মার্করাম: মাঝি বাইয়া যাও রে...

এইডেন মার্করামের হাত ধরে প্রোটিয়ারা ফাইনালেইনস্টাগ্রাম

তিন শব্দে নিজেকে বর্ণনা করা কঠিন। আর বয়স যদি হয় ১৯, তবে সেটা রীতিমতো দুঃসাধ্য। উত্তাল সাগরের জোয়ারের মতো সে বয়সে কোনো কিছু গুছিয়ে বলাটাই যেখানে বিস্ময়কর, সেখানে নিজেকে তিন শব্দে বর্ণনা?

উনিশের এইডেন মার্করাম এই প্রশ্ন শুনে বলতে পারতেন, ‘ভুল দরজায় কড়া নেড়েছেন ভাই। দয়া করে একটু বয়স্ক মানুষের কাছে যান, তাঁরা ভালো বলতে পারবেন।’ কিন্তু সে সময় মার্করামের এটুকু বলার সুযোগ ছিল না। প্রশ্নটি যে আইসিসির পক্ষ থেকে, অতটুকু মার্করামের ঘাড়ে কয়টা মাথা, যে মুখের কপাটে খিল দেবেন!

সেটা ২০১৪ সালের গল্প। ২০১৪ অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপ তখনো শুরু হয়নি। ছোটদের সেই বিশ্বকাপেই দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রথমবার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মার্করাম। তার আগে আইসিসি প্রকাশিত ভিডিওতে মার্করামের সামনে নিজেকে তিন শব্দে বর্ণনার সেই কঠিন প্রশ্নই ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দর্শনে মোড়ানো এই কঠিন প্রশ্ন তো সবার জন্যই কঠিন নয়। জীবনকে কেউ কেউ অল্প বয়সে বুঝে নেন কিংবা বুঝে ফেলেন। মার্করামের উত্তর ছিল—ইতিবাচক, আত্মবিশ্বাসী ও দায়িত্ববান।

আরও পড়ুন

উনিশ বছরের কোনো কিশোরের মুখে তখন এই ভারী তিনটি শব্দ শুনে কেউ কেউ হয়তো হেসেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকা সেবার অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপ জয়ের পর সেই হাসি থাকেনি যদিও। দক্ষিণ আফ্রিকা এবার টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার পর অবশ্য সে হাসি ফিরেও এসেছে কারও কারও মুখে অন্য অর্থ নিয়ে।

২০১৪ অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপ চলাকালীন মার্করাম (বাঁয়ে)
আইসিসি

১০ বছর আগে যে ছেলেটি নিজেকে ইতিবাচক, আত্মবিশ্বাসী ও দায়িত্ববান বলেছিল, সে শুধু ছোটদের বিশ্বকাপই জেতায়নি, বড় হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে প্রথমবারের মতো তুলেছে বড়দের বিশ্বকাপের ফাইনালেও। হয়েছেন প্রোটিয়া–নৌকার শক্ত হাতে হাল ধরা মাঝি। দক্ষিণ আফ্রিকার অন্য অধিনায়কেরা যে ওই তিনটি শব্দ ধারণ করেননি, তা নয়। কিন্তু শব্দগুলোকে মাঠে সাফল্যে অনূদিত করতে পারলেন শুধু মার্করামই।

এক দশক পর সেই মার্করামের হাত ধরেই বড়দের বিশ্বকাপ ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকা। এবারও মার্করামের দল কিন্তু এক ম্যাচেও হারেনি।

১৯৯৮ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জয়ের পর আইসিসি ইভেন্টে দক্ষিণ আফ্রিকার অর্জন ছিল শূন্য। এটা অবশ্য ট্রফির হিসাবে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকা বড় দল, সেটা এমনিতেই সবার জানা। তবে আইসিসির ইভেন্টে তাদের ভালো ক্রিকেটের দৌড় ছিল সর্বোচ্চ সেমিফাইনাল পর্যন্ত। অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে একবার দক্ষিণ আফ্রিকা খেলেছিল বটে। ২০০৮ সালের সে ফাইনালে ভারতের কাছে ডিএল পদ্ধতিতে ১২ রানে হেরেছিল। মার্করাম সেই হতাশার ধারা ভেঙে ২০১৪ সালে জিতিয়েছেন অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপ। সেটাও অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। অধিনায়কত্ব আর ব্যাট হাতে ৩৭০ রান করে সিরিজ সেরাও হয়েছিলেন এই মার্করামই।

আরও পড়ুন

এক দশক পর সেই মার্করামের হাত ধরেই বড়দের বিশ্বকাপ ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকা। এবারও মার্করামের দল কিন্তু এক ম্যাচেও হারেনি। ফাইনালে ওঠার পথে জিতেছে টানা ৮ ম্যাচে। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, আফগানিস্তানের বিপক্ষে সেমিফাইনালের আগে প্রায় প্রতি ম্যাচেই অনেকটা হারতে হারতে জিতেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। ব্যাপারটি একটু কেমন না! গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে চাপের মুখে দক্ষিণ আফ্রিকা ভেঙে পড়বে, স্নায়ুযুদ্ধে হেরে যাবে—এমন দক্ষিণ আফ্রিকাকেই তো সবাই চেনেন।

