একরকম যেন নিশ্চিতই। প্রথমে ব্যাট করা দল যে স্কোরই তুলুক, রান তাড়া করা দল প্রতিযোগিতায় থাকবে শেষ ওভার পর্যন্ত। কোনো দিন দরকার পড়বে ১২ রান, কোনো দিন বা ২৯। কখনো কখনো ম্যাচ পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকবে শেষ বল পর্যন্তও। সিকান্দার রাজা ৩ রান দৌড়ে একদিন জিতিয়ে দেবেন পাঞ্জাব কিংসকে, অন্য দিন সন্দ্বীপ শর্মা ৩ রান বাকি থাকতে আটকে দেবেন চেন্নাই সুপার কিংসকে।
ফল যা-ই আসুক, নিখাদ ক্রিকেট-বিনোদন উপভোগ করতে বসা দর্শকদের ‘সময় উসুল ম্যাচ’ স্ট্যাটাসে ভরে উঠবে ফেসবুক-টুইটার। আর ফাঁকে ফাঁকে ভেসে আসবে কিছু সংশয়াচ্ছন্ন জিজ্ঞাসা, ‘আইপিএলে এত বেশি জমজমাট ম্যাচ হয় কী করে? ডব্লুডব্লু রেসলিংয়ের মতো এখানেও কোনো চিত্রনাট্য মেনে এগোনো হচ্ছে না তো?’
২০২৩ আইপিএলে যে ধুন্ধুমার লড়াই হচ্ছে, এ নিয়ে তর্কে যাওয়ার সুযোগ নেই একদমই। প্রায় প্রতিটি দলেরই ৯টা ম্যাচ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ১ নম্বর আর ৮ নম্বর দলের পয়েন্ট ব্যবধান ৪। ৬ নম্বরে থাকা দলটা ১ নম্বরে উঠে আসতে পারে ঠিক পরের ম্যাচেই। আর ম্যাচগুলোও কী রোমাঞ্চ ছড়ানো!
আইপিএলে শেষ ওভারে সর্বোচ্চ রান তাড়ার রেকর্ড তো ২৯, এ হিসাবে ২ মে পর্যন্ত হওয়া ৪৪ ম্যাচের অর্ধেকই ‘কী হয়, কী হয়’ প্রশ্ন নিয়ে গড়িয়েছে শেষ ওভারে। এর মাঝে পাঁচটা ম্যাচের নিষ্পত্তি আবার হয়েছে একদম শেষ বলে। শেষ ওভারে খেলা গড়ানোর মানদণ্ড টানলে এ বছরের পিএসএলও খুব একটা পিছিয়ে ছিল না। ৩৪ ম্যাচের ১৪টির ফল জানা গেছে শেষ ওভারে এসে, টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচ আর ফাইনাল ম্যাচে তো একদম শেষ বলে। তখন না হয়ে এখনই যে ক্রিকেটের স্বচ্ছতা প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে, আইপিএলের জনপ্রিয়তার একটা প্রমাণ বোধ হয় এটাও। মানুষ আইপিএলটাই বেশি দেখে।
সে যা-ই হোক, আইপিএলের ম্যাচগুলো এত রোমহর্ষক হচ্ছে কীভাবে, তার ব্যাখ্যা বরং খোঁজা যাক। প্রথম ব্যাখ্যাকে কিছুটা অক্রিকেটীয় আপনি বলতে পারেন। কারণ, মাঠের ক্রিকেটের আগে আইপিএলের লড়াই শুরু হয়ে যায় নিলামের টেবিল থেকেই। যে যতই টাকার কুমির হোক, প্রতি দলকে নিলাম টেবিলে বসতে হচ্ছে একই পরিমাণ অঙ্ক খরচের সুযোগ নিয়ে। দল গঠনের প্রতিযোগিতাই তাই হচ্ছে উচ্চপর্যায়ের। বিশ্লেষক, নিলামে দক্ষ মানুষজনকে ভাড়া করে প্রতিটা দলই চায় এগিয়ে যেতে, তবে লাভের লাভ হয় ঘণ্টা। আখেরে সব দলই হয়ে যায় প্রায় সমশক্তির।
