সানিয়া-শোয়েব: ‘বাই চান্স’ দেখা, প্রেম, বিয়ে নিয়ে তুলকালাম এবং ...
খেলার দুনিয়ায় ভারত-পাকিস্তানের বিখ্যাত প্রেমের কথা বললে একসময় মহসিন খান-রীনা রায়ের উদাহরণ আসত। সাবেক পাকিস্তানি ওপেনিং ব্যাটসম্যান মহসিন খান অবশ্য ভারতীয় কোনো খেলোয়াড়কে নয়, বিয়ে করেছিলেন বলিউড অভিনেত্রী রীনা রায়কে। বছর দশেক পর ভেঙে গিয়েছিল তাঁদের সেই সংসার। এর আগে-পরে ভারত-পাকিস্তানের অনেক জুটির প্রেমের গুঞ্জন শোনা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলো ছিল পাকিস্তানি ক্রিকেটার ও বলিউডের নায়িকাদের নিয়ে। ইমরান খান-জিনাত আমান (মুনমুন সেন এবং রেখার নামটাও যোগ করে নিতে পারেন), ওয়াসিম আকরাম-সুস্মিতা সেন, শোয়েব আখতার-সোনালি বেন্দ্রে—সবই শেষ পর্যন্ত গুঞ্জনই রয়ে গেছে। তবে সব ছাপিয়ে এখন পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তানের সবচেয়ে বিখ্যাত জুটি সম্ভবত শোয়েব মালিক-সানিয়া মির্জা। সাবেক পাকিস্তান অধিনায়ক মালিকের সঙ্গে ভারতীয় টেনিসের গ্ল্যামার গার্ল সানিয়ার প্রেম ও বিয়ে নিয়ে হয়েছে তুমুল মাতামাতি। কীভাবে হয়েছিল দুজনের প্রেম এবং তারপর বিয়ে, তা নিয়ে সানিয়া বিস্তারিত লিখেছেন তাঁর আত্মজীবনী ‘এইস এগেইনস্ট অডস্’ বইয়ে। সেই বইয়ের ‘ফাইন্ডিং লাভ’ অধ্যায় থেকে আজ থাকছে দুজনের সেই প্রেমের গল্প। তবে পড়ার সময় এটা মনে রাখতে হবে, বইটা যখন সানিয়া লিখেছেন, তখনো শোয়েবের সঙ্গে তাঁর সুখের সংসার। যে সংসার পরে ভেঙে যাওয়ার খবর এসেছে এ বছর জানুয়ারিতে।
প্রথম দেখা
কোনো এক অদ্ভুত কারণে একেবারেই ছোট্টবেলা থেকে আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে বয়স ২৩ হওয়ার আগেই আমার বিয়ে হয়ে যাবে। আমি বরাবরই কিছুটা সনাতনী চিন্তাভাবনার, আজও অনেক বিষয়ে তা-ই। ভেবেছিলাম, বিয়ের পর টেনিস খেলা ছেড়ে দেব, আর ২৭-২৮ বছর বয়সের মধ্যে আমার সন্তান হবে। জীবনটা ঠিক এমনই কল্পনা করেছিলাম। এখন আমার প্রায় সব বন্ধুই বিবাহিত এবং সন্তানের মা-বাবা। হয়তো আমার চারপাশে বেড়ে ওঠার সময় সবাই যে ধরনের জীবন দেখেছি, আমিও সেই ছকেই মনের মধ্যে একটা পরিকল্পনা তৈরি করেছিলাম। কিন্তু বড় হতে হতে আমরা বুঝতে পারি, জীবন সব সময় পরিকল্পনা অনুযায়ী চলে না।
সোহরাবের (সোহরাব মির্জা, সানিয়ার প্রাক্তন প্রেমিক) সঙ্গে বিচ্ছেদের পর, আমার কিশোরী বয়সের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে গিয়েছিল। ২৩তম জন্মদিনের পরপরই দীর্ঘস্থায়ী কবজির চোট কাটিয়ে আমি টেনিসে ফেরার লড়াইয়ে নামলাম অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে। আর সেখানেই, ২০১০ সালের শুরুতে, ছোট্ট সুন্দর শহর হোবার্টে আমার জীবনে আরেকটা নাটকীয় বাঁক এল।
সেই সন্ধ্যায়, আমার বাবা, আমার ট্রেইনার লেন (চং) এবং আমি পরিচিত একটা ভারতীয় রেস্তোরাঁয় গেলাম। বছরের প্রথম গ্র্যান্ড স্লামের আগে একটি টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়েছিলাম আমি, উঠেছিলাম ওল্ড উলস্টোর হোটেলে। হোটেল থেকে কয়েক শ গজ দূরে একটা জলধারার পাশেই সেই রেস্তোরাঁ। এর কয়েক দিনের মধ্যেই পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একটি টেস্ট খেলার কথা ছিল।
