এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপের আগে কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশের বোলিং
বেশি দিন আগের কথা নয়। বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণ মানেই ছিল স্পিনারদের দাপট। তিন স্পিনারের দলে থাকবেন দু-একজন পেসার। তাঁদের প্রধান কাজটা হবে নতুন বলটাকে খানিকটা পুরোনো করে স্পিনারদের হাতে তুলে দেওয়া।
দৃশ্যপট বদলেছে, সেটাও অনেক দিন হলো। বাংলাদেশ এখন নিয়মিতই তিন পেসার নিয়ে খেলে। পাওয়ার প্লে, মিডল ওভার কিংবা ডেথ ওভারে—সব জায়গাতেই পেসারদের ভূমিকা থাকে। পেসারদের এই দাপটের পেছনে কি স্পিনারদের কার্যকারিতা কমে যাওয়া? নাকি বোলিং আক্রমণে স্পিন-পেসের সমন্বয়েই চলছে বাংলাদেশ দল? আর পাঁচ দিন পরই এশিয়া কাপ। এরপরই বিশ্বকাপ। ওয়ানডের এই বড় দুই টুর্নামেন্টকে সামনে রেখে কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণ?
কে কোন বিষয়ে ভালো না খারাপ, সেটা যাচাই করার প্রাথমিক উপায় তাঁর অতীত রেকর্ড দেখা। ওয়ানডেতে পেসার না স্পিনার—কার দাপট বেশি, সেটা খুঁজতে চোখটা পরিসংখ্যানেই দেওয়া যাক। সাধারণত যেকোনো দলই নতুন প্রকল্প শুরু করে একটা বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার পর। সে ক্ষেত্রে ২০১৯ বিশ্বকাপের পর থেকে এখন পর্যন্ত ওয়ানডেতে বাংলাদেশের বোলারদের পারফরম্যান্সে তাকানো যাক। যেহেতু এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপ হবে ওয়ানডে সংস্করণেই।
এ সময় বাংলাদেশ ওয়ানডে খেলেছে ৪৫টি, যেখানে বেশি উইকেট পেসারদের। ৪৫ ম্যাচে বাংলাদেশের পেসারদের উইকেট ১৮৯টি। এ সময় ওয়ানডেতে এর চেয়ে বেশি উইকেট নিয়েছেন তিনটি টেস্টখেলুড়ে দেশের পেসাররা—ভারত, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও নিউজিল্যান্ড। ভারত ২০১৯ বিশ্বকাপের পর ম্যাচ খেলেছে ৫৭টি, তাদের পেসারদের উইকেটসংখ্যা ২৫৮। ক্যারিবিয়ানরা ম্যাচ খেলেছে ৬০টি, তাদের পেসারদের শিকার ২৩৩টি উইকেট। কিউই পেসাররা এ সময় মাত্র ৩৬টি ম্যাচ খেলেই নিয়েছেন ১৯৫টি।
পেসারদের উইকেটসংখ্যা বিচারে বাংলাদেশ ৪ নম্বরে থাকলেও গড়ের হিসাবে বাংলাদেশের পেসাররা টেস্টখেলুড়ে দেশের মধ্যে দ্বিতীয়। ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের পর তাসকিনদের চেয়ে ভালো গড়ে বল করেছেন শুধু পাকিস্তানের পেসাররা।
তাসকিন, ইবাদত, মোস্তাফিজরা যেখানে ২৮.৩৩ গড়ে উইকেট নিয়েছেন, সেখানে শাহিন শাহ আফ্রিদি, হারিস রউফরা বল করেছেন ২৭.৪২ গড়ে। ওভারপ্রতি যদিও এ সময় বাংলাদেশের পেসাররা রান খরচ করেছেন ৫.৩৯ ইকোনমিতে। এর চেয়ে ভালো ইকোনমি রেট অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের। অর্থাৎ এই টাইমলাইনে তাসকিনরা শুধু বাংলাদেশি বাস্তবতায় নয়, পারফর্ম করেছেন বিশ্ব ক্রিকেট মানদণ্ডেও।
পেসারদের দাপটে কি স্পিনাররা একেবারেই আড়ালে চলে গেছেন? উত্তরটা না, এ সময় স্পিনাররাও পারফর্ম করেছেন। হয়তো এই সময় বোলিং আক্রমণের নেতৃত্বের ব্যাটনটাই পরিবর্তন হয়েছে। এখন পেসারদের ঘিরেই আবর্তিত হয় বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণ। স্পিনাররা তাঁদের সহায়তা করেন।
