সাক্ষাৎকারে ঋষভ পন্তের কোচ

পন্ত ভারতের অন্যতম সেরা ম্যাচ উইনার

খেলোয়াড়ি জীবনে সাফল্য পাননি। কিন্তু কোচ হিসেবে দেবেন্দ্র শর্মা দিল্লি ক্রিকেট থেকে খুঁজে বের করছেন একের পর এক রত্ন। ঋষভ পন্ত, মায়াঙ্ক যাদব, আয়ুশ বদনি, মিলিন্দ কুমার—প্রত্যেকেই দেবেন্দ্রর ছাত্র। দেবেন্দ্রর একাডেমি সনেট ক্রিকেট ক্লাব থেকে এখন পর্যন্ত ১৩ জন ক্রিকেটার ভারতের হয়ে খেলেছেন। প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক মোহাম্মদ জুবাইরের সঙ্গে দেবেন্দ্র শর্মা কথা বলেছেন এসব নিয়ে। যাতে অবধারিতভাবেই এসেছে দুর্ঘটনার পর ঋষভ পন্তের অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনের কথাও।

প্রথম আলো:

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছিলেন বীরেন্দর শেবাগের সঙ্গে। কিন্তু আপনার ক্রিকেট ক্যারিয়ার তো দীর্ঘ হয়নি। খুব দ্রুতই কোচিংয়ে চলে এসেছিলেন। সব সময়ই কি কোচ হওয়ার লক্ষ্য ছিল?

দেবেন্দ্র শর্মা: সেই অর্থে লক্ষ্য ছিল না। আমি দিল্লির হয়ে পাঁচ বছর রঞ্জি ট্রফি খেলেছি। উইকেটকিপার–ব্যাটসম্যান ছিলাম। আমার আর বীরুর একই ম্যাচে সেঞ্চুরি আছে। কিন্তু আমার ক্যারিয়ার নানা কারণেই বড় হয়নি। আমি এরপর কোচিং শুরু করি। যে সনেট ক্লাবের ছাত্র ছিলাম, সেখানেই কোচিং শুরু করি। আমার যে স্বপ্ন ছিল, সেটা যেহেতু পূরণ হয়নি, আমি বাচ্চাদের স্বপ্নপূরণে সাহায্য করতে থাকি। আমি দেশের হয়ে খেলতে পারিনি। কিন্তু এখন গর্ব করে বলি, আমার কোচিংয়ে কয়েকজন ভারতের হয়ে খেলেছে।

ওকে দেখতে দেরাদুন গিয়েছিলাম। হাসপাতালে গিয়ে দেখি, খুবই খারাপ অবস্থা। আমার মনে হয় নয়, ঋষভ ছাড়া এটা কেউ সামলাতে পারত না। আমি সব সময় বলি, এটা তার দ্বিতীয় জীবন।
ঋষভ পন্তকে নিয়ে তাঁর কোচ দেবেন্দ্র শর্মা
আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

ঋষভ পন্তের কথাই তো সবার আগে বলবেন, তাই না?

দেবেন্দ্র: ঋষভকে দিয়ে আমার স্বপ্নপূরণ হয়। ও যখন দিল্লিতে এসেছিল, তখন আমি দিল্লি অনূর্ধ্ব-১৯–এর নির্বাচক ছিলাম। পাশাপাশি সনেটে কোচিং করাতাম।

ঋষভকে কোচিং করিয়ে স্বপ্নপূরণ হয়েছে দেবেন্দ্রর। ছাত্র ঋষভ ও নিজের মেয়ের সঙ্গে এই কোচ
সংগৃহীত
প্রথম আলো:

বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম টি–টোয়েন্টিতে তো আপনার আরেক ছাত্র ফাস্ট বোলার মায়াঙ্ক যাদবেরও অভিষেক হয়ে গেল…

দিভেন্দার: মায়াঙ্ক যেমন আমাদের ক্লাবে এসেছিল ১৪ বছর বয়সে, তার বাবার সঙ্গে। কিন্তু ওর বোলিং শু ছিল না। কিন্তু গতি ছিল। লিকলিকে ছেলেটাকে খুব জোরে বল করতে দেখে অবাক হয়ে যাই। তখনই আমরা মায়াঙ্ককে অনূর্ধ্ব-১৪ দলে সুযোগ দিই। কারণ, এমন সহজাত গতিময় বোলার সহজে খুঁজে পাবেন না। এর সঙ্গে ও কঠোর পরিশ্রমী। খেলাটা ভালো বিশ্লেষণও করে। আইপিএল অভিষেকে সারা বিশ্ব মায়াঙ্কের গতির সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ দেখে অবাক হয়েছে। কিন্তু দুই-তিন বছর আগেও মায়াঙ্কের শুধু গতিই ছিল, লাইন-লেংথ ঠিক ছিল না। খুব দ্রুতই সেটা ঠিক করেছে।

ঋষভের ছোট্ট একটা গল্প বলি। দিল্লি ক্রিকেটে উড়িয়ে মারতে গিয়ে আউট হলে সেটাকে ক্রাইম মনে করা হতো। কিন্তু আমি ওর উড়িয়ে মারা বন্ধ করিনি। কারণ, সে ইচ্ছে হলেই চার-ছক্কা মারার বিরল প্রতিভা নিয়ে এসেছে।
ঋষভ পন্তকে নিয়ে তাঁর কোচ দেবেন্দ্র
প্রথম আলো:

