ওয়ার্নার বলেছিলেন মাথা খাটিয়ে বল করতে, মোস্তাফিজ দিলেন মাথার ওপর বাউন্সার

মোস্তাফিজের অধিনায়ক ওয়ার্নারছবি: সংগৃহীত

‘আমি ফিজের জন্য গুগল ট্রান্সলেশন ব্যবহার করছিলাম। চেষ্টা করছি কীভাবে বাংলা বলতে হয়। হা হা। থোরা থোরা।’

২০১৬ সালের এপ্রিলে আইপিএলের মধ্যে ঠিক এমন টুইটই করেছিলেন ডেভিড ওয়ার্নার। ফিজ মানে বাংলাদেশের মোস্তাফিজুর রহমান, সে বছরই প্রথমবার আইপিএল খেলতে  যান বাংলাদেশের এই বাঁহাতি পেসার। সানরাইজার্স হায়দরাবাদে মোস্তাফিজের অধিনায়ক ছিলেন ওয়ার্নার।

টেবিলের দুই প্রান্তে বসা ওয়ার্নার ও মোস্তাফিজ—এমন একটি ছবি ‘ভাইরাল’ হয়ে গেলে একজনের মন্তব্যের জবাবে অমন উত্তর দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ওপেনার। যে উত্তরে রসিকতার সুর থাকলেও ওয়ার্নারের বাংলা শেখার চেষ্টা ছিল সত্যি। ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মোস্তাফিজের সঙ্গে আলোচনা করতে বেশ বিড়ম্বনায়ই যে পড়তে হতো তাঁকে।

আইপিএলে ভাষা–বিড়ম্বনার ঘটনা অবশ্য নিয়মিতই। ক্রিকেট সাধারণত জাতীয় দলনির্ভর খেলা হওয়ায় ব্যতিক্রম বাদে একটি দলের সবাই এক ভাষায়ই কথা বলেন। সমস্যা দেখা দেয় যখন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট টুর্নামেন্টে বিভিন্ন ভাষাভাষী এক দলে জড়ো হন। ইউরোপের ক্লাব ফুটবলেও একই চিত্র দেখা যায়।

তবে ভাষা নিয়ে বিড়ম্বনা সেখানে কম হওয়ার বড় কারণ, খেলা চলে প্রায় সারা বছর। লম্বা সময় সবাই একসঙ্গে থাকায় ভাষার প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠাটা সহজ। কিন্তু আইপিএলের মতো ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট টুর্নামেন্টগুলো চলে বছরে সর্বোচ্চ দুই মাস। তার ওপর এক ভারতেই বহু ভাষার মানুষের সমাগম।

সরকারি দাপ্তরিক ভাষা হিন্দি ও ইংরেজি হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত ভাষা ২২টি। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ক্রিকেটার আর বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়েরা যখন একত্রিত হন, তখন যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভাষা নিয়ে বড় চ্যালেঞ্জেই পড়তে হয় টিম ম্যানেজমেন্টকে।

আরও পড়ুন

আইপিএলে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটের মালিক পীযুষ চাওলাও পড়েছিলেন এমন এক বিড়ম্বনায়। ২০০৮ সালে আইপিএলের প্রথম আসরে চাওলা ছিলেন পাঞ্জাব কিংসে। সেই দলে ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ব্রেট লি, শন মার্শ, কোচ টম মুডিরা।

উত্তর প্রদেশ থেকে উঠে আসা চাওলা ইংরেজি বলতে না পারলেও বুঝতে পারতেন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ানদের ইংরেজি নিয়ে পড়েছিলেন ঝামেলায়, ‘ইংরেজি সমস্যা ছিল না; কিন্তু ওদের উচ্চারণ বোঝা কঠিন ছিল।’ লি–মার্শদের ইংরেজি বোঝার জন্য চাওলা তখন যুবরাজ সিংকে অনুবাদক বানিয়ে নিয়ে বলতেন ‘উনি কী বলেছেন বুঝিয়ে দাও তো’। আবার পরবর্তী সময়ে কলকাতা নাইট রাইডার্সে খেলার সময় কোচ জ্যাক ক্যালিস ও সাইমন ক্যাটিসদের কথা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য রিংকু সিংয়ের দোভাষী হয়ে ওঠেন চাওলাই।

