ফিরছে ক্রিকেটের শ্রীলঙ্কান ‘ব্র্যান্ড’
১১ ডিসেম্বর ২০১৯।
কুমিল্লা ওয়ারিয়র্স ও রংপুর রেঞ্জার্সের মধ্যে বিপিএল ম্যাচ। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের মরা উইকেটে আগে ব্যাটিংয়ে নামা কুমিল্লার হয়ে ব্যাট করছিলেন দাসুন শানাকা। ১৭ ওভারের খেলা শেষ। কুমিল্লার রান ৬ উইকেটে ১০৮। ১৪ বলে ১৫ রান করে অপরাজিত শানাকা।
পরের ৩ ওভারে কুমিল্লা ৬৫ রান যোগ করে, শানাকা ইনিংস শেষে অপরাজিত ৩১ বলে ৭৫ রানে। সেদিন রংপুরের পেসার মোস্তাফিজুর রহমানকে ছক্কা মেরে মিরপুর স্টেডিয়ামের গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডের ছাদ পার করে রাস্তায় নিয়ে ফেলেন শানাকা।
২৩ ডিসেম্বর ২০১৯।
সেই শানাকার দলেরই ওপেনার ভানুকা রাজাপক্ষে। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে ঢাকা প্লাটুনের বিপক্ষে ৬৫ বলে ৯৬ রানের ইনিংস খেলেন রাজাপক্ষে। লং হ্যান্ডেলে ব্যাট ধরতে অভ্যস্ত এই বাঁহাতি সেদিন সাতটি ছক্কা মারেন। প্লাটুন জিতলেও লঙ্কান ব্যাটসম্যানের মারার দক্ষতা সেদিন সামনে চলে আসে।
দুই শ্রীলঙ্কানের উদাহরণ দেওয়ার কারণটা পাঠকের এর মধ্যেই বুঝে যাওয়ার কথা। দুজনই কাল এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে জিতিয়েছেন শ্রীলঙ্কাকে। ক্রিজে এসে মতিগতি বুঝেছেন, এরপর দু-চারটি বড় শট খেলে পেশাদার ফিনিশারের মতো ম্যাচটা শেষ করে এসেছেন। এবারের এশিয়া কাপে এর আগেও কয়েকটি ম্যাচের শেষের অধ্যায়টা নিজেদের মতো করে লিখেছেন দুই লঙ্কান। তাঁদের নাম এখন মরুর দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত ছাড়িয়ে ক্রিকেট-বিশ্বের মুখে মুখে।
অথচ এক-দুই বছর আগেও শ্রীলঙ্কার এই ক্রিকেটাররা এত পরিচিত ছিলেন না। কারণ, টি-টোয়েন্টির বাজারে তাঁদের তেমন কোনো পরিচিতি ছিল না। বিপিএলের মতো ছোট লিগে তাঁরা নিয়মিত খেলতেন। আর সেখানেই দেখা যেত তাঁদের প্রতিভা। সে জন্যই ওই দুই বিপিএল ম্যাচের উদাহরণ টানা। ওই দুই ইনিংসেই বোঝা যায়, শ্রীলঙ্কায় টি-টোয়েন্টির প্রতিভা আছে। দরকার ছিল নিজেদের গড়ে তোলা ও সামর্থ্য দেখানোর মঞ্চ। সেটি একমাত্র নিজস্ব টি-টোয়েন্টি লিগ থাকলেই সম্ভব।
২০২০ সালে শুরু হওয়া লঙ্কা প্রিমিয়ার লিগ (এলপিএল) শানাকাদের জন্য ছিল সেই মঞ্চ। এখন পর্যন্ত এই টুর্নামেন্টের দুটি মৌসুম অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাতেই পাল্টে গেছে শ্রীলঙ্কার টি-টোয়েন্টি দলের চেহারা।
মঞ্চ পেয়ে নিজেদের সামর্থ্যের খবর পৌঁছে দিয়েছে বৈশ্বিক টি-টোয়েন্টির বাজারে। দুই এলপিএলে বদলে যাওয়া লঙ্কানদের মধ্যে ছয়জন সর্বশেষ আইপিএলে সুযোগ পেয়েছেন। ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা, দুষ্মন্ত চামিরা, রাজাপক্ষেরা ম্যাচ খেলেছেন নিয়মিত। মহীশ তিকশানা ও মাথিশা পাতিরানার মতো একদম নতুনরাও খেলেছেন আইপিএলের মঞ্চে। চামিকা করুনারত্নেও ছিলেন। অথচ লাসিথ মালিঙ্গার পর আইপিএল যেন শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটকে ভুলতে বসেছিল। ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি লিগ এলপিএল লঙ্কানদের পাখা মেলে ওড়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
একটা টি-টোয়েন্টি লিগ মাঠে নামানোর জন্য কত কাঠখড়ই না পোড়াতে হয়েছে শ্রীলঙ্কাকে। দ্বীপরাষ্ট্রটিতে ২০ ওভারের লিগ প্রথম হয়েছিল ২০১২ সালে—শ্রীলঙ্কা প্রিমিয়ার লিগ। এই টুর্নামেন্টকে ঘিরে যে পরিকল্পনা ছিল বোর্ডের, সেটি শুনলে যে কারও চোখ কপালে উঠবে। সামারসেট এন্টারটেইনমেন্ট ভেঞ্চার্স নামে এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বোর্ডের ২৫ বছরের চুক্তি হয়েছিল এই লিগ নিয়ে।
অথচ এই প্রতিষ্ঠানের টিভি সম্প্রচারের কোনো সুযোগ–সুবিধাই ছিল না। আর লঙ্কান ক্রিকেট বোর্ড ভেবেছিল, ভারতের ক্রিকেটাররা শ্রীলঙ্কায় এসে খেলবেন। তাদের লিগ রাতারাতি বাজার ধরবে।