রেস্তোরাঁয় ঢুকে এক আনন্দময় বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, কয়েকজন পাকিস্তানি ক্রিকেটার সেখানে রাতের খাবার খাচ্ছেন।
কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক শোয়েব মালিকও সেই রেস্তোরাঁয় এল এবং টেবিলের খোঁজে আমরা যেখানে বসে ছিলাম, সেদিকে এগিয়ে এল। আমাকে দেখেই শোয়েব এগিয়ে এসে ‘হ্যালো’ বলল, তারপর বাবাকে সালাম দিল।
কয়েক বছর আগে, পাকিস্তান যখন ভারতে একটি সিরিজ খেলছিল, তখন দিল্লির এক হোটেলের জিমে এক সাংবাদিক আমাদের দুজনকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সেটা অবশ্য খুব অল্প সময়ের জন্য। আরেকবার মোহালির একটি হোটেলে ব্রেকফাস্ট লাউঞ্জে আমি তাকে দেখেছিলাম। আমি সেই হোটেলে গিয়েছিলাম ভারত-পাকিস্তানের একটি ওয়ানডে ম্যাচ দেখতে।
পরের সন্ধ্যায় আমার একটা ম্যাচ ছিল, শোয়েব সেটা দেখার আগ্রহ প্রকাশ করার পর আমি তার জন্য কয়েকটি টিকিটের ব্যবস্থা করি। সে তার কয়েকজন সতীর্থকে নিয়ে খেলা দেখতে এসেছিল। ম্যাচের পরে, আমার বাবা ওদের সবাইকে একই ভারতীয় রেস্তোরাঁয় ডিনারের আমন্ত্রণ জানান। অন্য একটা কাজ থাকলেও শোয়েব সেই প্রস্তাব গ্রহণ করল।
সেই শুরু। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে আমাদের ম্যাচ। ওর এক জায়গায়, আমার অন্য জায়গায়। কিন্তু আমরা ফোনে যোগাযোগ রেখেছিলাম। ওর যে জিনিসটা প্রথমেই আমাকে আকৃষ্ট করেছিল, তা হলো ওর সরলতা। সে তার দেশের সাবেক অধিনায়ক এবং তখনকার দলের সিনিয়র খেলোয়াড়। কিন্তু বিখ্যাত মানুষ হওয়ার কোনো প্রভাব ওর মধ্যে পড়েনি।
কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল, আমরা আকাশের নিচের প্রায় সবকিছু নিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম এবং বুঝতে পারলাম, আমাদের মধ্যে বেশ ভালো মিল। তবে প্রেম তখনো অনেক দূরে ছিল।
তাহলে ‘বাই চান্স’ নয়
এক মাস পরে, আমি দুবাই ওপেনে খেলতে গেলাম। শোয়েব তখন একই শহরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে পাকিস্তানের অধিনায়কত্ব করছিল। ওই সিরিজের জন্য তাকে আবার পাকিস্তানের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সম্ভবত সর্বশক্তিমানই আমাদের দুজনকে একত্র করছিলেন, এক অপ্রত্যাশিত মিলনের পথ তৈরি করছিলেন। শোয়েবের সঙ্গে আমার মায়ের দেখা হলো, আমার মা-ও ওকে খুব পছন্দ করলেন।
কয়েক মাস পর শোয়েব আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ও খুব নাটকীয় মানুষ নয়, প্রপোজও করেছিল খুব সহজ-সরলভাবে। আমাকে বলল, যা-ই ঘটুক না কেন, ও আমাকে বিয়ে করতে চায়। নিজের পরিবারকে সে-ই বোঝাবে।
অনেক মাস পরে, তখন আমরা বিবাহিত, এক সন্ধ্যায় দুজন বসে গল্প করছি, আমি তাকে অবাক হয়ে বলেছিলাম, ‘ভাবো তো, সেদিন যদি তুমি সেই রেস্তোরাঁয় না আসতে, আমাদের তো দেখাই হতো না।’ তখন সে আমাকে হেসে হেসে বলল, সেদিন সন্ধ্যায় হোবার্টের সেই রেস্তোরাঁয় তার আসাটা পুরোপুরি কাকতালীয় ছিল না!