আপনার কাছে দুর্ঘটনার পর ঋষভ পন্তের ক্রিকেটে ফিরে আসা, বিশ্বকাপ জেতা, এরপর বাংলাদেশ সিরিজে টেস্ট প্রত্যাবর্তনের গল্প শুনতে চাই।

দিভেন্দার: যখন ওর অ্যাকসিডেন্ট হয়, সকাল ছয়টা থেকে আমার কাছে ফোন আসতে থাকে। সেদিন রাতে সে তার মাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল। সে জন্য রাতে ড্রাইভ করে বাড়ি ফিরছিল। তখনই ওই দুর্ঘটনা ঘটে। পরে আমি ওকে দেখতে দেরাদুন গিয়েছিলাম। হাসপাতালে গিয়ে দেখি, খুবই খারাপ অবস্থা। আমার মনে হয় নয়, ঋষভ ছাড়া এটা কেউ সামলাতে পারত না। আমি সব সময় বলি, এটা তার দ্বিতীয় জীবন।

চেন্নাই টেস্টে বাংলাদেশের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেন পন্ত
এএফপি
প্রথম আলো:

ডাক্তার নাকি বলেছিলেন, অ্যাথলেটিক মানসিকতা থাকার কারণেই পন্ত ফিরে আসতে পেরেছেন। না হলে সারা জীবন পঙ্গুই থাকতে হতো।

দিভেন্দার: ঋষভ মানসিকভাবে অনেক শক্তিশালী। দুর্ঘটনার পর যখন ওর সঙ্গে দেখা করতে যাই, তখন ও আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘স্যার, আমি কি আবার খেলতে পারব?’ তখন আমি বলেছিলাম, ‘অবশ্যই খেলতে পারবি। কেন পারবি না?’ এনসিএ থেকে ফেরার পর প্রতিদিন তিন ঘণ্টা করে আমার সঙ্গে কাজ করত। রিহ্যাবটা সে খুবই মনোযোগ দিয়ে করেছে। বিশ্বকাপে দারুণ খেলল। বাংলাদেশ সিরিজ দিয়ে টেস্টে ফেরার আগে তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। বাংলাদেশের বোলিং কিন্তু ভালো। ওদের বিপক্ষে ফেরার ম্যাচেই সেঞ্চুরি করতে হলে ভালো খেলতেই হতো। ঋষভ সেটা করেছে। দলও জিতেছে। ঋষভকে আপনারা কীভাবে মূল্যায়ন করেন, আমি জানি না। তবে আমার দৃষ্টিতে ও ভারতের অন্যতম সেরা ম্যাচ উইনার। ওর মতো সহজাত স্ট্রোক প্লেয়ার খুব কমই আছে।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

তাঁর ব্যাটিংয়ের ধরনের গল্পটা জানতে চাই। কীভাবে এমন অদ্ভুত শট খেলেও এতটা সফল?

দিভেন্দার: ঋষভের ছোট্ট একটা গল্প বলি। দিল্লি ক্রিকেটে উড়িয়ে মারতে গিয়ে আউট হলে সেটাকে ক্রাইম মনে করা হতো। কিন্তু আমি ওর উড়িয়ে মারা বন্ধ করিনি। কারণ, সে ইচ্ছে হলেই চার-ছক্কা মারার বিরল প্রতিভা নিয়ে এসেছে। আমি সেটা নষ্ট হতে দিইনি। ওই মেরে খেলার সামর্থ্যের সঙ্গে ডিফেন্স করার দক্ষতা যোগ করেছি। সবাই ঋষভের মারকুটে ব্যাটিং নিয়ে কথা বলে, কিন্তু টেস্টে বড় ইনিংস খেলতে হলে আপনাকে ভালো বল সামলাতে হয়। ঋষভ সেটাতে বেশ ভালো বলেই টেস্টে এতটা সফল।

প্রথম আলো:

ঋষভের মতো সফল আপনার সনেট ক্লাবও…

দিভেন্দার: সনেট ক্লাবকে অনেকে দিল্লি ক্রিকেটের মন্দির বলে। বাচ্চারা যখন এখানে আসে, ওদের দেশের জন্য খেলানোই আমাদের লক্ষ্য। আমাদের ১৩ জন ছেলে ভারতের হয়ে খেলেছে, আইপিএলে খেলোয়াড় আছে আরও ৪ জন।

পন্তকে ভারতের অন্যতম সেরা ম্যাচ উইনার মনে করেন দেবেন্দ্র
বিসিসিআই
প্রথম আলো:

সনেট ক্লাব কীভাবে এত সফল হলো?

দিভেন্দার: আমরা বেসিক নিয়েই মূলত বেশি কাজ করি। কঠিন কঠিন পরিস্থিতিতে অনুশীলন করি। ভালো উইকেটে সবাই রান করে, উইকেট নেয়। কিন্তু কঠিন উইকেটে আসল পরীক্ষাটা হয়। আমরা সব সময় ছেলেদের ওইভাবেই অনুশীলন করাই। দিল্লির যত বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্ট আছে, বেশির ভাগ ট্রফিই আমাদের ঘরে। আর আমাদের আছে চারটা ‘ডি’—ডিসিপ্লিন, ডেডিকেশন, ডিভোশন অ্যান্ড ডিটারমিনেশন। এগুলোই আমাদের মন্দিরের মূলমন্ত্র। আর আমরা খুব বেশি ছাত্র নিই না। ৫০ জন করে দুটি ব্যাচ। কারও আর্থিক সমস্যা থাকলে সাহায্য করি। হিম্মত সিং, আয়ুশ বদনি…কদিন পর দেখবেন এরাও ভারত পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। ওরাও আমাদেরই ছেলে।