সেটা শন পোলক, গ্রায়েম স্মিথ কিংবা এবি ডি ভিলিয়ার্সের দল হোক—দলের মূল চরিত্র তো এমনই। এই নামগুলোর চেয়ে মার্করাম অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত, কিন্তু কাজের কাজটা ঠিকই করে দিলেন। দলকে শুধু ফাইনালেই তোলেননি, এই পথে স্নায়ুযুদ্ধও জিততে শিখিয়েছেন।

টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওঠার পথে দক্ষিণ আফ্রিকাকে খেলতে হয়েছে কয়েকটি ‘ফাইনাল’
এএফপি

এবার টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওঠার পথে দক্ষিণ আফ্রিকাকে খেলতে হয়েছে কয়েকটি ‘ফাইনাল’। সুপার এইটে ইংল্যান্ড কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে হেরে গেলে সেমিফাইনাল পর্যন্ত আসা কঠিন হয় যেত। গ্রুপ পর্বে ৪ ম্যাচ জিতলেও কঠিন লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তাদের। এমনকি সেটা নেপালের মতো দলের বিপক্ষেও! কিন্তু চমক অপেক্ষা করছিল সেমিফাইনালে।

এই মঞ্চেই সবচেয়ে বেশি ভুগেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। ওয়ানডে বিশ্বকাপে পাঁচবার, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দুবার—সাত সাতটি সেমিফাইনালে ব্যর্থ হওয়ার দগদগে ঘা নিয়ে খেলতে নামা দক্ষিণ আফ্রিকা ফাইনালে ওঠার পথে কিছু টেরই পেল না! ৯ উইকেটের জয়ে বল বাকি ছিল ৬৭টি, এর চেয়ে বেশি বল বাকি রেখে দক্ষিণ আফ্রিকা এর আগে টি-টোয়েন্টি জেতেনি।

আরও পড়ুন

মার্করামের দল আরেকটি রেকর্ডও গড়েছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে সর্বোচ্চ টানা ৮টি জয়ের রেকর্ড এখন দক্ষিণ আফ্রিকার। আগের সাতবারে যা হয়নি, মার্করাম সেটা করেছেন প্রথমবার বিশ্বকাপে নেতৃত্ব দিয়েই। কিন্তু এটাও খুব বড় চমক মনে হবে না যদি পরেরটি শোনেন। মার্করাম এখন পর্যন্ত কোনো পর্যায়ের বিশ্বকাপেই অধিনায়ক হিসেবে ম্যাচ হারেননি! তিনি ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে টেম্বা বাভুমার চোটে ২ ম্যাচে নেতৃত্ব দেওয়াসহ বিশ্বকাপে মোট ১৬টি ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছেন। হার নেই একটিও! আরেকটি তথ্যও জানিয়ে রাখতে হচ্ছে। দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া টুর্নামেন্ট এসএ টি–টোয়েন্টি এখন পর্যন্ত হয়েছে দুবার। দুটি আসরেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সানরাইজার্স ইস্টার্ন কেপ। যে দলটির নেতৃত্বে ছিলেন সেই মার্করামই।

আফগানিস্তানের বিপক্ষে ২৩ রান করার পথে মার্করাম
এএফপি

কিন্তু মার্করামের কাছে নিজের সাফল্য নয়, দলই আগেই। এবার ফাইনালে উঠে যেমন বলেছেন, ‘খুব ভালো লাগছে। শুধু অধিনায়কই আপনাকে এখানে নিয়ে আসেনি। এর পেছনে পুরো স্কোয়াডের অবদান আছে। পর্দার আড়ালেও অনেকে কষ্ট করছে।’
মার্করামকে যিনি তুলে এনেছেন, সেই কোচ রেমন্ড জেনিংস তেমন আড়ালেরই মানুষ।

২০১৪ অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপের আগে খেলা সর্বশেষ সিরিজে ৫ ইনিংসে মাত্র ৭৩ রান করেন মার্করাম। বিশ্বকাপে দলে থাকবেন কি না তা নিয়ে যখন শঙ্কায় ছিলেন, সেই মুহূর্তে খবর পেলেন দলে তিনি তো আছেনই, অধিনায়কের দায়িত্বও পালন করতে হবে! মার্করাম সেবার দলকে ফাইনালে তোলার পর জেনিংস বলেছিলেন, ‘আমার চোখ আমাকে মিথ্যা বলে না। ও যেভাবে পারফর্ম করেছে, সেটা অবিশ্বাস্য। মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার সময় ওর মধ্যে নিশ্চয়ই পরিপক্বতা দেখেছেন। খেলাও পরিপক্ক, ড্রেসিংরুমে সে আমার কাছে সম্মানীয়। ওর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা এক অবিশ্বাস্য নেতা পেয়েছে।’

দক্ষিণ আফ্রিকা আইসিসির একটি ইভেন্টের ফাইনালে উঠেছে—সেটি বিশ্বাস করলে মার্করাম অবশ্যই অবিশ্বাস্য।

আরও পড়ুন