তার এক সতীর্থ, যে আগে থেকেই সেই রেস্তোরাঁয় ছিল, শোয়েবকে ফোন করে বলেছিল, আমি সেখানে ডিনার করছি। শোয়েবের বাইরের খাওয়া খুব একটা পছন্দ না। কিন্তু আমাকে দেখার জন্যই সে তাড়াহুড়ো করে সেই রেস্তোরাঁয় চলে এল। ও নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছিল, যেভাবেই হোক, সেদিন আমার নম্বর নেবেই। আমরা এখনো এটা নিয়ে মজা করি, আমি যে রকম ভেবেছিলাম, আমাদের দেখাটা সে রকম ‘বাই চান্স’ ছিল না!
বিয়ের সিদ্ধান্ত
বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা আমি খুব স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলাম। আমি বরাবরই বিয়ের ব্যাপারে কিছুটা রক্ষণশীল ছিলাম। আমি মনে করতাম না যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দীর্ঘদিন সম্পর্কে থাকা খুব জরুরি। তা ছাড়া আমাদের সম্পর্ক গোপন রাখাও দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছিল। আমরা দুজনই পরিচিত মুখ। তারপরও কিছুদিন আমরা এটা লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলাম। এরপর যখন আমাদের সম্পর্কের কথা প্রকাশ্যে এল, সবাই-ই বেশ বিস্মিত হলেন।
আমি মায়ের কাছে শোয়েবের কথা বললাম, ও নিজের মায়ের সঙ্গে আলোচনা করল। মার্চ মাসে, ওর পরিবার—মা, বোন, দুলাভাই ও তাদের দুই সন্তান—ভারতে এল এবং আমাদের অতিথি হয়ে থাকল। তিন দিন পর, আনুষ্ঠানিকভাবে ওর পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব করা হলো, আমার বাবা-মা তা গ্রহণ করলেন, যদিও শোয়েবের জাতীয়তা নিয়ে তাদের কিছু উদ্বেগ ছিল।
আমি এটা বুঝতাম, শোয়েব এমন একটি দেশের নাগরিক, যে দেশের সঙ্গে আমার দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক জটিল। কিন্তু আমি টেনিস সার্কিটে বড় হয়েছি, যেখানে বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন ধর্ম, জাতি ও সংস্কৃতির অসংখ্য মানুষের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। এই অভিজ্ঞতা আমার দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করেছিল। এতটাই যে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমি এসব সীমানার বাইরে গিয়ে ভাবতে পারতাম। খেলোয়াড় হিসেবে আমরা এ ধরনের সীমাবদ্ধতা ভুলে যাই।
একেবারে শুরুতেই আমি শোয়েবের সঙ্গে আমার ক্যারিয়ার নিয়ে কথা বলেছিলাম। সে খুব স্পষ্ট করে বলল, বিয়ের পর আমার খেলা চালিয়ে যাওয়াতে তার কোনো আপত্তি নেই। তবে আমি চেয়েছিলাম সে তার পরিবারের সঙ্গেও কথা বলে এটি নিশ্চিত করুক এবং সেটা আমাদের বিয়ের আগেই আমাকে জানাক। তার মা-ও এ বিষয়ে খুব স্পষ্ট ছিলেন এবং উদার মনোভাব পোষণ করতেন। আজও তারা আমার ক্যারিয়ার নিয়ে ঠিক ততটাই গর্বিত, যতটা আমার নিজের পরিবার। শোয়েবের পরিবারে আগেও অনেকে খেলাধুলা করতেন। সম্ভবত এ কারণেই তারা আমার লাইফস্টাইল ও চ্যালেঞ্জগুলো ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে, এটাই আমাদের সম্পর্কের অন্যতম শক্তিশালী দিক। খেলোয়াড় হিসেবে আমরা দুজনেই দীর্ঘদিন বাড়ি থেকে দূরে থাকায় অভ্যস্ত ছিলাম। বছরের পর বছর আমরা এভাবেই জীবনযাপন করেছি, তাই একে অন্যের থেকে দূরে থাকার মানসিক প্রস্তুতিও আমাদের ছিল। দূরত্ব ও দীর্ঘ বিচ্ছেদের ধাক্কা কীভাবে সামলাতে হয়, সে অভিজ্ঞতা আমাদের দুজনকেই এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে।
দুঃস্বপ্নের দিনরাত্রি
শোয়েব এবং আমি দুজনেই ভিন্ন কারণে খেলাধুলার জগৎ থেকে সাময়িকভাবে দূরে ছিলাম। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে করে এই বাধ্যতামূলক বিরতিটিকে অর্থবহ করে তুলব। আমি পুরোপুরি ডুবে গেলাম বিয়ের প্রস্তুতিতে। এটি আমাকে আমার চোটের চিন্তা থেকে দূরে রাখল এবং মানসিকভাবে চাঙা থাকতে সাহায্য করল। আমাদের ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে পরিকল্পনা করা, ছোট ছোট খুঁটিনাটি বিষয় ঠিক করা—সবকিছুই ছিল দারুণ উপভোগ্য।
আমরা দুজন মিলে ঠিক করলাম, দুবাই হবে আমাদের নতুন ঠিকানা। ভৌগোলিক অবস্থান ও অন্যান্য দিক থেকে এটি ছিল আমাদের জন্য আদর্শ, কারণ এখান থেকে আমাদের নিজ নিজ দেশে যাওয়াও সুবিধাজনক।
শোয়েব সেই সময় বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে খেলার জন্য চুক্তিবদ্ধ ছিল এবং সেই সিরিজ শেষে ভারতে আসার পরিকল্পনা করেছিল। ঠিক করলাম, সে হায়দরাবাদে পৌঁছানোর পরই আমরা বিয়ের ঘোষণা দেব। কিন্তু এরপর যা ঘটল, তার জন্য আমরা একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না।
আমাদের পরিকল্পনা ছিল, শোয়েব ভারতে পৌঁছানো পর্যন্ত সবকিছু গোপন রাখা। কিন্তু তা সফল হলো না। তার আসার কয়েক দিন আগেই সংবাদমাধ্যমে আমাদের সম্ভাব্য বিয়ে নিয়ে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল। আসলে দুই দেশের দুই পরিচিত ক্রীড়াবিদের বিয়ের খবর দীর্ঘদিন লুকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না। কোনো না কোনো সূত্র থেকে এ খবর ঠিকই ফাঁস হয়ে গেল।
৪ এপ্রিল শোয়েব দুবাই থেকে হায়দরাবাদে পৌঁছাল। বিমানবন্দর থেকে বেরোনোর সময় সে মুখ ঢাকার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল। কারণ, আশপাশে তখন অনেক মানুষ, যারা সহজেই তাকে চিনে ফেলতে পারত। বাবা আর আমি পার্কিংয়ে অপেক্ষা করছিলাম। আমার এক চাচা ভেতরে গিয়ে তাকে রিসিভ করলেন।
আমাদের কারোরই ওই পরিস্থিতি সামলানোর সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা ছিল না। শুধু চেষ্টা করছিলাম যাতে কোনো অপ্রত্যাশিত নাটকীয়তা এড়ানো যায়। শোয়েবও চেষ্টার কোনো কমতি রাখেনি। কিন্তু সে একেবারেই ভুলে গিয়েছিল যে তার হাতে থাকা ব্যাগে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল—‘Pakistan Cricket Team-Shoaib Malik’!
