নেপালের ‘বিউটিফুল গেম’, বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশের সেই ‘বিউটিফুল হার’ ও সময়জ্ঞানের পাঠ
‘বিউটিফুল গেম!’
কথাটি ম্যাচসেরা তাব্রেইজ শামসির। নেপালের খেলা নিয়ে বলেছেন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে। সত্যি কথাটা সবার আগে বলতেও শামসির বাধেনি, ‘হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছি।’ কবজির এই বাঁহাতি স্পিনারের কেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছে, সেটা এতক্ষণে আপনার জানা। কিংসটাউনের আর্নস ভেল গ্রাউন্ড আরেকটু হলেই বৈশ্বিক ক্রিকেটে আসি আসি করা ভূমিকম্পের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠত! শেষ পর্যন্ত তা হয়নি বটে, আর ‘বিউটিফুল গেম’ কথাটা ফুটবলে বেশি উচ্চারিত হলেও নেপালের কারণে তা বলতে হলো শামসিকে। ‘হিমালয় দুহিতা’ নেপাল ১ রানে হেরেছে ঠিকই, কিন্তু খেলেছে হিমালয়ের মতোই সুন্দর ‘বিউটিফুল’ ক্রিকেট।
বলা হয়, খাঁটি সৌন্দর্য বলে কিছু হয় না। কিছু না কিছু খাদ থাকেই। খাঁটি সোনা যেমন তরল হয়, তা দিয়ে কিছু গড়া যায় না, খাদ মেশাতে হয়, তেমনি নেপালের ‘বিউটিফুল গেম’–এও কিছু খাদ ছিলই। সেখান থেকে জয়ের অলংকার গড়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। শামসি সম্ভবত সে জন্যই ‘বিউটিফুল গেম’ বলে নেপালের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলেন! তবু ‘খাদ’গুলো নিয়ে নিশ্চয়ই ভাববে নেপাল। ভাবনার সময়ও যে এটাই। নেপাল বৈশ্বিক ক্রিকেটে এখন উঠে আসার লগ্নে। তাদের সমর্থকেরাও ইতিমধ্যে অন্যতম সেরার স্বীকৃতি পেয়েছেন। পৃথিবীর যে প্রান্তেই নেপালের ম্যাচ হোক, গ্যালারিতে নেপালি টুপি পরা লোকজনের আনাগোনা থাকবেই।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচে আজও যেমন হৃদয় উষ্ণ করা প্ল্যাকার্ড দেখা গেল গ্যালারিতে। এক খুদে উঁচিয়ে ধরেছিল প্ল্যাকার্ডটি, ‘প্যাশন ও গর্ব গভীর হলে দূরত্ব কিছুই নয়। বিশ্বকাপে নেপালকে সমর্থন দিতে ১৬ হাজার ২৮৭ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছি। কিছু স্বপ্ন ছুঁতে মাইলকে মাইল ছোটাই যথার্থ।’
নেপালের সেই স্বপ্নপূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো ‘খাদ’গুলো একবার চিহ্নিত করা যাক। জয়ের জন্য শেষ তিন ওভারে ১৮ রান দরকার ছিল নেপালের। হাতে ৫ উইকেট। ধারাভাষ্যকার অ্যালান উইলকিনস তখন বলছিলেন, নেপাল এই টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বয়সের দিক থেকে সর্বকনিষ্ঠ দল। অর্থাৎ অনভিজ্ঞ। এমন ম্যাচ জেতায় হাত পাকেনি। ১৮তম ওভারে শামসিকে ২টি উইকেট দেওয়া সেই অনভিজ্ঞতারই প্রমাণ। কিছুই না, শুধু সিঙ্গেলসের ওপরে খেললেই হতো। নেপাল সেটাই না পারায় জয়ের জন্য শেষ দুই ওভারে সমীকরণ দাঁড়ায় ১২ বলে ১৬। ১৯তম ওভারে প্রথম ৪ বলে একটি উইকেট দিয়ে নেপাল কোনো রানই নিতে পারেনি। সমীকরণ তখন আরও কঠিন ৮ বলে ১৬। মাথায় জেঁকে বসা চাপ কাটিয়ে উঠতে পরের বলে ছক্কা মারতে হয় সোমপাল কামিকে। পরের বলে ২টি রান আসায় শেষ ওভারে সমীকরণ দাঁড়ায় ৬ বলে ৮।
একবার ভাবুন তো, ১৯তম ওভারে প্রথম চারটি বল ‘ডট’ না দিয়ে নেপাল যদি কোনোভাবে সিঙ্গেলসের ওপর খেলত, তাহলে কি চাপ তাঁদের ওপর জেঁকে বসত; বরং প্রোটিয়াদেরই উল্টো চাপে পড়ে ভুলভাল জায়গায় বোলিং করার ঝুঁকি ছিল। সে যাহোক, শেষ ওভারে অনভিজ্ঞতার ব্যাপারটি চোখে বিঁধেছে সবচেয়ে বেশি। ৬ বলে যখন ৮ রানের সমীকরণ তখন প্রতিটি বলই আপনি ব্যাটে খেলতে চাইবেন, কিন্তু গুলশান ঝা শেষ ওভারে প্রথম দুটি বল ব্যাটেই লাগাতে পারেননি। বিষম চাপে পড়ে তৃতীয় বলে তাই চার মারতে হয় ঝা–কে। সমীকরণ নেমে আসে তিন বলে ৪ রানে। পরের বলে ২টি রান নেওয়ার পর নিশ্চয়ই অনেকে নড়েচড়ে বসেছিলেন। ২ বলে দরকার ২ রান, এটা পারতেই হবে!
