ছক্কায় ছক্কায় নতুন সাকিব
সাকিব আল হাসান—দেশসেরা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটার। বিষয়টি এতটাই স্পষ্ট যে ভদ্রতা করে ‘তর্কসাপেক্ষে’ শব্দ যোগ করারও দরকার নেই। সাকিব দেশসেরা বটে, তবে বিশ্বসেরা কী? টি-টোয়েন্টিতে আইসিসির অলরাউন্ডার র্যাঙ্কিংয়ে সাকিব এখনো শীর্ষে। সে হিসাবে তাঁকে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের স্বীকৃতি দেওয়াই যায়। তবে বাস্তবতা কিছুটা ভিন্ন।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটই এখন ক্রিকেটের সব নয়। আলোচনার একটা অংশ ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের জন্যও রাখতে হয়। সেই আলোচনায় সাকিব কোথায় থাকেন? খুব বেশি কি ওপরে থাকেন? বোধ হয় না। তখন সেরা অলরাউন্ডারদের আলোচনায় সাকিবের আগে নাম আসে আন্দ্রে রাসেল, মঈন আলীদের। কেন?
রাসেল কিংবা মঈন বোলার হিসেবে কেউই সাকিবের চেয়ে ভালো নয়। নতুন বল, পুরোনো বলে ম্যাচের যেকোনো পর্যায়ে বল করার মতো বোলার সাকিবের মতো কমই আছে ক্রিকেট–বিশ্বে। মূলত পার্থক্যটা হয় এক জায়গায়—পাওয়ার হিটিং, স্ট্রাইক রেট। সাকিবের চেয়ে যেখানে তারা অনেক এগিয়ে।
২০১৪ সালের আইপিএলের কথা মনে করে দেখুন। সাকিব, রাসেল দুজনেই সেবার আইপিএলে কলকাতা দলে ছিলেন। স্কোয়াডে রাসেল থাকা সত্ত্বেও সেই মৌসুমে তাঁর আগে একাদশে সুযোগ পেয়েছিলেন সাকিব। সেবার ব্যাট হাতে ১৪৯.৩৩ স্ট্রাইক রেটে ২২৭ রান ও ১১ উইকেট নিয়ে কলকাতাকে শিরোপা জেতাতে বড় ভূমিকা রাখেন সাকিব। রাসেল সেবার ম্যাচ খেলতে পেরেছিলেন মাত্র দুটি। এমন অলরাউন্ড পারফরম্যান্স করার পরও পরের মৌসুমগুলোতে সাকিব নন, একাদশে জায়গা পাওয়ার দৌড়ে রাসেল ছিলেন এগিয়ে।
শুধু সাকিবের চেয়েই এগিয়ে ছিলেন না, একাদশেও সবার আগে রাসেলের নামটাই সম্ভবত লেখা হতো। কারণ, তাঁর স্ট্রাইক রেট। ২০১৪ সালের পরের চার মৌসুমে রাসেলের স্ট্রাইক রেট যথাক্রমে কত জানেন? ১৯২.৯০, ১৬৪.৯১, ১৮৪.৮০, ২০৪.৮২। সেই মৌসুমের পর রাসেলের সবচেয়ে বাজে স্ট্রাইক রেট ছিল ২০২০ সালে। সেটাও ১৪৪.৪৪। স্বাভাবিকভাবেই কলকাতা ধরে নিয়েছে, সাকিবের চেয়ে অলরাউন্ডার রাসেলই তাদের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেটা কলকাতার দুটি শিরোপা জয়ে সাকিব বড় ভূমিকা রাখার পরও।
সাকিব এই সত্য দেরিতে হলেও অনুধাবন করেছেন, আরও স্পষ্ট করে বললে ২০২১ সালের পর থেকে। হয়তো আগে থেকেই চেষ্টা চালিয়ে গেছেন, ফল পাচ্ছেন কয়েক বছর ধরে। পরিসংখ্যান কী বলছে, দেখুন। ২০২১ সালে স্বীকৃত টি-টোয়েন্টিতে সাকিবের স্ট্রাইক রেট ছিল ৩১ ইনিংসে ১০৬.৪৬। পরের বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩৬.৬৫, খেলেছিলেন ৩২ ইনিংস। ২০২৩ সালে ২৯ ইনিংসে সাকিব রান করেছেন ১৪৮.৪ স্ট্রাইক রেটে।
চোখের সমস্যার কারণে চলতি বছরটা সাকিবের জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এবারের বিপিএলে প্রথম ৫ ম্যাচে সাকিবের মোট রান ছিল মাত্র ৪। এই ৫ ম্যাচের মধ্যে দুই ম্যাচে ব্যাটিংয়েই নামেননি, একটি ম্যাচে তো ৮ উইকেট যাওয়ার পরও না। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে এবারের বিপিএলে সাকিবের রান এখন ২৪৯। স্ট্রাইক রেট ১৬৮.২৪।
এ বছর সাকিবের বিপিএলের বাইরে আর টি-টোয়েন্টি খেলেননি। ২০১১ সাল থেকে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলা সাকিব এর আগেও ভালো স্ট্রাইক রেটে রান করেছেন। যেমন ২০১৪ সাল। সেই বছর ২২ ইনিংসে তাঁর স্ট্রাইক রেট ছিল ১৪০ ছুঁইছুঁই। তবে টি-টোয়েন্টিতে ধারাবাহিকভাবে দুর্দান্ত স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করা ধরলে সেটির শুরু ২০২২ সাল থেকেই।
টি-টোয়েন্টিতে ভালো পাওয়ার হিটার বিচার করার সহজ একটা মানদণ্ড আছে। কে কত ছক্কা মারতে পারেন। এবারের বিপিএলের কথাই চিন্তা ধরুন। রংপুরের হয়ে এবার টুর্নামেন্টের ষষ্ঠ ম্যাচে এসে প্রথম ছক্কা মেরেছেন সাকিব। ১১ ম্যাচ শেষে সেই সাকিবের ছক্কা এখন ১৪টি। ১১ ম্যাচ খেলে তামিম ইকবাল ছক্কা মেরেছেন ১২টি, মুশফিকুর রহিম ১০টি। ফিনিশারের ভূমিকায় খেলা মাহমুদউল্লাহর ছক্কাসংখ্যা ১১ ম্যাচে ১১টি।
অথচ সব মিলিয়ে ক্রিস গেইলের পরই বিপিএলে সর্বোচ্চ ছক্কার মালিক তামিম। এর পরের নামটা মুশফিকের। এই তালিকায় ইমরুল কায়েস, মাহমুদউল্লাহর নামটাও সাকিবের আগেই আছে।
বিপিএলের গত আসরেও স্ট্রাইক রেটে সাকিবের ধারেকাছে কেউ ছিলেন না। তা ছিল ১৭৪. ৪১— অন্তত ৫ ইনিংস ব্যাট করেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ছক্কা মেরেছিলেন ২২টি, বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। আর এবার মূলত বোলার হিসেবে টুর্নামেন্ট শুরু করার পরও ১৪টি ছক্কা মেরে ফেলেছেন। বোঝাই যাচ্ছে, পাওয়ার হিটিংয়ে সাকিবের গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী! কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সাকিব কি একটু দেরি করেই ফেললেন? বয়স যে আগামী মার্চেই ৩৭ হয়ে যাচ্ছে!