যে ছবি দেখে ‘নবাবি শাসন’ মনে পড়ে
ওপরে ছবির ‘চতুষ্টয়’কে নিশ্চয়ই চিনতে পারছেন?
ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে আগ্রহ না থাকলে পরিচয়পর্বটা আগেই সেরে নেওয়া ভালো। একদম বাঁয়ের ভদ্রলোক কাল রাতে বিপিএল ফাইনালে সিলেট স্ট্রাইকার্সের বোলারদের সঙ্গে মোটেও ‘ভদ্রোচিত’ আচরণ করেননি। ৫ ছক্কা ও ৭ চারে ৫২ বলে ৭৯ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংসটিকে সিলেটের সমর্থকেরা আর যা–ই হোক, ভদ্রোচিত বলবেন না। জনসন চার্লসের বিস্ফোরক এই ইনিংসেই তো সিলেটের সর্বনাশটা হলো!
চার্লসের পাশেই যে দুই ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে, তাঁদের না চেনার কোনো কারণ নেই। এ গ্রহে যত ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ হয়, সেসবের বেশির ভাগেই প্রতিপক্ষ দলের সঙ্গে এ দুজনকে ‘অভদ্রজনোচিত কাজ’ করতে দেখা যায়। সুনীল নারাইন ও আন্দ্রে রাসেল। প্রথমজন বল হাতে নানা পদের ফন্দিফিকিরে ফাঁকি দেন ব্যাটসম্যানদের। আর ব্যাট হাতে যতক্ষণ উইকেটে থাকেন, মেজাজটা খুনে হয়েই থাকে।
দ্বিতীয়জন আরও এক কাঠি সরেস। পৃথিবীর যেকোনো টি-টোয়েন্টি দলের কাছে এই ভদ্রলোক ‘মহামূল্যবান সম্পদ’। লক্ষ্য যা–ই হোক, আসুরিক শক্তির ব্যাটিংয়ে তা হাতের তালুর মধ্যে নিয়ে আসায় আন্দ্রে রাসেলের জুড়ি নেই। সঙ্গে ‘বোনাস’ নিয়ন্ত্রিত বোলিং ও অ্যাথলেটিক ফিল্ডিং।
রাসেলের একদম ডান পাশের ভদ্রলোককে একটু অচেনা লাগতে পারে। নাম তাঁর চ্যাডউইক ওয়ালটন। সেই যে ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সিনিয়র ক্রিকেটাররা বিদ্রোহ করেছিলেন, সে সময় বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজে তাঁর আন্তর্জাতিক অভিষেক। বহুদিন ধরেই জাতীয় দলের বাইরে। বয়সও ৩৭ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটারদের ‘ম্যাজিক’ তো এটাই!
বয়স যা–ই হোক, ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে বেশির ভাগ দলেরই ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটার ছাড়া যেন চলেই না! আর তাই কাল বিপিএল ফাইনালে কুমিল্লার জয়ের পর এই ছবির জন্ম হলো। জনসন চার্লস, সুনীল নারাইন, আন্দ্রে রাসেল, চ্যাডউইক ওয়ালটন—তাঁরা সবাই কুমিল্লার ক্রিকেটার। কুমিল্লা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ছবিটা ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে রাসেল লিখেছেন, ‘ক্যারিবিয়ান ভাইদের সঙ্গে খেলাটা আনন্দের ছিল।’
এই চতুষ্টয়ের ‘পূর্বপুরুষ’—৪৩ বছর বয়সেও যিনি এখনো বহাল তবিয়তে খেলে যাচ্ছেন—ক্রিস গেইল সেই ছবির মন্তব্যে লিখেছেন—‘১০০’। অর্থাৎ রাসেলের অনুভূতি শতভাগ সত্য।
তবে এ সত্যের পাশাপাশি আরও অনেক সত্যই মনের মধ্যে উঁকি মারতে পারে ছবিটি দেখে। নদী শুকিয়ে গেলেও যেমন এক সময় বহতা পানির রেখাচিত্র থেকে যায়, রাজার প্রস্থান ঘটলেও যেমন রাজপ্রাসাদ থেকে যায়—তেমনি এই চার ‘ভদ্রলোক’কে দেখে টি-টোয়েন্টিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভাঙা রাজপ্রাসাদ মনে পড়তে পারে। একসময় কী রমরমা অবস্থাই না ছিল!
টি-টোয়েন্টিতে কী আন্তর্জাতিক, কী ফ্র্যাঞ্চাইজি—সব জায়গাতেই রাজার মর্যাদা পেতেন এই রাসেলরাই। এখনো যে পান না তা নয়, তবে সেসব মর্যাদা বাংলার নবাবি আমলের শাসনকে মনে করিয়ে দেয়।
২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পর্যন্তও এ সংস্করণে নবাব আলিবর্দী খাঁর মতো ক্রিকেট-বিশ্ব শাসন করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং সেই ‘শাসনব্যবস্থায়’ এই রাসেল-নারাইনরাই ‘রাজা-উজির’ ছিলেন। এরপর ধীরে ধীরে যেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সেই সময়ের আবির্ভাব ঘটল। পার্থক্য হলো, নবাবকে ফাঁকি দিয়েছিলেন তাঁর অমাত্যরা, আর ক্যারিবিয়ানদের ফাঁকি দিয়েছে খোদ ক্রিকেট!
