বাংলাদেশ–ইংল্যান্ড ওয়ানডে বললে কোন ম্যাচটা প্রথমেই মনে পড়ে আপনার?
ধরুন, এটা একটা এমসিকিউ। সম্ভাব্য উত্তর হিসেবে দেওয়া আছে চারটি ভেন্যুর নাম—ব্রিস্টল, চট্টগ্রাম, অ্যাডিলেড, ঢাকা। কোনটিতে টিক দেবেন আপনি?
চারটি অপশন যে দৈবচয়ন ভিত্তিতে বেছে নেওয়া নয়, তা আপনার বুঝে ফেলার কথা। দুই দেশের মধ্যে ২১টি ওয়ানডে ম্যাচের যে ৪টিতে বাংলাদেশ জিতেছে, সেই ৪টি ম্যাচই না? হ্যাঁ, ওই চারটি ম্যাচই। ২০১০ সালে ব্রিস্টলে প্রথম জয়, ২০১৬ সালে ঢাকার মিরপুরে সর্বশেষ। মাঝখানের দুটি জয় ২০১১ ও ২০১৫ সালে পরপর দুটি বিশ্বকাপে।
‘প্রথম’–এর মাহাত্ম্যের কারণে ব্রিস্টল একটু আলাদা মর্যাদা দাবি করে। তবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের সেরা জয় বেছে নিতে গেলে লড়াইটা মনে হয় বিশ্বকাপের ম্যাচ দুটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
২০১১ বিশ্বকাপে চট্টগ্রামের জয়টা বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা জয়ের তালিকার ওপরের দিকেই থাকবে। ১৬৯ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে ফেলার পর কেউ বাংলাদেশের জয়ের আশা করেছিলেন বলে দাবি করলে জবাব দেওয়ার দরকার নেই। নিশ্চিত থাকতে পারেন, তিনি সত্যি বলছেন না। নবম উইকেটে মাহমুদউল্লাহ ও শফিউলের অপরাজিত ৫৮ রানের জুটিতে যা লেখা হয়েছিল, তা আসলে ক্রিকেটীয় রূপকথা।
তারপরও ২০১৫ বিশ্বকাপে অ্যাডিলেডের জয়কে একটু এগিয়ে রাখতে চাই। সেই জয় বাংলাদেশকে কোয়ার্টার ফাইনালে তুলে দিয়েছিল, এটা একটা কারণ। তবে সবচেয়ে বড় কারণ অবশ্যই নয়। অ্যাডিলেড আলাদা হয়ে আছে বাংলাদেশের কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার চেয়েও বৃহত্তর তাৎপর্যের কারণে। বাংলাদেশের কাছে ওই পরাজয় ছিল ইংলিশ ক্রিকেটের রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প, যা বদলে দিয়েছিল ইংল্যান্ডের ওয়ানডে–সংস্কৃতিই।
যেটির সুদূরপ্রসারী প্রভাব শুধু ইংল্যান্ড দলেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বদলে দিয়েছে ওয়ানডে ক্রিকেটকেই। নির্দিষ্ট একটা ম্যাচের এমন যুগান্তকারী হয়ে ওঠার ঘটনা ক্রিকেট ইতিহাসেই খুব বেশি নেই।
চার বছর পর লর্ডসের ফাইনালে তর্কযোগ্যভাবে সর্বকালের সেরা ওয়ানডে জিতে ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ জয়ের বীজও বোনা হয়েছিল সেদিনই। রক্ষণশীলতার খোলস ঝেড়ে ফেলে সাদা বলে ইংল্যান্ডের প্রলয়ংকরী হয়ে ওঠার সূচনা তো ওই অ্যাডিলেড–বিপর্যয়ের পরই। যেটির প্রভাবক হিসেবে হয়তো বাংলাদেশকেও ধন্যবাদ দেয় ইংল্যান্ড।
স্টোকস ও ম্যাককালাম জুটি বাঁধার পর ইংল্যান্ড যা করছে, প্রায় দেড় শ বছরের টেস্ট ক্রিকেটে তা রীতিমতো বিপ্লব। তবে ইংলিশ–বিপ্লবের শুরু তো সাদা বলের ক্রিকেটেই। যেটির প্রতিচ্ছবি রেকর্ড–বইয়েও। ওয়ানডে ক্রিকেটে দলীয় সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডে যান। সর্বোচ্চ ৩টি স্কোরই ইংল্যান্ডের এবং ৩টিই ২০১৫ বিশ্বকাপ–পরবর্তী সময়ে। সবচেয়ে ওপরে যেটি, তাতে মাত্র ২ রানের জন্য ৫০০ হয়নি।