আমার চাচা লেখাটা দেখে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ব্যাগের ওপর, যেন কোনোভাবেই ওটা কারও চোখে না পড়ে! কিন্তু কেউ কেউ হয়তো দেখে ফেলেছিল। আর এভাবেই শুরু হলো সেই উন্মাদনা। পরবর্তী কয়েকটা দিন আমাদের জন্য হয়ে গেল ভীষণ ক্লান্তিকর, হতাশাজনক, মাঝেমধ্যে হাস্যকরও বটে। আমাদের জীবনের সে এক বিস্ময়কর অধ্যায়।
পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠল, যখন এক নারী আমার হবু স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললেন। এরপর দুই দেশের কিছু নির্দিষ্ট সংবাদমাধ্যম এ ঘটনাকে ব্যক্তিগত পরিসর থেকে টেনে এনে জনসমক্ষে বিচারের নামে এক নিষ্ঠুর উপহাস শুরু করল। ভারতে শুরু হলো এক ভয়ংকর ‘মিডিয়া ট্রায়াল’। সাংবাদিকেরা একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলো, যেন ‘বিদেশি বর’কে একেবারে ধ্বংস করে দেওয়াই তাদের লক্ষ্য।
অনেকেই একটুও ভাবল না, এটি আমার ব্যক্তিগত জীবনে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। শুধু টিআরপি বাড়ানোর তাড়নায়, সত্য না জেনেই তারা সব রকম চেষ্টা করল আমার ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে আমার সম্পর্ক নষ্ট করার।
ওই দুটি সপ্তাহ সংবাদমাধ্যম সম্পূর্ণ বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল—এ কথা বললে মোটেও ভুল হবে না। প্রায় দুই শ সাংবাদিক, ক্যামেরা ও মাইক্রোফোন, ফাইল ও কলম হাতে আমাদের বাড়ির বাইরে গেড়ে বসেছিল। কেউ আমাদের বাড়িতে আসতে বা বাড়ি থেকে বেরোতে গেলেই ওরা তার পিছু নিত, প্রশ্নবাণে জর্জরিত করত। এক ডজনেরও বেশি স্যাটেলাইট ভ্যান সরু গলির একপাশে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকত, দিনের পর দিন ঘরের বাইরে থেকে তোলা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ফুটেজ সম্প্রচার করে চলত।
বাড়ির চারপাশে ক্যামেরা বসিয়ে দিনরাত রেকর্ডিং চলত। এমনকি আশপাশের উঁচু ভবনগুলোর ওপরেও ক্যামেরা ক্রুদের পাঠানো হয়েছিল, যেন তারা প্রতিটি কোণ থেকে নজরদারি করতে পারে। জানালার পর্দা এক ইঞ্চি সরলেও ঘরের ভেতরে আমাদের সাধারণ কোনো কাজ করতে দেখা গেলেও কিছু নিউজ চ্যানেল সেটিকে অবিশ্বাস্য রকমের কল্পনাপ্রবণ বিশ্লেষণসহ সম্প্রচার করত! সবকিছু এতটাই অদ্ভুত এবং অবিশ্বাস্য ছিল যে আমাদের কাছে তা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হতে লাগল।
সেই পাগলাটে সময়ের একদিন হঠাৎ আমার বাবার ফোন বেজে উঠল। ফোনের ওপাশে থাকা এক আত্মীয় আতঙ্কিত কণ্ঠে প্রায় চিৎকার করে বললেন, ‘সানিয়া কি সবুজ টি-শার্ট পরেছে?’ বাবা ‘হ্যাঁ’ বলতেই, উনি আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘একদম পর্দা টেনে দাও! পাশের নির্মাণাধীন ভবনের ওপরে ক্যামেরা লাগানো আছে, ওরা এখন ওকে লাইভ দেখাচ্ছে!’
