শুধু লারার গল্প শুনেই ফিরতে হলো সাকিবদের

অ্যান্টিগার ঐতিহ্যবাহী রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডে অনুশীলনে নামার প্রস্তুতি বাংলাদেশ দলের। তবে শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি অনুশীলন হতে দেয়নিবিসিবি

বৃষ্টিকে দোষ দেওয়া ঠিক নয়। যখন তার আসার কথা, সে তো তখনই আসছে। অ্যান্টিগায় বর্ষাকাল শুরু হয় জুনের মাঝামাঝি। তা বৃষ্টি তো আর একেবারে পঞ্জিকা দেখে আসবে না। এবার একটু আগেভাগেই এসে পড়েছে, এই যা!

জুনের শুরু থেকেই অ্যান্টিগায় বৃষ্টি হচ্ছে। গত কয়েক দিন বলতে গেলে একদিনও বিরতি ছাড়া। এখানে ইংল্যান্ড-নামিবিয়া ম্যাচে বৃষ্টি কেমন রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা করিয়েছে, এটা তো আপনি জানেনই। সোমবার বিকালে সেন্ট ভিনসেন্ট থেকে অ্যান্টিগায় নামার পরই রাস্তার পাশে পানি জমে থাকতে দেখলাম। জলি বিচ রিসোর্টে এসে আরও ভালোভাবে বোঝা গেল সেই বৃষ্টির তীব্রতা। সাগরের পাশে এই রিসোর্টের চারপাশে ঘাসে ঢাকা লন। অনেক জায়গায়ই পানি জমে আছে।

আরও পড়ুন

বৃষ্টি হয়েছে আজও। যা অ্যান্টিগায় বাংলাদেশ দলের প্রথম প্র্যাকটিস সেশনটা শুরু হতেই দিল না। সকালে বৃষ্টি হওয়ার পরও দল চলে গিয়েছিল মাঠে। কথা ছিল, সকালে নেটে ব্যাটিং-বোলিং হবে, সন্ধ্যায় ফ্লাডলাইটের নিচে ফিল্ডিং প্র্যাকটিস। সকালের নেট তো গেছে; এখন সন্ধ্যায় ফিল্ডিং প্র্যাকটিসটা হতে পারে কি না, কে জানে!

ফিল্ডিং প্র্যাকটিস করার কথা স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়ামে। অ্যান্টিগার প্রতি শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ ২০০৭ বিশ্বকাপের আগে যেটি বানিয়ে দিয়েছে চীন। স্টেডিয়ামটা ভালোই। সমস্যা হলো, তা শহরের অনেক বাইরে বিরাণ এক এলাকায়। আসা-যাওয়া বিরাট ঝক্কির ব্যাপার।

অনুশীলনে নামার প্রস্তুতি নিলেও শেষ পর্যন্ত অ্যান্টিগার বৃষ্টি বাংলাদেশের অনুশীলন হতে দেয়নি

অ্যান্টিগার ঐতিহ্যবাহী টেস্ট ভেন্যু রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ড যেখানে ছিল অ্যান্টিগার রাজধানী সেন্ট জনস শহরের প্রাণকেন্দ্রে। ছিল মানে কি, এখনো আছে। যদিও সেটির অবস্থা খুব জরাজীর্ণ। মাঝখানে একরকম পরিত্যক্তই হয়ে গিয়েছিল। এই বিশ্বকাপে প্র্যাকটিস মাঠ হিসেবে তৈরি করতে ড্রেসিংরুম একটু সংস্কার করা হয়েছে। সকাল ৯টায় (বাংলাদেশের সন্ধ্যা ৭টা) বাংলাদেশ দলের নেট প্র্যাকটিসও ছিল এই রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডেই। নেট-টেট ঠিক করে যে-ই নামার প্রস্তুতি, তখনই আকাশ কালো করে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করে কোনো লাভ নেই বুঝে বাংলাদেশ দল ফিরে গেছে হোটেলে।

আরও পড়ুন

এই রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ড অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। তবে বাকি সব ছাপিয়ে অনেক দিনই এটি ব্রায়ান লারার সমার্থক। এই মাঠেই লারার দুটি বিশ্বরেকর্ড। ১৯৯৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে গ্যারি সোবার্সের রেকর্ড ভেঙে ৩৭৫। দশ বছর পর একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে অপরাজিত ৪০০ রান করে ম্যাথু হেইডেনের কাছে হারানো রেকর্ড পুনরুদ্ধার। এই মাঠে পা রাখলে যে কারো মনে পড়ে যায় সেই স্মৃতি। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদেরও পড়েছে। এমন নয় যে, তাদের সবাই ব্রায়ান লারার খুব ভক্ত। সাকিব-মাহমুদউল্লাহ জানেন, লারা কী জিনিস ছিলেন। তবে দলের তরুণতর সদস্যরা লারাতে ততটা আচ্ছন্ন নন। এঁরা সবাই যে বিরাট কোহলি যুগের। অন্য কারো্ মুখে শুনেছেন, টুকটাক ভিডিও দেখেছেন—লারা সম্পর্কে জানাশোনা বলতে এটুকুই।

অ্যান্টিগার রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডে জাকের ও রিশাদ
বিসিবি

