৫০০ উইকেট নেওয়া অশ্বিনের স্পিনার হওয়ার নেপথ্যে তাঁর মা
রবিচন্দ্রন অশ্বিনের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ঘটনাবহুল দিন কোনটি? বেশির ভাগ ক্রিকেটপ্রেমী হয়তো রাজকোট টেস্টে গতকালের কথাই বলবেন।
দিনের শুরুতে অশ্বিনের কারণেই ভারতকে ৫ রান জরিমানা দিতে হয়েছে। বিকেলে ছুঁয়েছেন মাইলফলক—বিশ্বের নবম আর ভারতের দ্বিতীয় বোলার হিসেবে টেস্টে ৫০০ উইকেটের কীর্তি। আর রাতে খবর এসেছে মমতাময়ী মা গুরুতর অসুস্থ। সব ফেলে রেখে ছুটেছেন মায়ের কাছে। রাজকোট টেস্ট ছেড়ে ফিরে গেছেন জন্মশহর চেন্নাইয়ে। একজন ক্রিকেটারের জীবনে এর চেয়ে ঘটনাবহুল দিন আর কী হতে পারে!
কাল দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষেই নতুন অর্জন নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন অশ্বিন। টেস্টে ৫০০ উইকেটের মাইলফলক উৎসর্গ করেছেন বাবাকে। ও হ্যাঁ, কাল সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধি হয়েও এসেছিলেন অশ্বিন। সেখানে সাংবাদিকদের বহু প্রশ্নের ভিড়ে এটাও জানিয়েছেন, তিনি ভাগ্যচক্রে স্পিনার হয়েছেন।
আসলে অশ্বিনের যে স্পিনার হওয়ার কথাই ছিল না! ৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার কেউ বোলার হতে চাইলে পেস বোলিংয়ের দিকেই ঝোঁকার কথা। অশ্বিনও মিডিয়াম পেসার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। পরে পেস ছেড়ে অফ স্পিনে ধাতস্থ হওয়া আর স্পিনার হিসেবেই ৫০০ টেস্ট উইকেটের ক্লাবে ঢুকে পড়া—সবই কার চাওয়াতে হয়েছে জানেন? মা, কাল রাতে যাঁর অসুস্থতার খবর শুনে সব ছেড়েছুড়ে ছুটে গিয়েছেন।
মায়ের চাওয়াতেই পেস বোলিং ছেড়ে স্পিনার হয়েছেন অশ্বিন। সংবাদমাধ্যমকে সে গল্পই শুনিয়েছেন অশ্বিনের বাবা রবিচন্দ্রন, ‘অশ্বিনের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় বাঁকবদল ছিল (পেস বোলিং ছেড়ে) অফ স্পিনার হওয়া। এই সিদ্ধান্তের জন্য আমার স্ত্রী চিত্রাকে (অশ্বিনের মায়ের নাম) ধন্যবাদ দিতেই হবে। একটা সময় অশ্বিনের শ্বাসকষ্ট ছিল এবং ওর হাঁটুতেও সমস্যা ছিল। দৌড়ে বল করা ওর জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তখন চিত্রাই বলল, “তোমাকে এত দৌড়াতে হবে কেন? শুধু কয়েক কদম ফেলো এবং স্পিন বল করো”।’
২০১১ সালে অভিষেক টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ড্যারেন ব্রাভোকে বোল্ড করার মধ্য দিয়ে অশ্বিনের উইকেট নেওয়া শুরু হয়েছিল। কাল ৫০০ উইকেটের মাইলফলকে পৌঁছেছেন ইংল্যান্ডের জ্যাক ক্রলিকে রজত পাতিদারের ক্যাচ বানিয়ে। ৫০০ উইকেট নিতে অশ্বিনকে করতে হয়েছে ২৫৭১৪ বল। তাঁর চেয়ে কম বল করে এই মাইলফলকের দেখা পেয়েছেন শুধু অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি গ্লেন ম্যাকগ্রা (২৫৫২৮ বল)।