আমি প্রায় ১০ দিন সূর্যের আলো দেখতে পাইনি। সব জানালা—এমনকি বাথরুমের ছোট ছোট খোপগুলোও (ভেন্টিলেটর) বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। বাড়ির কোনো দৃশ্য যাতে বাইরে না যায়, সে জন্য প্রতিটি ফাঁকফোকর ঢেকে ফেলা হয়েছিল। ব্যালকনিতে একটু নিশ্বাস নিতে যাওয়া মানেও যেন বিপদকে আমন্ত্রণ জানানো!
এক সপ্তাহ পর আমাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। আমরা ঠিক করলাম, আমাদের একটু মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস নিতেই হবে। তাই গভীর রাতে আমরা বাইরে বেরোলাম, শুধু একটু আইসক্রিম খাওয়ার জন্য। ভাবলাম, এত রাতে হয়তো সাংবাদিকদের ভিড় কমে গেছে, তাদের নজরদারিও শিথিল হয়েছে। কিন্তু আমরা ভুল করেছিলাম। তারা আমাদের পিছু নিল, আমাদের গাড়ির জানালা দিয়ে ক্যামেরা ঢুকিয়ে আমাদের প্রতিটি মুহূর্ত ধারণ করল—কীভাবে আমরা আইসক্রিম কিনছি, কীভাবে গাড়ির ভেতর বসে খাচ্ছি—সবকিছু।
এখানেই শেষ নয়। বাবা যখন জুম্মার নামাজ পড়তে মসজিদে গেলেন, তখনো কিছু সাংবাদিক তার পিছু নিল। তিনি তাদের ছবি তোলা ও রেকর্ডিং করার সরঞ্জাম নিয়ে মসজিদে ঢুকতে বাধা দিলেন। কিন্তু দুজন চুপি চুপি ঠিকই ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। তারা নামাজের সময় বাবার দুই পাশে দাঁড়িয়ে রইল এবং নামাজ শেষ হওয়ার আগেই লুকানো মাইক্রোফোন বের করে হাস্যকর সব প্রশ্ন করতে শুরু করল!
এরপর খোলাখুলি চরম নোংরামি শুরু হলো। কিছু সুবিধাবাদী সংবাদকর্মী এ ঘটনাকে ‘সুবর্ণ সুযোগ’ বলে ধরে নিলেন এবং সত্য, শালীনতা বা ন্যূনতম মানবিকতার তোয়াক্কা না করেই ব্যক্তিগত বিষয়গুলোকে বিকৃত করে উপস্থাপন করতে লাগলেন। হতবাক আমার বিস্ময়ের সীমা ছাড়িয়ে গেল, যখন দেখলাম শহরের কিছু তথাকথিত সুশীলও তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন। শুধু টেলিভিশনে মুখ দেখানোর সুযোগ পেতে তাঁরা উদ্গ্রীব হয়ে উঠলেন!
নতুন নতুন গুজব ছড়ানো শুরু হলো। আমার হবু স্বামীর একটি বিকৃত, ভয়ংকর চরিত্র তৈরি করা হলো। সেই কাহিনিকে যত দিন সম্ভব বাঁচিয়ে রাখা যায়, যত বেশি দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়—এই লক্ষ্যে তারা নিরলস চেষ্টা চালিয়ে গেল।
হঠাৎই একটি বিশেষ সংবাদমাধ্যম নতুন বিতর্ক উসকে দিল—বিয়ের আগে শোয়েব কীভাবে আমাদের বাড়িতে থাকতে পারে? কীভাবে এক কনে তার হবু স্বামীকে নিজের ঘরে থাকতে দিতে পারে? ইসলামে কি এটা অনুমোদিত?