আর দুই বছরে দলও যেহেতু দুটি বেড়ে গেছে, শক্তিমত্তার পার্থক্য কমে এসেছে আরও একটু। বিশেষত, প্রতিটা দলকেই খেলতে হচ্ছে কোনো না কোনো খামতি নিয়ে। চেন্নাই সুপার কিংস যেমন পারেনি নামী কোনো ভারতীয় পেস বোলারকে দলে ভেড়াতে, মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের সমস্যাটা ভালো মানের স্পিনারের অভাব। কলকাতা নাইট রাইডার্স তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পায়নি মাঝের ওভারে শ্রেয়াস আইয়ারের বিকল্প। প্রতিপক্ষের দুর্বলতা খুঁজে পাওয়া যখন এতই সহজ, দলগুলো মাঠে নামার আগেই ভেবে রাখতে পারছে, কাকে কখন, কীভাবে আক্রমণ করা সহজ হবে।
কত উদাহরণ খুঁজবেন? সর্বশেষ গুজরাট টাইটান্স-দিল্লি ক্যাপিটালস ম্যাচে রাহুল তেওয়াটিয়ার টানা তিন ছক্কা বিস্ময়াভিভূত করেছে অনেককেই। বিশেষ করে আনরিখ নর্কিয়ার শেষ বলটাকে প্রায় ওয়াইড লাইন থেকে যেভাবে কাউ কর্নার দিয়ে সীমানা ছাড়া করলেন, তা চোখ ছানাবড়া করেছে অনেকেরই। আর নর্কিয়া বল ছাড়ার আগেই তেওয়াটিয়ার শাফল করে অফ স্টাম্পের বাইরে সরে যাওয়াটা অনেককে করেছে সন্দিগ্ধ।
তবে বলের আগে সম্প্রচারকারী চ্যানেলের দেখানো গ্রাফিকসটা নজরে পড়লেই দূর হয়ে যাওয়ার কথা এই সংশয়। লেগ স্টাম্প লাইনে দুটি ইয়র্কার করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে নর্কিয়া তখন যেতে চাইলেন ওয়াইড ইয়র্কারের পরিকল্পনায়, যা বোঝা গেল তাঁর ফিল্ডিং সাজানো দেখে। ডিপ মিড উইকেটের ফিল্ডারকে বৃত্তের ভেতর এনে সীমানায় পাঠালেন ডিপ পয়েন্টকে। টেলিভিশনের সামনে বসেই যা পড়ে ফেলা যায়, সেই সরল পরিকল্পনা কি আত্মবিশ্বাসে টইটম্বুর হয়ে থাকা তেওয়াটিয়া বুঝবেন না?
তবে টেকনিক-ট্যাকটিকসের ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যাগুলো এতই সরল-সোজা-নির্বিষ যে কুটিল পৃথিবীবাসী এর কোনোটাই না মেনে খুঁজতে চাইছে ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব। তাদের দাবি, প্রতিটা ম্যাচই এমন জমবে, এর কোনো যৌক্তিক কারণ নেই, সব ফিক্সিং।
ক্রিকেট-ইতিহাসে ফিক্সিং হয়নি, এমন দাবির জো নেই। কেবল ম্যাচ পাতানো নয়, বরং ম্যাচের নির্দিষ্ট একটা মুহূর্ত পাতিয়েও লাখ–কোটি টাকা আয়ের সুযোগ আছে। পাতানো খেলা খেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটাররা ভিনদেশের জেলে যাচ্ছেন, এমন ঘটনাও ঘটে গেছে সেই ২০১০ সালে।
তবে এখন পর্যন্ত যত ফিক্সিংয়ের খবর জানাজানি হয়েছে, প্রতিবারই সারমর্ম হিসেবে শোনা গেছে এই বাক্য, ‘অমুক ক্রিকেটার ফিক্সিংয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে খারাপ খেলতে রাজি হয়েছেন।’ কেউ হয়তো কথা দিয়েছেন, কম রানে আউট হয়ে যাবেন। কেউবা রাজি হয়েছেন নো বল, ওয়াইড বল করতে। কিন্তু আগে থেকেই সাজিয়ে ভালো খেলার খবর কি কখনো বেরিয়েছে? কিংবা, ‘আগামীকাল আমি ১৯ নম্বর ওভারের তিন নম্বর বলটায় ছয় মারব’, প্রকাশ্যে এমন ঘোষণা দিয়ে কেউ কি নামতে পেরেছেন?