ছেলের এই অর্জন নিয়ে বাবা রবিচন্দ্রন বলেছেন, ‘ওর ৫০০ উইকেটের মাইলফলক আমার জন্য একটি অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। আমি অনেক দিন ধরে এটার স্বপ্ন দেখেছি এবং আমার শেষনিশ্বাস পর্যন্ত এই উইকেটের কথা মনে থাকবে। আমার স্মৃতি এখন সেই দিনগুলোতে ফিরে যাচ্ছে, যখন আমি ওকে আমার স্কুটারে স্কুলে এবং কোচিংয়ের জন্য নিয়ে যেতাম। একজন বাবার ইচ্ছা বা স্বপ্ন থাকা এক জিনিস। কিন্তু ছেলের জন্য বলিদান দেওয়া ভিন্ন ব্যাপার। অশ্বিন আমাদের স্বপ্ন দেখে বাঁচতে শিখিয়েছে।’
ছেলের এই অর্জন নিয়ে বাবা রবিচন্দ্রন বলেছেন, ‘ওর ৫০০ উইকেটের মাইলফলক আমার জন্য একটি অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। আমি অনেক দিন ধরে এটার স্বপ্ন দেখেছি এবং আমার শেষনিশ্বাস পর্যন্ত এই উইকেটের কথা মনে থাকবে। আমার স্মৃতি এখন সেই দিনগুলোতে ফিরে যাচ্ছে, যখন আমি ওকে আমার স্কুটারে স্কুলে এবং কোচিংয়ের জন্য নিয়ে যেতাম। একজন বাবার ইচ্ছা বা স্বপ্ন থাকা এক জিনিস। কিন্তু ছেলের জন্য বলিদান দেওয়া ভিন্ন ব্যাপার। অশ্বিন আমাদের স্বপ্ন দেখে বাঁচতে শিখিয়েছে।’
অশ্বিনের শিক্ষাগত যোগ্যতাও অনেকের জানা। চেন্নাইয়ের আন্না বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত শ্রী শিবাসুব্রামানিয়াম নাদার প্রকৌশল কলেজ থেকে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। অশ্বিনের ভেতর উচ্চশিক্ষার বীজটা বাবাই বপন করে দিয়েছিলেন। তবে ক্রিকেটই ছিল তাঁর সত্যিকারের ভালোবাসা।
বাসায় পড়ালেখা করার সময় বাবাকে একটা শর্তও দিতেন অশ্বিন। কী সেই শর্ত, শুনুন তাঁর বাবার মুখেই, ‘একই সঙ্গে লেখাপড়া ও খেলাধুলায় মনোযোগ দেওয়া সহজ নয়। যখন সে ছোট ছিল, তখনই বুঝতে পেরেছিল যে আমি ওর জন্য কতটা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। অশ্বিন শুরু থেকেই কঠোর পরিশ্রমী আর ক্রিকেটপাগল ছিল। সে যখন নেটে (অনুশীলন নিয়ে) ব্যস্ত ছিল, আমি তখন ওর বন্ধুদের কাছ থেকে নোট ধার করতাম। তারপর ফটোকপি করে ওর হাতে তুলে দিতাম। ক্রিকেট আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেলেও শিক্ষাকে উপেক্ষা করিনি। ওকে পড়ালেখায় মনোযোগী হতেই হতো, কারণ গণিত ও বিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। তবে আমি যখন ওকে পড়াতে নিয়ে বসতাম, সে আমাকে একটা শর্ত দিত। ওকে টিভিতে খেলা দেখতে দিতে হবে। আমি কখনোই ওকে খেলা দেখতে নিষেধ করিনি। কারণ, যদি আমি সেটা করতাম, ওর মন বই থেকে সরে গিয়ে শুধু খেলা নিয়েই ভাবত।’
কাল ৫০০ টেস্ট উইকেটের মাইলফলক ছোঁয়ার পর ছেলের সঙ্গে কথাও হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাবা রবিচন্দ্রন। অশ্বিন বাবাকে বলেছেন, ৫০০ উইকেট তাঁর কাছে শুধুই একটা সংখ্যা। ৪৯৯ উইকেটে আটকে গেলেও তিনি খুশিই থাকতেন।
সংখ্যা তো বটেই। এই সংখ্যাই যে অশ্বিনকে কিংবদন্তিদের কাতারে নিয়ে গেছে। ভারতের হয়ে যত দিন খেলবেন, সংখ্যাটা শুধু বাড়তেই থাকবে। তবে আপাতত তাঁর গুরুদায়িত্ব মাকে সুস্থ করে তোলা, যাঁর কারণে আজ তিনি এত বড় মাপের স্পিনার।