এই প্রশ্নগুলো যেভাবে ছোড়া হচ্ছিল, তাতে বিন্দুমাত্র সংবেদনশীলতার ছাপ ছিল না। এবার ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের টেনে আনা হলো, ক্যামেরার সামনে তাঁদের মতামত চাওয়া হলো, অথচ পুরো বিষয়টাই ছিল ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। সত্যিটা ছিল, শোয়েব একাই শুধু আমার বাড়িতে ছিল না, আমাদের উভয় পরিবারের উপস্থিতিতেই ছিল এবং আমরা দুজন সম্পূর্ণ আলাদা ফ্লোরে ছিলাম। কিন্তু মিডিয়া বিতর্ক উসকে দেওয়ার জন্য সত্য-মিথ্যার কোনো ফারাক বা তোয়াক্কা করেনি।
যতই দিন গড়াতে থাকল, কোনো কোনো সাংবাদিক যেন বাস্তববোধও হারিয়ে ফেললেন। তবে যখন এই বিতর্ক যথেষ্ট উত্তেজনা ছড়াল, তখন দুই পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো—শোয়েব বিয়ের আগের দিন হোটেলে চলে যাবে, যাতে এই অপ্রয়োজনীয় আলোচনা বন্ধ হয়। কিন্তু বড় প্রশ্ন ছিল—যেভাবে মিডিয়া আমাদের বাড়ির বাইরে সারাক্ষণ পাহারা দিচ্ছে, এর মধ্যে কীভাবে আমরা তাকে বাইরে নিয়ে যাব!
ঠিক তখনই আমার এক চাচা একটা পরিকল্পনা করলেন। তিনি বাইরে বেরিয়ে গেলেন এবং ফোন কানে নিয়ে জোরে জোরে এমনভাবে কথা বলতে লাগলেন, যেন কোনো ভয়ানক ঝগড়া চলছে! সাংবাদিকেরা ভাবল, হয়তো বড় কোনো খবর পাওয়া যাবে, তাই সবাই তার চারপাশে ভিড় করল। আর সেই সুযোগে, শোয়েব একটা গাড়ির পেছনে শুয়ে পড়ল। ওটা ছিল ছোট্ট একটা গাড়ি, যা সাধারণত আমাদের বাসার বাজার করার জন্য ব্যবহৃত হতো। চাচা দক্ষতার সঙ্গে মিডিয়ার ভিড়কে ব্যস্ত রাখলেন, আর শোয়েব গাড়ির পেছনে শুয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গিয়ে সরাসরি হোটেলে চেক-ইন করল।
এই অদ্ভুত উন্মাদনার মধ্যেও আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা চলতে থাকল। বাইরে মিডিয়ার বিরামহীন অপেক্ষা, ভেতরে চলছে আমার কাছের বন্ধু আর পরিবারের সদস্যদের নাচের রিহার্সাল। আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু, জনপ্রিয় টেলিভিশন তারকা রাকশান্দা খান এসেছিল। বলিউড অভিনেত্রী নেহা ধুপিয়াও দারুণ নাচল, শুধু আমার বিয়ের জন্যই সে হায়দরাবাদ এসেছিল।
এখন যখন আমরা পেছন ফিরে তাকাই, তখন হাসির পাশাপাশি খুব বিস্ময়করও লাগে—সত্যিই কি এমনটা ঘটেছিল? এমন হট্টগোলের মধ্যে কীভাবে আমরা নিজেদের স্থির রেখেছিলাম?