অনভিজ্ঞতার কারণে ঝা তখন ভাবতেও পারেননি প্রোটিয়া পেসার ওটনিল বার্টম্যান খাটো লেংথ থেকে বল তুলতে পারেন। সাধারণত এমন ‘ডেথ’ মুহূর্তে স্টাম্প বরাবর ইয়র্কার কিংবা ওয়াইড ইয়র্কার প্রত্যাশা থাকে ব্যাটসম্যানদের। বার্টম্যান ঠিক এখানেই সাহসী হয়ে চমকে দেওয়া জুয়াটা খেলে জিতিয়েছেন প্রোটিয়াদের, আর সেটা নিশ্চয়ই তাঁর এসএ টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে অভিজ্ঞতার ফসল এবং টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শুরুর আগেই জানা গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার একজন ডেথ ওভার বিশেষজ্ঞ আছেন এবং সেটা এই বার্টম্যান। আর ঝা–ও সেই খাটো লেংথের বলটি অন্ধের মতো চালিয়ে ব্যাটে না পাওয়ার ভুলটি করে বসেন।
পরের ভুলটি করেন আম্পায়ারের সঙ্গে বার্টম্যানের পরের গতিবিধির দিকে লক্ষ না রেখে। এ ক্ষেত্রে দায় নন–স্ট্রাইকে দাঁড়ানো সোমপালেরও। বোলিং লাইনআপে ফিরে যাওয়ার সময় বার্টম্যান আম্পায়ারকে জিজ্ঞেস করেন, এখনো একটি বাউন্সার করার সুযোগ আছে কি না। আম্পায়ার হ্যাঁসূচক উত্তর দেন। ব্যাপারটা নজরে পড়লে ঝা বুঝতে পারতেন, কী ডেলিভারি আসতে চলেছে আর তাকে কী করতে হবে। সোমপালও নন–স্ট্রাইক থেকে দৌড় শুরু করতে পারতেন আগেভাগেই। কিন্তু শেষ বলে বাউন্সারের ভাবনা যে দুই ব্যাটসম্যানের মাথায় ছিল না, সেটাই বোঝা গেল বল ডেলিভারির পর। এখানেই অভিজ্ঞতায় আরেকটি মার খেয়েছে নেপাল। আর ভাগ্যও কি সঙ্গে ছিল? খাটো লেংথের শেষ বলটি ব্যাটে না পেয়ে ঝা ও সোমপাল যখন দৌড় শুরু করলেন তখন দর্শক হিসেবে কেমন লেগেছে, বলুন তো?
তখন কারও কারও মনে হয়তো এ ভাবনাটাও এসেছে, উইকেটকিপারের হাতে বল থাকতে দৌড়ে যদি রান–ই নিতে হয়, শেষ তিন ওভারে যেগুলো ‘ডট’ গিয়েছে, তখন এমন দু–একটি রান চুরি করতে পারলেই তো ম্যাচটা এতদূর আসে না! ঝা ও সোমপালের মধ্যে মরিয়া মনোভাবটা দেখা গেছে একদম শেষ বলে, যখন যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে। অনেকটাই বাংলাদেশ–দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচের মতো।
সেই ম্যাচে ১১৩ রান তাড়া করতে নেমে ম্যাচটা শেষ বল পর্যন্ত নিয়ে ৪ রানে হেরেছে বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞরা বলেন, স্বল্প রান তাড়া করতে নেমে ম্যাচ কখনো শেষ ওভার বা শেষ বল পর্যন্ত নিতে নেই। তাতে প্রতিপক্ষ দলের জেতার সম্ভাবনা বাড়ে। দুটি ম্যাচেই ঠিক তা–ই ঘটল। নেপাল একটু সাহসী হলেই অঘটনের ভূমিকম্প ঘটে যেত। ভালো বোলিংয়ের বিপক্ষে অনভিজ্ঞতার কারণেই নেপাল সেটি পারেনি। আর তাই ওই যে বলা হয়, ভাগ্য সব সময় সাহসীদের সহায় হয়, বার্টম্যানের ক্ষেত্রেও সেটাই হলো। ডি ককের থ্রো–ও তাই ঝায়ের গায়ে লেগে হাইনরিখ ক্লাসেনের হাত পর্যন্ত পৌঁছাল এবং তারপর রানআউট। নেপালের সমর্থকেরা ভাবতে পারেন, ডি ককের থ্রো ঝায়ের গায়ে লেগে অন্যদিকেও তো যেতে পারত যেখানে ফিল্ডার নেই, তাহলেই ম্যাচ টাই! কিন্তু ভাগ্য এ ক্ষেত্রে সেই চিরায়ত সূত্রই মেনেছে। সাহসীদের সহায় হয়েছে।