কিন্তু হলো সম্পূর্ণ উল্টোটা। প্রথম বছর খেলা হবে ঘোষণা দিয়েও হয়নি। পরের বছর টুর্নামেন্টটি মাঠে গড়ায়। কিন্তু শঙ্কা ছিল এর পরের বছর হবে কি না, সেটা নিয়ে। শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার টি-টোয়েন্টি লিগটি আর আলোর মুখ দেখেনি। ২০১২ সালের ওই এক মৌসুমেই শেষ শ্রীলঙ্কার টি-টোয়েন্টি লিগ।
ভাগ্য ভালো, শ্রীলঙ্কার জাতীয় দল তখন বিশ্বসেরা। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ২০ ওভারের খেলাটায় রাজত্ব করেছে লঙ্কানরা। এ সময় ৫৩ ম্যাচ খেলে ৩৪টি জিতেছে মাহেলা-সাঙ্গাকারার দল। এ সময় তারা তিনটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছে, অবশেষে জিতেছে ২০১৪ সালে এসে। তিলকরত্নে দিলশানের বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যাটিং, মাহেলা-সাঙ্গাকারার যুগলবন্দীর পর থিসারা পেরেরার হিটিং ছিল লঙ্কানদের শক্তি।
অজন্তা মেন্ডিসের জাদুকরি বোলিং, রঙ্গনা হেরাথের বাঁহাতি স্পিনের সঙ্গে মালিঙ্গার অবিশ্বাস্য বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে রান করাও ছিল কঠিন। আর ভারসাম্য গড়ে দেওয়ার জন্য অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস তো ছিলেনই। ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি তখন নিয়মিত বোলিংও করতেন তিনি। শ্রীলঙ্কান টি-টোয়েন্টি ছিল এককথায় দেখার মতো।
এরপরই দলটা সাফল্যের উঁচু পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে তলানিতে। অভিজ্ঞদের বিদায়ে শ্রীলঙ্কা দল লম্বা সময় ধরে সংস্কারকাজের মধ্য দিয়ে যায়। এ সময় কোনো ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি লিগ না থাকায় তরুণেরা সেভাবে তৈরি হননি। দেশের বাইরের লিগ তো দূরের কল্পনা।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটার তৈরির জন্য জাতীয় দলকে অতিরিক্ত ম্যাচ খেলতে হতো। শ্রীলঙ্কা সেটাই করেছে। ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ভারতের পর সবচেয়ে বেশি টি-টোয়েন্টি খেলেছে শ্রীলঙ্কা। এ সময় শ্রীলঙ্কা ম্যাচ হেরেছেও বেশি। টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর মধ্যে তারা শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও জিম্বাবুয়ের চেয়ে এগিয়ে ছিল। কিন্তু শ্রীলঙ্কা দলে সব সময় টি-টোয়েন্টি প্রতিভা ছিল। ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি লিগ না থাকায় উন্নতির সুযোগ ছিল না। নিজেদের বিশ্বের অন্যান্য দলের কাতারে নিয়ে যাওয়ার উপায়ও ছিল না। এই সময়ে আবার টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ‘বিশ্লেষণ-বিপ্লব’ ঘটে। সেটার শুরুটা আইপিএলে। এর পর থেকে ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বের সব লিগ হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। নিজেদের ঘরোয়া লিগ না থাকায় এ ক্ষেত্রেও পিছিয়ে পড়ে শ্রীলঙ্কা।
২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এসব কারণেই শ্রীলঙ্কাকে বাছাইপর্ব খেলে মূল পর্বে আসতে হয়েছে। আসন্ন বিশ্বকাপেও বাছাইপর্ব খেলতে হবে। গত পাঁচ বছরের বাজে পারফরম্যান্সের ফল এটি। তবে গত বিশ্বকাপ থেকেই শ্রীলঙ্কা প্রমাণ করছে, তাদের টি-টোয়েন্টির সামর্থ্য কতটুকু। এবারের এশিয়া কাপ পারফরম্যান্স দিয়ে নিশ্চিত করে বলাই যায়, শ্রীলঙ্কায় টি-টোয়েন্টি প্রতিভা আছে।
আর সেই প্রতিভাবানরা এখন টি-টোয়েন্টির হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পাওয়ার মিশনে নেমেছেন। সেটা তাঁরা করতে চান টি-টোয়েন্টির বিপ্লব ঘটিয়ে। কাল ভারতকে হারানোর পর দলটির ফিনিশার রাজাপক্ষের কথায় আছে সে আভাস, ‘আমাদের ক্রিকেটের একটা ব্র্যান্ড ছিল। আমরা সেই ব্র্যান্ড আবার ফিরিয়ে আনতে চাই। খেয়াল করে দেখবেন, নতুন যে ব্যাটসম্যানরা আসছে, তারা হয়তো মেরে খেলতে গিয়ে আউট হচ্ছে। আবার ভালোও করছে। এই স্বাধীনতা আমরা পাচ্ছি ম্যানেজমেন্ট ও নির্বাচকদের পক্ষ থেকে। এটা খুবই ইতিবাচক লক্ষণ।’