পরিবারের অনেকেই তখন চিন্তিত হয়ে পড়েছিল—আসলেই কি এই বিয়ে হবে? কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছিল, বিয়ে পিছিয়ে দেওয়া হোক। কিন্তু শোয়েব দৃঢ়স্বরে বলল, ‘আমি এখানে তোমাকে বিয়ে করতে এসেছি, বিয়ে না করে ফিরে যাব না।’
বিয়ের আগের রাতে আমার মা পুরোপুরি ভেঙে পড়লেন। এত দিনের চাপে, অবিশ্বাস্য ক্লান্তিতে তিনি হঠাৎ কান্না শুরু করে দিলেন। কিন্তু বাবা বললেন, ‘যেকোনো কঠিন সময়ে হাসিমুখে, দৃঢ় মনোবলে এগিয়ে যেতে হবে, এটাই মির্জা পরিবারের ঐতিহ্য।’ তাঁদের অকুণ্ঠ সমর্থন না পেলে আমি ওই কঠিন সময়টা পেরোতে পারতাম না।
এবং বিয়ে
১২ এপ্রিল ২০১০। অবশেষে ভালোবাসার টানে এক পাকিস্তানি ছেলে আর এক ভারতীয় মেয়ের মিলন হলো। এক নজিরবিহীন মিডিয়া-তাণ্ডবের মধ্যেও আমাদের বিয়ে হলো। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় মুহূর্তে, যখন আমি বউয়ের সাজে সজ্জিত, তখন আমার ব্যক্তিগত গাড়িকে একদল সংবাদকর্মী আমার বাড়ি থেকে তাজ কৃষ্ণা হোটেল পর্যন্ত তাড়া করল।
নিরাপত্তার কথা ভেবে, আমাকে হোটেলের পেছনের সার্ভিস দরজা দিয়ে ঢোকানো হলো—একেবারে রান্নাঘরের পথ ধরে! আমি জানি না আর কারও বিয়েতে এমন হয়েছে কি না। ইতিহাসে এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি! তবে হোটেলে ঢুকে যাওয়ার পর আর কোনো ঝামেলা হয়নি। সংগীতসন্ধ্যা, বিবাহোত্তর সংবর্ধনা ভালোভাবেই হয়ে গেল।
যেন এক অগ্নিপরীক্ষার পর মধুরেণ সমাপয়েৎ। সন্ধ্যায় হোটেলের ব্যালকনিতে বসে আমরা স্বামী-স্ত্রী স্নিগ্ধ বাতাস উপভোগ করছিলাম। ঝেপে আসা চোখের জল সামলে আমি শোয়েবকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এত মানুষ তোমার সঙ্গে এত অন্যায় করেছে…আমি ভাবতেও শিউরে উঠি। ওরা কি নিজেদের মুখ কখনো আয়নায় দেখে না, কীভাবে তারা সৃষ্টিকর্তার সামনে দাঁড়াবে?’
শোয়েব শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘আল্লাহ ওদের মাফ করুক।’ তার চোখে কোনো বিদ্বেষ ছিল না।
আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
কারণ আমি জানতাম, সঠিক মানুষকেই বেছে নিয়েছি।
পাঠকের জন্য তথ্য
শোয়েব মালিক-সানিয়া মির্জার বিয়ের সময় ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোয় একের পর এক খবর বের হতে থাকে যে বলিউড অভিনেত্রী শায়ালি ভাগাতের সঙ্গে শোয়েবের প্রেম ছিল। সাবেক মিস ইন্ডিয়া ওয়ার্ল্ড শায়ালি অবশ্য পরে বলেছেন, এগুলো গুঞ্জন। মালিকের সঙ্গে জুটি বেঁধে একটা বলিউডি সিনেমায় অভিনয় করার কথা ছিল তাঁর। সেই ছবি হিট করাতেই এমন কৌশল নেওয়া হয়েছে। পরে অবশ্য দুজন কোনো সিনেমায় একসঙ্গে অভিনয় করেননি, মালিকের বলিউডে অভিষেকও হয়নি। ২০১০ সালে সানিয়াকে বিয়ের পর ২০১৮ সালে সন্তানের বাবা-মা হন শোয়েব-সানিয়া দম্পতি। তাঁদের কোলজুড়ে আসে ছেলে ইজহান মির্জা মালিক। এ বছর জানুয়ারিতে সানিয়ার পরিবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়, কয়েক মাস আগে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে শোয়েব-সানিয়ার। জানুয়ারি মাসেই শোয়েব বিয়ে করেন পাকিস্তানের টেলিভিশন অভিনেত্রী সানা জাভেদকে। শোয়েব-সানিয়ার ছেলে ইজহান আপাতত মায়ের কাছেই থাকে। সে পড়ে দুবাইয়ের এক স্কুলে।