টেস্ট ক্রিকেট এমন কিছু আর দেখেনি। কথাটা অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে। ১৪৭ বছর ধরে টেস্ট ক্রিকেট হচ্ছে, এর কতটুকুই বা জানি, কতটুকুই বা দেখেছি! তারপরও প্রশ্নটা মনে জাগছেই—ম্যাচের প্রথম দিনে স্যাম কনস্টাসের মতো কিছু কি আগে কখনো দেখেছে টেস্ট ক্রিকেট!
ম্যাচের প্রথম বলেই কোনো ব্যাটসম্যান ছক্কা মেরে দিচ্ছেন—এটা দেখেছে। দেখেছে একবারই। সৌভাগ্যই বলতে হবে, মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে সেই টেস্টেই অভিষিক্ত অফ স্পিনার সোহাগ গাজীর বলে ক্রিস গেইলের সেই ছক্কা প্রেসবক্সে বসে দেখেছি। কিন্তু এটাও কি মনে করিয়ে দেওয়া উচিত নয়, সেটি ছিল স্বঘোষিত ‘ইউনিভার্স বস’ ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বাঁহাতির ৯৪তম টেস্ট। আর এখানে যাঁকে নিয়ে কথা হচ্ছে, সেই স্যাম কনস্টাসের এটি টেস্ট অভিষেক। বয়স মাত্র ১৯ বছর ৮৫ দিন। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে এর চেয়ে কম বয়সে টেস্ট খেলতে নেমেছেন মাত্র তিনজন। যাদের কেউই ওপেনার ছিলেন না। তর্কযোগ্যভাবে সেই সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে ভীতিপ্রদ বোলারের মুখোমুখি হওয়ার তাই প্রশ্নই ওঠে না।
দিনের খেলা শেষ হতে হতে এমসিজিতে বক্সিং ডে টেস্ট শুরুর দিনের দর্শক সংখ্যা প্রায় ৯০ হাজার ছুঁয়েছে। কনস্টাস-প্রদর্শনীর সময় যা ৭৬ হাজারের মতো। বিস্ময়ে হতবাক, আনন্দে অভিভূত সেই ৭৬ হাজার যখন উঠে দাঁড়িয়ে করতালিতে চারপাশ মুখরিত করে তুলেছে, স্যাম কনস্টাস তখন ফিরে আসছেন ৬৫ বলে ৬০ রানের অবিশ্বাস্য এক ইনিংস খেলে। অভিষেক টেস্টে ইনিংসের প্রথম বলটি খেলেছেন, এমন ওপেনারদের কেউ এর আগে কনস্টাসের মতো ৯২.৩০ স্ট্রাইক রেটে রান করতে পারেননি। বিশ্ব রেকর্ড, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। তবে স্যাম কনস্টাস ধূমকেতুর মতো টেস্ট ক্রিকেটে আবির্ভূত হলেন, জন্ম হলো নতুন এক তারকার—এসব বলার কারণ শুধু এই রেকর্ড নয়। আসল কারণ ঔদ্ধত্যের রূপ নেওয়া তাঁর সাহস, অভাবনীয় সব শট, বয়সের সঙ্গে বেমানান আত্মবিশ্বাস...। এসব মিলিয়েই আজ সকালের স্যাম কনস্টাস মেলবোর্নে বক্সিং ডে টেস্টের দীর্ঘ ইতিহাসে রূপকথার মতো এমন এক গল্প, যার কোনো তুলনা খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
শীতের ভোরে ঘুম থেকে ওঠার কষ্ট করে না থাকলে কনস্টাসের ইনিংসের হাইলাইটস তো আছেই। কিন্তু এখানে একটু সমস্যা আছে। হাইলাইটস দেখে আপনি আজকের সকালের স্যাম কনস্টাসের সামান্যই বুঝতে পারবেন। হ্যাঁ, তা দেখেও আপনার বিস্ময় জাগবে। এই ছেলে করছে কি, যশপ্রীত বুমরাকে এই স্কুপ মারছে, এই রিভার্স স্কুপ! বুমরার এক ওভারে ১৪ রান নিয়ে নিচ্ছে, একটু পরই ১৮ রান—ক্যারিয়ারেই বুমরার যে অভিজ্ঞতা আগে কখনো হয়নি। স্কুপ-রিভার্স স্কুপ দেখে মনে বিস্ময় জাগবে, টেস্টের প্রথম দিন সকালে কি এভাবে ব্যাটিং করা যায়! বুমরাকে অমন পাড়ার বোলারের পর্যায়ে নামিয়ে আনতে দেখে সংশয় জাগবে, এই ছেলে কি প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেছে! বয়স কি আসলেই ১৯, এই টেস্টের আগে যাঁর মাত্র ১১টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা!
