২০২৮ সালে লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে ক্রিকেটের প্রত্যাবর্তন এই বৈশ্বিক প্রসারকে আরও ত্বরান্বিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ইউরোপে ক্রিকেট: নতুন সম্ভাবনা
এরই মধ্যে ইউরোপ প্রস্তুত হচ্ছে নিজস্ব টি-টোয়েন্টি যুগে প্রবেশের জন্য। আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসকে নিয়ে গঠিত ইউরোপিয়ান টি-টোয়েন্টি প্রিমিয়ার লিগের উদ্বোধনী আসর বসবে এ বছর জুলাইয়ে। বলিউড অভিনেতা অভিষেক বচ্চন এই লিগে ফ্র্যাঞ্চাইজি কিনেছেন। এই টুর্নামেন্টটা সফল হলে ইউরোপে খুলে যেতে পারে ক্রিকেট–বাণিজ্যের নতুন দুয়ার।
সৌদি আরব: ক্রিকেটের পরবর্তী গন্তব্য
নতুন বাজার হিসেবে সৌদি আরবও এখন আলোচনার কেন্দ্রে। গত বছর নভেম্বরেই সেখানে হয়েছে আইপিএল নিলাম। বিশাল বিনিয়োগ, পেট্রো-ডলারের অর্থনীতি আর বৈশ্বিক ক্রীড়াকেন্দ্র হয়ে ওঠার কৌশলে এগোচ্ছে সৌদি আরব। এরই মধ্যে নিজস্ব টি-টোয়েন্টি লিগ আয়োজনের চেষ্টা শুরু করেছে তারা। এতে যদি সফল হয় সৌদি আরব, তখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি হয়ে উঠতে পারে ক্রিকেটের নতুন বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য।