বোর্ড-খেলোয়াড় বাজে সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলোয়াড়দের অনীহা, শুধু ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি খেলার প্রবণতা এবং সে জন্য পর্যাপ্ত খেলোয়াড় তুলে আনতে না পারা—এসব চললে ক্রিকেট কেন তাদের পাশে থাকবে! ‘শাসন’টা তাই ধীরে ধীরে হাতছাড়া হয়ে এখন সম্ভবত ইংরেজদের দখলে (ভারত টি-টোয়েন্টি র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে থাকলেও দুইয়ে থাকা ইংল্যান্ড আক্রমণাত্মক খেলায় এগিয়ে, বর্তমান চ্যাম্পিয়নও)।
কিন্তু ওই যে তপন সিনহার ‘হারমোনিয়াম’ সিনেমার সেই জমিদারকন্যা বিমলার মতো—জমিদারি চলে গেলেও জমিদার বংশের রক্ত যাঁর শরীরে, সে আমৃত্যু অভিজাতই থাকে। রাসেল, নারাইন, চার্লস ও ওয়ালটনদের দেখেও তেমন মনে হয় কি?
আর হ্যাঁ, তাঁদের ‘ভদ্রলোক’ সম্বোধন করা হয়েছে মাঠে সুবোধ বালকের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ছবিটা দেখে। ময়দানি লড়াইয়ে তাঁরা প্রতিপক্ষের সঙ্গে কী কী করতে পারেন, সেটির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত কাল রাতের চার্লসের ইনিংসটি। তেমন তারকাখ্যাতিও নেই, বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানদের কাতারে উঠে আসাও দূর অস্ত, কিন্তু এই ব্যাটসম্যানই একদম জায়গামতো এসে কী ব্যাটিংটাই না করলেন! চার্লস নিজের দিনে যদি এমন হয়ে উঠতে পারেন, তাহলে রাসেল-নারাইনের মতো তারকাদের সামর্থ্য কেমন, বুঝতেই পারছেন। নিশ্চয়ই অনেকেরই অনেকবার দেখা আছে।
আর তাই ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে গোটা টুর্নামেন্টে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটাররা কেমন করলেন, সেটি খুব কমই দেখা হয়। জনসন চার্লসের কথাই ধরুন। রান তোলায় শীর্ষ দশেও নেই, কিন্তু সেঞ্চুরি আছে, আর আছে ফাইনালে সেঞ্চুরির চেয়েও মূল্যবান অপরাজিত ৭৯ রানের ইনিংসটি। এখন টি-টোয়েন্টিতে যে ‘ইমপ্যাক্টে’র কথা বলা হয়, এগুলোই তার অংশ। ৯ ম্যাচে তাঁর ৫১.৩৩ গড় ও ১৪৫.৯৭ স্ট্রাইক রেটে ৩০৮ রান থেকে বাংলাদেশের তরুণ ওপেনারদের নিশ্চয়ই কিছু শেখার আছে!
রাসেল খেলেছেন মাত্র ৪ ম্যাচ, এর মধ্যেও তাঁর ম্যাচ জেতানো ইনিংস আছে। ফরচুন বরিশালের বিপক্ষে ১৬ বলে সেই ৩০ রানের ‘টর্নেডো’। নারাইনও ৪ ম্যাচ খেলেছেন। সিলেটের বিপক্ষেই প্রথম কোয়ালিফায়ারে ৩.১ ওভারে মাত্র ৮ রানে তাঁর ১ উইকেট নেওয়ার স্পেলটিও কুমিল্লার জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। আর ওয়ালটন দুর্ভাগা—মাত্র ১ ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়ে আর কী করবেন!
গ্রামগঞ্জে একসময় টেপ টেনিস টুর্নামেন্টে এ রকম দেখা যেত। কোনো পেশাদার ক্লাবের চার-পাঁচজন ক্রিকেটার একসঙ্গে স্থানীয় কোনো দলের হয়ে খেপ খেলতে যেতেন। প্রতি ম্যাচেই কেউ না কেউ ভালো করতেন, তাতে লাভটা দলেরই হতো। কল্পনার ক্যানভাসটা গ্রাম থেকে বিশ্বের মানচিত্রের ওপর রেখে রাসেল-নারাইন-ওয়ালটন-চার্লসের দিকে তাকালেও কি তেমন লাগে?
আরও একটি বিষয় মনে হতে পারে। টি-টোয়েন্টিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দাপট হয়তো আগের মতো নেই, কিন্তু ক্যারিবিয়ান রক্তের ধারটা আগের মতোই আছে। কুমিল্লার ক্যারিবিয়ান চতুষ্টয়ের এই ছবি তাই শুধু আনন্দ দেয় না, নস্টালজিকও করে।