টিভির সামনে কিংবা গ্যালারিতে ম্যাচটি দেখতে দেখতে বাংলাদেশের সমর্থকদের কি কোনো স্মৃতি মনে পড়েছে? বাংলাদেশ ক্রিকেট যে পথে উঠে এসেছে, নেপালও এখন সেই পথে। বাংলাদেশের সমর্থকেরাও তো নেপালের সমর্থকদের মতোই প্যাশনেট, অর্থাৎ খেলাটির প্রতি ভীষণ আবেগপ্রবণ। মনের গহিনে নেপালের জন্য খারাপ লাগাই স্বাভাবিক। আর এই খারাপ লাগার মধ্যেই ভাবতে পারেন, এই হার নেপালের জন্য শিক্ষা—যে শিক্ষাটা আমরা এখনো ভালোভাবে শিখতে পারিনি!
মনে আছে, ২০১৬ বিশ্বকাপের বেঙ্গালুরু? সেই হৃদয়ভঙ্গ, সেই যাতনার ১ রানে হার! বাংলাদেশের সমর্থকেরা কি সেই ম্যাচটি কখনো ভুলতে পারবেন? সম্ভবত না। শেষ ৩ বলে দরকার ছিল ২ রান। ক্রিজে মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। হার্দিক পান্ডিয়াকে সীমানাছাড়া করার ভূত চেপে বসেছিল মুশফিক-মাহমুদউল্লাহর ঘাড়ে। তা করতে গিয়ে আউট হন দুজনই। শেষ বলে মোস্তাফিজুর রহমান রানআউট হলে ৩ বলেই ৩ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ হেরে বসে ১ রানে! বাংলাদেশি সমর্থকদের অনেকেই তখন নিজ দলকেই খোঁচা মেরে বলেছিলেন ‘বিউটিফুল হার!’
নেপালের আজকের প্রতিপক্ষ এই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেই এবারও শেষ বলে ম্যাচ হেরেছে বাংলাদেশ। তবে নেপালের আজকের হার এবং ৮ বছর আগের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেই হারের মধ্যে পার্থক্যটা সাহস দেখানোর সময় বেছে নেওয়ায়। ভারতের বিপক্ষে সে ম্যাচে যখন সাহস দেখানোটাই নিষ্প্রয়োজন, ঠান্ডা মাথায় সিঙ্গেলস নিলেই হতো, তখন উল্টো কাজ করেছে বাংলাদেশ। আর নেপাল প্রয়োজনের সময় একটি–দুটি চার মারা কিংবা সাহস দেখিয়ে সিঙ্গেলস নিতে করতে পারেনি। ম্যাচ টাই করতে যখন আর কোনো পথ নেই দৌড় দেওয়া ছাড়া, তখন নেপাল সাহসী হয়ে উঠলেও প্রতিপক্ষও তো চরম আত্মবিশ্বাসী, যেহেতু স্বল্পপুঁজির ম্যাচটাই তারা শেষ বল পর্যন্ত টেনে নিতে পেরেছে। তাই সেই খুদে সমর্থকের স্বপ্নপূরণ হলো না, যে ১৬ হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে প্রাণের দলের খেলা দেখতে এসেছিল।
নেপাল অধিনায়ক রোহিত পোডেল অবশ্য ম্যাচ শেষে সমর্থকদের ধন্যবাদ দিলেন, ‘যেভাবে সমর্থন পাচ্ছি, সে জন্য সমর্থকদের ধন্যবাদ জানাতে চাই। তারা বৃষ্টি এবং সবকিছু মাথায় নিয়েই অনেক পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের সমর্থন দিতে এখানে এসেছে।’
প্রিয় রোহিত, সমর্থনের ভিত আপনার মজবুত। এখন শুধু ভুল থেকে শিক্ষাটা ভালোভাবে নিতে হবে। আরও ম্যাচ খেলতে খেলতে অভিজ্ঞতাও বাড়বে। তাতে সাহস ও সময়জ্ঞানও হবে আরও ধারাল। আর সেই ধারে বড় বড় রাঘববোয়ালও কাটা পড়বে নিশ্চিত। শুভকামনা।