লিটন–মিরাজের পর হাসান, রাওয়ালপিন্ডিতে অবিশ্বাস্য দিন
পেস বোলারদের দাপট, ব্যাটিং–ধসের পরও দুর্দান্ত সেঞ্চুরি—রাওয়ালপিন্ডি টেস্টের তৃতীয় দিনে কী ছিল না! আগের দিন পাকিস্তানকে ২৭৪ রানে অলআউট করার পর শেষবেলায় ২ ওভারের জন্য ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশ কোনো উইকেট না হারিয়ে করেছিল ১০ রান। কিন্তু আজ সকালে ১৬ রান যোগ করতেই প্রথম ৬ উইকেট হারিয়ে বসে বাংলাদেশ।
অবিশ্বাস্য সে ধসের পরও লিটন-মিরাজের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে ঘুরে দাঁড়ায় নাজমুল হোসেনের দল। লিটন দাস ধ্বংসস্তূপ থেকে দলকে টেনে তোলেন ১৩৮ রানের ইনিংস খেলে। মিরাজের ব্যাট থেকে আসে ৭৮ রান। টালমাটাল শুরুর পরও এই দুজনের সৌজন্যেই বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে পেয়ে যায় ২৬২ রান। পাকিস্তানের খুররাম শেহজাদ নেন ৬ উইকেট। ১২ রানের লিড পাওয়া পাকিস্তান দিন শেষে ৯ রান তুলতেই ২ উইকেট হারিয়ে ফেলেছে। ২টি উইকেটই হাসান মাহমুদের। দিন শেষে পাকিস্তান এগিয়ে ২১ রানে।
বাংলাদেশের নড়বড়ে ব্যাটিংয়ের শুরুটা হয়েছিল আগের দিন বিকেলে। মির হামজার করা ইনিংসের প্রথম বলেই স্লিপে ক্যাচ তোলেন সাদমান ইসলাম। কিন্তু ক্যাচটা নিতে পারেননি সৌদ শাকিল। ওদিকে জাকির হাসানও কোন বল ছাড়বেন, কোনটা খেলবেন ঠিক করতে পারছিলেন না। সেদিন বিকেলে মাত্র দুই ওভার খেলতে হয়েছিল দুই ওপেনারকে। আজ দিনের শুরুতে পরপর দুই ওভারে আউট সাদমান-জাকির।
রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে খুররাম শেহজাদের করা ইনিংসের ষষ্ঠ ওভারে শর্ট মিড উইকেটে ক্যাচ তোলেন জাকির (১)। শেহজাদের পরের ওভারে এসে একই অ্যাঙ্গেলের বল লেগের দিকে খেলতে গিয়ে বোল্ড সাদমান (১০)। ওই ওভারেই একই ভুল করেন আরেক বাঁহাতি নাজমুল হোসেন। শেহজাদের ভেতরে আসা বল লেগের দিকে খেলার চেষ্টায় স্টাম্প এলোমেলো হয়ে যায় বাংলাদেশ অধিনায়কের। ১ বাউন্ডারিতে ৪ রানে থামে নাজমুলের ইনিংস।
২০ রানে টপ অর্ডারের তিন বাঁহাতিকেই হারানোর পরও শুধরায়নি বাংলাদেশের ব্যাটিং। শেহজাদ ও হামজা রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে স্টাম্প তাক করে বল করে গেছেন। আর ব্যাটিং–বিপর্যয়ের মধ্যেই বাংলাদেশের বাঁহাতিরা লেগের দিকেই খেলার চেষ্টা করে গেছেন আর উইকেট খুইয়েছেন। নবম ওভারে হামজার স্লোয়ার ডেলিভারিতে বোকা বনে যান মুমিনুল হক (১)। শর্ট মিড অনে ফ্লিক করতে গিয়ে সহজ ক্যাচ তুলে দেন এই অভিজ্ঞ বাঁহাতি ব্যাটসম্যান।
সাকিব আল হাসানও বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। ১২তম ওভারে শেহজাদ খুঁজে নেন সাকিবের প্যাড। ২ রান করা সাকিবের রিভিউ নিয়েও রক্ষা হয়নি। ইনিংস বড় হয়নি মুশফিকুর রহিমেরও (৩)। হামজার লেংথ থেকে লাফিয়ে ওঠা বলে ব্যাট ছুঁইয়ে আউট হয়েছেন তিনি।