প্রথম আসরে পাঞ্জাবে কোচিং করানো মুডি ২০১৬ আসরে ছিলেন সানরাইজার্স হায়দরাবাদে। সে বছর বাংলাদেশের মোস্তাফিজকে নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল তাঁর দলকে। ইএসপিএনক্রিকইনফোকে সে কথা জানাতে গিয়ে মুডি বলেন, ‘প্রথম দিকে ওকে নিয়ে সত্যিই সমস্যায় পড়েছিলাম।’

২০১৬ আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দরাবাদে খেলেন মোস্তাফিজুর রহমান।
বিসিসিআই

হায়দরাবাদ অধিনায়ক ওয়ার্নার তখন মোস্তাফিজের সঙ্গে আকারে–ইঙ্গিতে যোগাযোগ করতেন। একবার তিনি মাঠে মোস্তাফিজকে মাথার দিকে ইশারা করে বোঝাতে চেয়েছিলেন, ‘মাথা খাটিয়ে’ বল করো। কিন্তু মোস্তাফিজ ভেবেছিলেন ব্যাটসম্যানের মাথা লক্ষ্য করে বল করতে বলা হয়েছে। সেই বলে তিনি বাউন্সার দিয়ে বসেন!

মুডি বলেন, ‘এই জায়গায় সতর্ক থাকতে হয়। আপনি ভাবছেন আপনি যা বোঝাতে চাচ্ছেন সেটা পরিষ্কার, কিন্তু খেলোয়াড়টি সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে তা নিচ্ছে। এটা আইপিএলের এক বিশেষ দিক, যা যোগাযোগের সক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে। নিজের দেশের কারও সঙ্গে রসিকতা বা ব্যঙ্গ করা যতটা সহজ, এখানে তা নয়।’

সেবার হায়দরাবাদ দলে মোস্তাফিজ ছাড়া শুধু রিকি ভুইই বাংলা বলতে পারতেন। পশ্চিমবঙ্গের এই ক্রিকেটারকে মোস্তাফিজের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য দোভাষী হিসেবে কাজে লাগাত হায়দরাবাদ। ভুই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মোস্তাফিজ দুইটা জিনিস ভয় পায়। ব্যাটিং করা আর ইংরেজিতে কথা বলা।’

আরও পড়ুন

মোস্তাফিজ অবশ্য ভাষার চ্যালেঞ্জ ভালোভাবেই জয় করেছিলেন। ১৬ ম্যাচে নিয়েছিলেন ১৭ উইকেট, হায়দরাবাদ জিতেছিল শিরোপা, নিজে হয়েছিলেন বিদেশিদের মধ্যে প্রথম উদীয়মান ক্রিকেটার।

মোস্তাফিজকে নিয়ে ভাষা–বিড়ম্বনার কারণেই কিনা কে জানে, ২০১৭ সালে হায়দরাবাদে রশিদ খানকে দলে ভেড়ানোর সময় আরেকজন আফগান সঙ্গে রাখা নিশ্চিত করেন মুডি। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট দুনিয়ায় নতুন পা রাখা রশিদ যাতে কোনো কিছু উল্টো না বোঝেন, সে জন্য মোহাম্মদ নবীকেও দলে নেয় হায়দরাবাদ। টিম মিটিং বা মাঠের মধ্যে দরকারি সময়ে রশিদকে ঠিকঠাক বুঝিয়ে দিতে নবী হয়ে উঠতেন পশতুভাষী। একইভাবে ২০২২ আইপিএলে গুজরাট টাইটানসে রশিদ হয়ে উঠেছিলেন নূর আহমেদের দোভাষী!

এবারের আইপিএলে সব কটি দলই নতুন চেহারা পেয়েছে। আগের আসর থেকে সর্বোচ্চ ৬ জন ধরে রাখতে পারায় মেগা নিলামের পর দলের বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই একসঙ্গে খেলছেন এই প্রথম। তবে এখন না হলেও আগামী এক–দুই দশকের মধ্যে বিদেশি খেলোয়াড়েরা ভারতীয়দের মাতৃভাষায় কথা বলার চেষ্টা করবে বলে মনে করেন নিউজিল্যান্ডের সাবেক কোচ মাইক হেসন। পাঞ্জাব কিংসে কোচিং করানো হেসনের মতে, ‘দিন শেষে এটা তো ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগই!’

আরও পড়ুন