পুরোনো ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটির কারণ তো বুঝতেই পারছেন। প্রায় সাত বছর পর আবার বাংলাদেশ সফরে এসেছে ইংল্যান্ড দল। এবার খেলাটা শুধুই সাদা বলের। যে সাদা বলের ক্রিকেটের অবিসংবাদিত রাজা এখন ইংল্যান্ড। ওয়ানডের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, টি–টোয়েন্টিরও। একই সঙ্গে সাদা বলের দুই বিশ্বকাপেরই মুকুট এর আগে আর কোনো দলের মাথায় ওঠেনি।
পরাক্রান্ত সেই ইংল্যান্ড টি–টোয়েন্টিতে অবধারিত ফেবারিট। টি–টোয়েন্টিতে দুই দল যেমন বিপরীত মেরুতে, তাতে সিরিজের তিন ম্যাচের একটি জিতলেও সেটিকে বাংলাদেশের বড় অর্জন বলে ধরতে হবে। তবে এর আগে তিন ম্যাচের যে ওয়ানডে সিরিজ, তাতে বাংলাদেশকেই যদি কেউ ফেবারিট বলে ঘোষণা করে দেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
‘ফেবারিট’রাই যদি জেতে, তাহলে একটা বৃত্ত পূরণ হয়। কিসের বৃত্ত? সব দলের বিপক্ষে সিরিজ জয়। ইংল্যান্ড ছাড়া বাকি সব দলের বিপক্ষেই বাংলাদেশ কোনো না কোনো সংস্করণে সিরিজ জিতেছে। ঘটনাচক্রে ওয়ানডেতে জয়েও ইংল্যান্ডই এমন বাংলাদেশের ‘দ্য লাস্ট ফ্রন্টিয়ার’ হয়ে ছিল। সব দলকে হারানো শেষ, শুধু ইংল্যান্ডই অজেয়। যে অতৃপ্তি ঘুচিয়েছিল ২০১০ সালের জুলাইয়ে ব্রিস্টলের ওই জয়।
ইংল্যান্ড বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন—এটা যদি ভুলেও যান, আইসিসির সর্বশেষ ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়েও জস বাটলারের দলই এগিয়ে। ইংল্যান্ড আছে চার নম্বরে, বাংলাদেশ সাতে। র্যাঙ্কিং দুই দলের শক্তি ও সাম্প্রতিক ফর্মের একটা আভাস দেয়, তবে সেটিই জয়–পরাজয়ের নির্ধারক নয়। তাহলে গত ডিসেম্বরে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের সিরিজ জেতার কথা নয়।
সেই জয়ে অনেক কিছুরই ভূমিকা আছে। তবে সবচেয়ে বেশি সম্ভবত এই তথ্যটার—খেলা হয়েছে বাংলাদেশে। দেশের মাটিতে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের প্রায় অজেয় এক দল, যেটির প্রমাণ লেখা টানা সপ্তম সেই সিরিজ জয়ে। স্বভূমে সর্বশেষ সিরিজ হারার স্মৃতিতে প্রায় সাত বছরের ধুলা জমেছে।
ইংল্যান্ড দল বাংলাদেশে পা রাখার পর অবশ্য একটু জীবন্তই হয়ে উঠেছে সেই স্মৃতি। দেশের মাটিতে ওয়ানডে সিরিজে সর্বশেষ হার যে এই ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই। ২০১৬ সালের সেই সিরিজে বাংলাদেশ হেরেছিল ২–১ ম্যাচে। মিরপুরে দ্বিতীয় ম্যাচে জয় সমতা ফিরিয়েছিল সিরিজে।
অথচ একটু এদিক–ওদিক হলেই সেদিন বাংলাদেশের সিরিজ জয় সম্পন্ন হয়ে যেত। হয়নি প্রথম ম্যাচে জেতা ম্যাচ অবিশ্বাস্যভাবে হারতে সক্ষম হওয়ায়। সেই ম্যাচে ইমরুলের সেঞ্চুরির পর সাকিব এমন ব্যাটিং করছিলেন যে ইংল্যান্ডের ৮ উইকেটে ৩০৯ রানও কোনো ব্যাপারই মনে হচ্ছিল না।
৫২ বলে ৩৯ রান দরকার, হাতে ৬ উইকেট—এখান থেকে জেতার চেয়ে হারাই মনে হয় কঠিন। ৫৪ বলে ৭৯ রান করার পর সাকিবের সফট ডিসমিসালের পর তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে সেই কঠিন কাজটিই করে ফেলেছিল বাংলাদেশ। মাত্র ১৭ রানে পড়েছিল শেষ ৬ উইকেট।
সাকিবের স্মৃতিশক্তি খুব ভালো। ম্যাচটা তাঁর ভুলে যাওয়ার কথা নয়। আঙিনায় ইংল্যান্ড হয়তো ফিরিয়ে আনছে চিনচিনে সেই ব্যথাটাও। এই ব্যথার উপশম কিসে, সাকিবের তো তা জানাই আছে।