২০১৯ বিশ্বকাপের পর ৪৫ ওয়ানডে বাংলাদেশের স্পিনাররা উইকেট নিয়েছেন ১৪৬টি, এই সময়ে এর চেয়ে বেশি উইকেট নিয়েছে শ্রীলঙ্কা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্পিনাররা। শ্রীলঙ্কার উইকেট ১৭৩ আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের ১৬৮টি। মাত্র ২৬ ম্যাচ খেলেই আফগান স্পিনাররা নিয়েছে ১০৫ উইকেট।
তবে গড়ের দিকে থেকে বাংলাদেশের স্পিনাররা শীর্ষে। মিরাজ-সাকিবদের এই সময়ে গড় ছিল ২৭.২২। তালিকায় এর পরের নামটা আফগান স্পিনারদের। তাদের গড় ২৮.৮৪। ইকোনমি রেটের বিবেচনাতেও বাংলাদেশ খুব একটা পিছিয়ে নেই। সাকিব-মিরাজরা ওভার প্রতি খরচ করে ৪.৬০ করে। এর চেয়ে ভালো ইকোনমি রেট আছে শুধু রশিদ-মুজিবদের। তারা ওভার প্রতি খরচ করেছেন ৪.৪১ করে।
আরেকটি তালিকাতেও বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণে পেসার-স্পিনারদের সমন্বয় লক্ষ করা যায়। ২০১৯ বিশ্বকাপের পর বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি উইকেট নিয়েছেন মেহেদি হাসান মিরাজ। ৪০ ইনিংসে তাঁর উইকেট ৫৩টি। তালিকায় এর পরের নামটা একজন পেসারের—মোস্তাফিজুর রহমানের। এই পেসারের উইকেট ৩৫ ম্যাচে ৪৫টি। মোস্তাফিজুর রহমানের পরের নামটা আবার আরেক স্পিনার—সাকিব আল হাসানের। ২৯ ম্যাচে সাকিবের উইকেট ৪৫টি। পরের দুটি নাম আবার দুই পেসার—তাসকিন আহমেদ ও শরীফুল ইসলামের। তাসকিনের উইকেট ৩৬টি আর শরীফুলের উইকেট ২৬টি।
বাংলাদেশ শুধু মিরপুরেই খেলে, এমন একটা কথা আছে দেশের ক্রিকেটে। সেই কথা আপাতত বলা যাচ্ছে না। কারণ, গত ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর বাংলাদেশে মিরপুরে ম্যাচ খেলেছে ৯টি। সমান ৯ ম্যাচ খেলেছে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামেও। সিলেটে সাকিব-লিটনরা খেলেছেন ৬ ম্যাচ। সুতরাং শুধু মিরপুরের প্রিয় উইকেট কাজে লাগিয়েই যে পেসার-স্পিনারদের এই দাপট, সেটা বলার সুযোগ নেই।
২০১৯ বিশ্বকাপের পর স্পিনারদের পারফরম্যান্স
তাহলে কি আশা করতেই পারে বাংলাদেশ? হ্যাঁ, বিশ্বকাপ জেতার আশা সবার কাছে একটু বাড়াবাড়ি মনে হতেই পারে, কিন্তু এশিয়া কাপ? এই ট্রফি জয়ের স্বপ্নটাও বাড়াবাড়ি? মনে হয় না, কারণ, এশিয়া কাপে এর আগে যে তিনবার ফাইনাল খেলেছে বাংলাদেশ।
তিনটি ফাইনালেই হেরেছে বাংলাদেশ। যার মধ্যে ২০১৬–এর ফাইনালে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়ে তুলতে পারেনি। তবে অন্য দুটি ফাইনালে হেরেছে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে। ভাগ্যের সহায়তা পেলে হয়তো অন্তত একবার হলেও ট্রফিটা আসত সাকিব-তামিমদের হাতে। তাই কোনো দৃষ্টিতে এশিয়া কাপ জয়ের স্বপ্নটা বাংলাদেশের জন্য বাড়াবাড়ি নয়। তবে সারা বছর ভালো করে যদি বোলাররা ‘ফাইনাল’ পরীক্ষায় ভালো করতে না পারেন, সে ক্ষেত্রে যেকোনো ট্রফি জয়ের আশা করাই বাড়াবাড়ি।