তারপরও কেন বলছি, শুধু হাইলাইটস দেখে আপনি আজ সকালের স্যাম কনস্টাসের কিছুই বুঝবেন না! কেন বলছি, বুঝবেন শুধু তাঁরাই, যাঁরা এমসিজির গ্যালারিতে বসে বা টেলিভিশনের পর্দায় এই রোমাঞ্চকর গল্পটার প্রত্যক্ষদর্শী। কারণ তাঁরাই যে শুধু বলতে পারবেন, প্রথম ২১ বলে কেমন নবিশ মনে হয়েছিল স্যাম কনস্টাসকে। বলতে পারবেন, বুমরার প্রথম ওভারেই বুমরা তাঁকে কীভাবে নাচিয়ে ছেড়েছেন! ওই ওভারের ছয় বলে চারবার ’বিট’ হয়েছেন। আউট যে হননি, তা শুধুই ভাগ্যদেবী মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন বলে। ম্যাচের আগে কনস্টাসের বড় বড় কথাকে তখন যদি কারও আত্মবিশ্বাসের বদলে বাগাড়ম্বর মনে হয়ে থাকে, তা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।
বুমরার দ্বিতীয় ওভারেই যখন রিভার্স স্কুপ করতে গিয়ে পারলেন না, তখন এটা মনে হওয়াও খুব স্বাভাবিক ছিল যে, টেস্ট ক্রিকেটের বিষম চাপই তাঁকে দিয়ে অমন উল্টোপাল্টা শট খেলাচ্ছে। টি-টোয়েন্টি অধ্যুষিত ক্রিকেটের এই আধুনিক সময়ে টেস্টেও এখন কোনো শটই আর নিষিদ্ধ নয়। তাই বলে টেস্ট জীবনের ১১তম বলেই কেউ রিভার্স স্কুপ করতে যায় নাকি, তা-ও আবার যশপ্রীত বুমরার বলে! যে বুমরা সিরিজের আগের তিন টেস্টে দুর্বিষহ করে তুলেছেন অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানদের জীবন। যাঁর জায়গায় কনস্টাসের দলে আসা, সেই নাথান ম্যাকসুয়েনির টেস্ট ক্যারিয়ার শুরু হতে না হতেই থমকে যাওয়ার কারণও তো বল হাতে ওই আততায়ীই। বুমরার ৬৬ বল খেলে রান নিতে পেরেছেন মাত্র ১৫, আউট হয়েছেন চারবার। ম্যাকসুয়েনি তো নিতান্তই নবীন, উসমান খাজা-মারনাশ লাবুশেনের মতো অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ ব্যাটসম্যানদের জন্যও তো দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দিয়েছেন বুমরা।
দুবার স্কুপ মারতে গিয়ে পারেননি। এরপর তো আর সেই চেষ্টাই করা উচিত নয়। কিন্তু উচিত-অনুচিতের প্রচলিত ধারণাকেই যে ভেঙে দিতে চেয়েছেন কনস্টাস। বুমরার চতুর্থ ওভারের প্রথম দুই বলে তাই আবারও স্কুপ আর রিভার্স স্কুপ এবং তাতে চার আর ছয়। সেই ওভারে ১৪ রান। শুধু অপ্রথাগত শটই নয়, ক্রিকেটিং শটও যে তাঁর হাতে যথেষ্টই আছে—এরও তো প্রমাণ দিতে হবে। বুমরার ষষ্ঠ ওভারে তাই নির্ভেজাল ক্রিকেটিং শট খেলেই এক ছক্কা ও দুই চার—ওভারে মোট রান ১৮। কনস্টাসের নামের পাশে তখন ৪৪ বলে ৪৫ রান। প্রথম ২১ বলের হিসাবটা মনে আছে তো! তাহলে হয়তো এটাও হিসাব করে ফেলেছেন, ওই ৪৫ রানের শেষ ৪০ রান এসেছে মাত্র ২৩ বলে।
মেলবোর্নে বক্সিং ডে টেস্টের প্রথম দিন আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের কথা উঠলে অবধারিতভাবে মনে পড়বে বীরেন্দর শেবাগকে। ২০০৩ সালে এমসিজিতে প্রথম দিনেই ১৯৫ রান করে ফেলেছিলেন শেবাগ। ছক্কা মেরে ডাবল সেঞ্চুরি করতে চেয়ে ক্যাচ দিয়েছিলেন সীমানায়। তবে প্রথম বলে গেইলের ছক্কা প্রসঙ্গে বলা কথাটা বলতে হচ্ছে এখানেও, সেটি তো আর টেস্ট ক্রিকেটে শেবাগের প্রথম দিন ছিল না। যত দুর মনে পড়ে কনস্টাসের মতো স্কুপ বা র্যাম্পও মারতে যাননি। শেবাগকে ভালোই চিনত বলে অস্ট্রেলিয়া দল ওই রুদ্ররূপে চমকেও যায়নি। ভারতীয় দল যেখানে অবশ্যই হকচকিয়ে গেছে স্যাম কনস্টাসে। বিরাট কোহলির তাঁকে ধাক্কা দিয়ে বসাটাও হয়তো ওই কারণেই। তাতে যদি প্রথম টেস্ট খেলতে নামা বাচ্চা ছেলেটাকে একটু এলোমেলো করে দেওয়া যায়! কিসের কি, উল্টো তাঁর প্রিয় ভারতীয় ক্রিকেটার বিরাট কোহলির চোখে চোখ রেখে দাঁড়াবেন কনস্টাস। এর চেয়েও বেশি চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা হবে, আউট হওয়ার পর যখন একটা টিভিকে বলবেন, ‘মাঠে যা হয়েছে, তা মাঠে ফেলে আসাই ভালো।’
আসলেই কি এটা টেস্ট ক্রিকেটে স্যাম কনস্টাসের প্রথম দিন ছিল! আসলেই কি তাঁর বয়স ১৯! ধন্দটা দেখি যাচ্ছেই না!
সংক্ষিপ্ত স্কোর
অস্ট্রেলিয়া: ৮৬ ওভারে ৩১১/৬ (কনস্টাস ৬০, খাজা ৫৭, লাবুশেন ৭২, স্মিথ ৬৮*, হেড ০, মার্শ ৪, ক্যারি ৩১, কামিন্স ৮*; বুমরা ৩/৭৫, ওয়াশিংটন ১/৩৭, জাদেজা ১/৫৪, আকাশ ১/৫৯, সিরাজ ০/৬৯, নীতিশ ০/১০)।—প্রথম দিন শেষে।