স্কোরবোর্ডে বাংলাদেশ দলের রান তখন ৬ উইকেটে ২৬। বল মাত্র ১২ ওভার পুরোনো। এর মধ্যেই ক্রিজে নামতে হয় লিটন আর মিরাজকে। হামজা তখনো সুইং পাচ্ছিলেন, শেহজাদ সিম মুভমেন্ট। তবে মিরাজ নিলেন প্রতি–আক্রমণের পথ। পাকিস্তানের আক্রমণাত্মক ফিল্ডিংয়ের সুবিধা নিয়ে স্কয়ার ড্রাইভ ও কাভার ড্রাইভে বেশ কিছু বাউন্ডারি খুঁজে নেন তিনি। অন্য প্রান্তে লিটন খেলছিলেন রীতিমতো টেস্ট ওপেনারের মতো। অপেক্ষায় ছিলেন ক্রিজে সময় কাটিয়ে বল পুরোনো হওয়ার।
দুজনের কৌশলী ব্যাটিং রান বাড়াতে থাকে বাংলাদেশের। বল নরম হয়ে আসায় চ্যালেঞ্জও কিছুটা কমে আসে। আর তাতে লিটন-মিরাজ পেয়ে যান স্মরণীয় এক জুটির মঞ্চ। এক-দুই রান আর কিছু বাউন্ডারিতে স্কোরবোর্ডে থাকা ৫০ রান হয়ে যায় ১০০। ফলো অনের লজ্জা এড়িয়ে আরও বড় স্বপ্ন দেখতে থাকে বাংলাদেশ। লিটন-মিরাজ দুজনই ফিফটি করেন, তাঁদের জুটি থেকে আসে ১৬৫ রান। অবিশ্বাস্য সে জুটিতে একটি বিশ্ব রেকর্ডও গড়েছেন দুজন। ১৪৭ বছরের টেস্ট ইতিহাসে ৫০ রানের কমে ষষ্ঠ উইকেট পতনের পর সপ্তম উইকেটে সবচেয়ে বড় জুটি এখন তাঁদের।
৫২তম ওভারে শেহজাদের বলে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে মিরাজের আউটে ভাঙে তাঁদের রেকর্ড জুটি। প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ফিফটি করা মিরাজের ব্যাট থেকে এসেছে ১২৪ বলে ৭৮ রানের ঝলমলে ইনিংস। লিটন অবশ্য সেখানেই থামলেন না। তাসকিন আউট হলেও হাসান মাহমুদকে নিয়ে তিনি যোগ করেন আরও ৬৯ রান। টেস্ট ক্যারিয়ারের চতুর্থ সেঞ্চুরিও পেয়ে যান। আর পাকিস্তানের বিপক্ষে এটি তাঁর দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। পাকিস্তানের বিপক্ষে লিটনের প্রথম সেঞ্চুরিটি (১১৪) আসে ২০২১ সালে।
বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে পাকিস্তানের বিপক্ষে একাধিক টেস্ট সেঞ্চুরি করার কৃতিত্ব শুধুই লিটনের। এই সেঞ্চুরিতে তিনি গড়েছেন আরেকটি রেকর্ডও। দলের স্কোর পঞ্চাশের কম থাকা অবস্থায় ব্যাটিং অর্ডারে পাঁচের নিচে নেমে তিনটি সেঞ্চুরি করা বিশ্বের প্রথম ব্যাটসম্যান লিটন।
ম্যারাথন ব্যাটিংয়ে লিটন বাংলাদেশকে নিয়ে যান পাকিস্তানের প্রথম ইনিংসে করা ২৭৪ রানের কাছাকাছি। ৭৯তম ওভারে সালমান আলী আগার অফ স্পিনে দ্রুত রান তোলার চেষ্টা করতে গিয়ে আউট হয়ে যান লিটন। ২২৮ বলে ১৩টি চার ও ৪টি ছক্কায় ১৩৮ রানে থামে তাঁর ইনিংস। শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে নাহিদ রানা আউট হওয়ায় বাংলাদেশের ইনিংসও শেষ হয় সে ওভারেই। হাসান ৫১ বল খেলে অপরাজিত ছিলেন ১৩ রানে।
বাংলাদেশকে ২৬২ রানে অলআউট করে ১২ রানের লিড পায় পাকিস্তান। তবে শেষবেলায় ব্যাটিংয়ে নামা পাকিস্তানকে স্বস্তি দেননি হাসানও। আউটসুইংয়ে ওপেনার আবদুল্লাহ শফিককে ৩ রানে করেন কট বিহাইন্ড। এরপর নাইট ওয়াচম্যান শেদজাদকে ০ রানে বোল্ড করে দিনের খেলারই ইতি টানেন এই পেসার।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
পাকিস্তান: ২৭৪ ও ৩.৪ ওভারে ৯/২ (সাইম ৬* ; হাসান ২/৩)।
বাংলাদেশ: ১ম ইনিংসে ৭৮.৪ ওভারে ২৬২ (লিটন ১৩৮, মিরাজ ৭৮, হাসান ১৩*; শেহজাদ ৬/৯০, সালমান ২/১৩, হামজা ২/৫০)
(৩য় দিন শেষে)