তারপরও রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডে পা রেখে অনেকেরই লারার ওই দুই বিশ্বরেকর্ড সম্পর্কে কৌতূহল। হেড কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে ছাড়াও দলের কোচিং স্টাফের কেউ কেউ ব্রায়ান লারা যুগের ক্রিকেটার। বাংলাদেশ দলের ম্যানেজার রাবীদ ইমাম তো ব্রায়ান লারার তুমুল ভক্ত ছিলেন। এখনো হয়তো আছেন। লারাকে নিয়ে নাজমুলদের কৌতূহল মেটানোর কাজটা সবাই মিলেই করলেন। দলের লিয়াজোঁ অফিসার পিটার ম্যাথুজ এলেন আরও বড় সহায় হয়ে। ম্যাথুজ ত্রিনিদাদের মানুষ। লারা-ভক্ত হিসেবে নিজের পরিচয় তুলে ধরতে গর্ব করে বলেন, ক্যারিবিয়ানে লারার সব ইনিংসের প্রতিটি বল তিনি গ্যালারিতে বসে দেখেছেন। দাবিটাতে একটু অতিরঞ্জন আছে, তবে খুব সামান্যই। যা পিটার ম্যাথুসের জন্য বড় একটা আফসোসও। মাঠে ঢুকতে একটু দেরি হওয়ায় লারার অপরাজিত ৪০০ রানের ইনিংসের প্রথম বলটা যে দেখতে পারেননি।

আরও পড়ুন

সেই ইনিংসের সময় কী কী হয়েছিল, ৪০০তম রানের সময় লারা উইকেটের কোন প্রান্তে ব্যাটিং করছিলেন—সবিস্তারে সব বর্ণনা করেছেন পিটার ম্যাথুস। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জন্য যা অনুপ্রেরণাদায়ীই হওয়ার কথা। অনুপ্রেরণার অবশ্য এমনিতেই অভাব নেই এখন। চার ম্যাচের তিনটিতে জিতে সুপার এইটে উঠে যাওয়াই ক্রিকেটারদের টগবগ করে ফোটাচ্ছে। দশ/বারো দিন আগের সঙ্গে আকাশ-পাতাল পার্থক্য বলতে যা বোঝায়, ঠিক তা-ই।

অ্যান্টিগার রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডে বাংলাদেশের হেড কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে ও স্পিন বোলিং কোচ মুশতাক
বিসিবি

যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সিরিজ হেরে যাওয়ার পর চারপাশ থেকে ছুটে আসা সমালোচনার তীরে খেলার আনন্দটাই ভুলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। বিশ্বকাপ শুরুর আগে মাথার ওপর অসীম চাপ। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচের আগের কয়েক দিন ক্রিকেটারদের দেখে অনেক দিন ধরে দলের সঙ্গে থাকা কেউ কেউ রীতিমতো অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। একটু চিন্তিতও। চাপে তো সবার চিড়েচ্যাপ্টা অবস্থা! প্রাথমিক লক্ষ্য পূরণ হয়ে যাওয়ায় এখন নির্ভার বাংলাদেশ বড় কিছুর স্বপ্ন দেখছে। তা পূরণ না হলেই বা কি, সুপার এইটে যা পাওয়া যায়, তা-ই তো বোনাস।

আরও পড়ুন

বিশ্বকাপ। সুপার এইট। অ্যান্টিগা। এই তিন মিলে ১৭ বছর আগের আরেকটি বিশ্বকাপও মনে পড়ে যেতে বাধ্য। সাকিব আল হাসানের তো অবশ্যই পড়ছে। বাংলাদেশের ২০০৭ বিশ্বকাপ দলের একমাত্র তিনিই তো আছেন এখানে। এই বিশ্বকাপে গ্রুপ থেকে শ্রীলঙ্কাকে বিদায় করে দিয়ে বাংলাদেশ সুপার এইটে উঠেছে। সেবারও বাংলাদেশের গ্রুপে ছিল শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সেবার পারা যায়নি। ভারতকে বিদায় করে সুপার এইটে উঠেছিল বাংলাদেশ, সঙ্গী ছিল এই শ্রীলঙ্কাই।

সেই বিশ্বকাপেও সুপার এইটে বাংলাদেশের প্রথম দুই ম্যাচ এই অ্যান্টিগায়। কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে প্রথম ম্যাচের প্রতিপক্ষও। এবারের মতো সেবারও অস্ট্রেলিয়া। এবার যেমন বৃষ্টি চোখ রাঙাচ্ছে, সেবারও তিনি ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটাকে যা প্রায় টি-টোয়েন্টিই বানিয়ে দিয়েছিল। ৫০ ওভারের বদলে খেলা হয়েছিল ২২ ওভারের।

অ্যান্টিগার রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডে সৌম্য সরকার
বিসিবি

ভারতকে হারিয়ে বিশ্বকাপ এলোমেলো করে দেওয়ার পর সুপার এইটেও স্মরণীয় একটা জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। তবে তখন ওয়ানডে র‍্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বর দল দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ম্যাচটা হয়েছিল গায়ানায়। দুটিই ছিল আপসেট। এবার অস্ট্রেলিয়া বা ভারতের বিপক্ষে জিতে গেলে সেটিকেও কি আপসেট বলা হবে?

তা যা-ই বলা হোক না কেন, এই দুই ম্যাচের একটি জিতলেই সেমিফাইনাল আর অনেক দূরের কোনো স্বপ্ন হয়ে থাকবে না। বাংলাদেশ কি পারবে?

পারলে পারবে, না পারলে নাই। এর আগের কোনো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তো এমন কিছু ভাবারই সাহস হয়নি। এটাই বা কম কী!

আরও পড়ুন