না, পারেননি। দেয়ালে দেয়ালে আইসিসির সতর্কবাণী, ওত পেতে থাকা আকসুর লোকজন আর হাজার-কোটি দর্শকের কথা বাদই দিন, কেবল মাঠের ভেতরেই পারফরম্যান্স নিয়ন্ত্রণের সূচকের অভাব নাকি! ফিল্ড প্লেসিং দেখে মনে হতেই পারে, একটা বাউন্সার আসতে চলেছে, কিন্তু বোলার হতবুদ্ধি বানিয়ে করে দিলেন স্লোয়ার, ওই বলটাকেও অনায়াসে সীমানা পার করা সম্ভবপর হবে আগের পরিকল্পনাতেই? নর্কিয়ার এক্সপ্রেস গতির বলে বিশাল ছক্কা হাঁকানো তেওয়াটিয়াই না মিসটাইমিং করে ক্যাচ তুলে দিলেন ইশান্ত শর্মার স্লোয়ারে! আর কোনো খেলায় আম্পায়ার কিংবা ম্যাচ পরিচালনাকারীরাও এতটা ক্ষমতাধর হয়ে উঠতে পারেন কি?
২০১০ সালে পাকিস্তানের যে স্পট-ফিক্সিং নাড়িয়ে দিয়েছিল ক্রিকেটের ভিত, সেখানেও এজেন্ট মাজহার মাজিদ বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন, ‘বোলাররা পপিং ক্রিজ পেরিয়ে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে, নো বল ডাকবেন তো আম্পায়াররা, এমন হতেই পারে, তাঁরা দেখলেন না। তখন কিন্তু আমরা কিছু করতে পারব না।’
ব্যাখ্যাটা দেওয়া সম্ভব বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেও। গবেষণায় দেখা গেছে, বলের জবাবে কোনো মানবিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে, মানে বলের লাইন বুঝতে, লেংথ বুঝতে, কত উচ্চতায় উঠবে, এসবে ৩০০ মিলি সেকেন্ড লাগে।
এবার এই উপলব্ধির জবাবে হাত-পায়ের সাড়া দিতে সময় লাগে আরও ৩০০ মিলি সেকেন্ড। কিন্তু, ৯০ মাইল স্পিডে ছোড়া একটা বল ব্যাটসম্যানের স্টাম্প পর্যন্ত যেতে সময় নেয় ৪০০ মিলি সেকেন্ড। স্মরণ করে দেখুন, ব্যাটসম্যান কিন্তু ঠিক স্টাম্প ঘেঁষে দাঁড়ান না। অর্থাৎ, তাঁকে বলটা খেলতে হয় স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখানোর সময়েরও প্রায় অর্ধেক সময়ে। এ কারণেই না ‘লেটিং রিপ’ বইতে সাইমন ওয়াইল্ডকে জন স্নো বলেছিলেন, ‘গতি প্রতিক্রিয়াকেও হারিয়ে দেয়।’
স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া-সময়ের চেয়েও দ্রুতগতিতে কাজ করতে হচ্ছে যে খেলায়, সেখানে স্বেচ্ছায় ভালো খেলা, ম্যাচ জমানো সম্ভব?
হ্যাঁ, ক্রিকেটাররা ঈশ্বর হয়ে উঠলেই তা সম্ভব।