একসময়ের বিশ্বসেরা বোলার এখন হিসাবরক্ষক

সেই ব্র্যাকেন (বাঁয়ে), এই ব্র্যাকেনছবি: আইসিসি, ইনস্টাগ্রাম

মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখে চিকন রিমের চশমা, পরনে ফরমাল শার্ট-প্যান্ট। বেশভূষা দেখলে যে কারও মনে হবে তিনি করপোরেট জগতের লোক। অথচ এই মানুষটিই এক সময় ছিলেন আইসিসি ওয়ানডে র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ বোলার, মাথায় ছিল ঝাঁকড়া চুল, বোলিংয়ের সময় পরতেন হেয়ার ব্যান্ড, আম্পায়ারের কাছে আবেদন করতেন আগ্রাসী মেজাজে, উইকেট শিকারের পর করতেন বুনো উদ্‌যাপন। সময়ের বিবর্তনে এখন আর তাঁকে যেন চেনার উপায় নেই।

তবে ছবি দেখার পর তাঁর নাম মনে পড়েছে নিশ্চয়ই! নাথান ব্র্যাকেন, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক বাঁহাতি পেসার। দুটি ওয়ানডে বিশ্বকাপ ও একটি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জেতা ব্র্যাকেন হাঁটুর চোটের কারণে ২০১১ সালে খেলোয়াড়ি জীবনকে বিদায় জানিয়েছেন। দীর্ঘস্থায়ী চোটে ভুগতে থাকার পরও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ) তাঁর যথাযথ পরিচর্যা করেনি—এমন অভিযোগ তুলে বোর্ডের বিরুদ্ধে মামলাও ঠুকে দিয়েছিলেন। এরপর নানা পেশা ঘুরে তিনি এখন সিডনিভিত্তিক একটি নির্মাণসামগ্রী প্রস্তুতকারক কোম্পানির হিসাবরক্ষক।

ব্র্যাকেনের শিক্ষাগত যোগ্যতা একেবারেই কম নয়। যোগাযোগ বিষয়ে স্নাতক করেছেন। তাই বড় কোম্পানিতে চাকরি পেতে কোনো সমস্যা হয়নি। তবে স্নাতক শেষ করার পর ক্রিকেটের সঙ্গেই ছিলেন। অবসর-পরবর্তী জীবন শুরু করেছিলেন ধারাভাষ্যকার হিসেবে। এরপর কিছুদিনের জন্য কোচিংয়ে ঝুঁকে পড়েন। একসময় ক্রিকেট থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে বাণিজ্য বিষয়ক ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালনের পর এখন বোরাল কনক্রিট নামে সেই নির্মাণসামগ্রী প্রস্তুতকারক কোম্পানির হিসাবরক্ষকের দায়িত্বে আছেন।

মাঝে রাজনীতিতেও নাম লিখিয়েছেন ব্র্যাকেন। ২০১৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে প্রাথমিকভাবে পান মাত্র ৮.২০% ভোট। পরবর্তীতে যোগ দেন লিবারেল পার্টিতে, যারা বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার সংসদের প্রধান বিরোধী দল। লিবারেল পার্টির প্রার্থী হিসেবেই গত বছর নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের দ্য এনট্রেন্স আসন থেকে নির্বাচনে দাঁড়ান। সেই ভোটেও তিনি হেরে যান।

আরও পড়ুন

৪৭ ছুঁই ছুঁই বয়সের জীবনে এখন পর্যন্ত ওই দুই জায়গাতেই হেরে গেছেন ব্র্যাকেন—নির্বাচন আর হাঁটুর দীর্ঘস্থায়ী চোট। এ দুটি অধ্যায় বাদ দিলে তিনি সত্যিকারের বিজয়ী। বর্তমানে স্ত্রী হ্যালি ব্র্যাকেন ও দুই সন্তান নিয়ে সুখী পরিবার তাঁর। থাকেন সেন্ট্রাল কোস্ট এলাকায়।

চোটাঘাত শরীরে জেঁকে না বসলে নিশ্চিতভাবেই ক্রিকেট ক্যারিয়ার লম্বা হতো ব্র্যাকেনের। তাহলে জীবনের গল্পটাও হয়তো আলাদা হতো। এই বয়সে এসে কোচ বা পরামর্শকের ভূমিকায় থাকতেন ক্রিকেটের সঙ্গেই।

স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে নাথান ব্র্যাকেনের সুখের সংসার
ইনস্টাগ্রাম

২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার হয়ে তিন সংস্করণ মিলিয়ে ১৪০ ম্যাচ খেলেছেন নাথান ব্র্যাকেন। নিয়েছেন ২০৫ উইকেট। তবে ওয়ানডেতেই সবচেয়ে কার্যকর বোলার প্রমাণিত হয়েছেন। গতির চেয়ে লাইন-লেন্থ ঠিক রেখে বুদ্ধিদীপ্ত ফিল্ডিং সাজিয়ে বল করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। বল সুইং করাতে পারতেন দুই দিকেই।

২০০৮ সালের জুলাইয়ে ড্যানিয়েল ভেট্টরিকে সরিয়ে প্রথমবারের মতো আইসিসি ওয়ানডে বোলারদের র‍্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে উঠে আসেন ব্র্যাকেন। সে বছর জায়গা করে নেন আইসিসির বর্ষসেরা ওয়ানডে দলেও। একই বছর বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করে তাঁকে দলে ভিড়িয়েছিল আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজি রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু। কিন্তু বেরসিক চোট তাঁকে খেলতে দেননি। একই কারণে খেলতে পারেননি ২০০৯ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতেও।

আরও পড়ুন

চোট থেকে সেরে উঠতে দীর্ঘ সময় লাগায় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া ব্র্যাকেনের ওপর থেকে ধীরে ধীরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। একসময় তাঁকে উপেক্ষিত রেখে তরুণদের সুযোগ করে দেয়। এভাবেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে হারিয়ে যান একসময়ের বিশ্বসেরা বোলার ব্র্যাকেন।

সতীর্থদের সঙ্গে বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে নাথান ব্র্যাকেন (বাঁ থেকে তৃতীয়)
আইসিসি

তবে এর আগেই অস্ট্রেলিয়ার হয়ে দুটি ওয়ানডে বিশ্বকাপ (২০০৩ ও ২০০৭) ও একটি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি (২০০৬) জিতে ফেলেন। ২০০৭ বিশ্বকাপে গ্লেন ম্যাকগ্রা, শন টেইটদের সঙ্গে পেস আক্রমণে জুটি বেঁধেছিলেন। সেই জুটি প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের জন্য ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ২০০৬ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি ফাইনালের তাঁর দুর্দান্ত বোলিংয়েই ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিং লাইন আপ তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে।

ক্রিকেট থেকে দূরে সরে গেলেও সেসব স্মৃতি এখনো নিশ্চয় মনে পড়ে ব্র্যাকেনের!