প্রতিভা ও সামর্থ্য থাকলে ভারতীয় ক্রিকেট আপনাকে খুঁজে নেবেই

ভারতীয় ক্রিকেট অবকাঠামোয় সবচেয়ে বড় ভূমিকা দেশটির জাতীয় ক্রিকেট একাডেমিরবিসিসিআই

মায়াঙ্ক যাদব তখন মাত্র দুটি লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ খেলেছেন। লক্ষ্ণৌ সুপারজায়ান্টসের স্কাউট দল ওই দুটি ম্যাচ দেখেই নিশ্চিত হয়ে যায়—ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন ‘গতি তারকা’ হবেন মায়াঙ্ক। কিন্তু দিল্লির তরুণকে দলে নিয়েই আইপিএলে খেলিয়ে দিতে চাননি লক্ষ্ণৌর তখনকার কোচ গৌতম গম্ভীর। ফ্র্যাঞ্চাইজিটি মায়াঙ্ককে এক বছর ধরে তৈরি করে। প্রথম শ্রেণি ও লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে আরও কিছু ম্যাচ খেলার পর গত বছরের আইপিএলে অভিষেক হয় মায়াঙ্কের। চোটে ছিটকে পড়ার আগে তিনি মাত্র চারটি ম্যাচ খেলেন, গতির ঝড় তুলে নেন ৭ উইকেট।

আরও পড়ুন

নিজেকে প্রমাণের জন্য মায়াঙ্ককে আরও একটি আইপিএল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি। বাংলাদেশের বিপক্ষে ৬ অক্টোবর শুরু তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ দিয়ে প্রথমবারের মতো ভারতীয় দলে ডাক পেয়েছেন ২২ বছর বয়সী এই ডানহাতি পেসার।

প্রতিভা দিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটের চূড়ায় উঠে আসার উদাহরণ মায়াঙ্ক আগারওয়াল
ইনস্টাগ্রাম

প্রতিভা থাকলে যে সিঁড়ি বেয়ে ভারতীয় ক্রিকেটের চূড়ায় উঠে আসা যায়, তার সবচেয়ে তাজা উদাহরণ মায়াঙ্ক। বিশ্ব ক্রিকেটের পরাশক্তি দলটা গত পাঁচ-ছয় বছরে এমন অনেক ক্রিকেটার পেয়েছে, যাঁরা ভারতের বড় শহর থেকে আসা নয়। জাতীয় দল দূরের কথা, একসময় সেসব অঞ্চলের প্রতিভারা রঞ্জি ট্রফি পর্যন্তই পৌঁছাতে পারতেন না। আইপিএল স্কাউট, বিসিসিআই নির্বাচন প্রক্রিয়া মিলে এখন দেশটিতে এমন একটা কাঠামো দাঁড়িয়েছে, ভারতের কোনো অজপাড়াগাঁয়েও যদি কেউ ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটারে বল করে, তাঁকেও খুঁজে পাবে ভারতের ক্রিকেট।

ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড আয়োজিত প্রতিটি ম্যাচে ম্যাচ রেফারিকে একটি করে ‘পারফরম্যান্স চার্ট’ দেওয়া হয়, যা দেখে নির্বাচকেরা কোন খেলোয়াড় ম্যাচের কোন মুহূর্তে রান করছেন, তার একটা প্রাথমিক ধারণা পেয়ে থাকেন। এরপর প্রয়োজনবোধ করলে ওই নির্দিষ্ট একজনের খেলা দেখতে মাঠে নির্বাচক পাঠানো হয়।

জাতীয় ক্রিকেট একাডেমিরও (এনসিএ) বিরাট ভূমিকা আছে এতে। ২০১৯ সালে রাহুল দ্রাবিড় ও পরশ মামব্রে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির দারুণ আধুনিকায়ন হয়েছে। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট কাঠামোকে ভারতে এনে কীভাবে আরও উন্নত করা যায়, সে চেষ্টা ছিল দুজনের। এখন এনসিএ ডালপালা গজিয়ে হয়েছে বিশাল এক বটবৃক্ষ। যার ছায়াতলে ভারতীয় ক্রিকেট হয়ে উঠেছে বিশ্ব ক্রিকেটেরই অন্যতম পরাশক্তি।

আরও পড়ুন

কদিন আগেই দুলীপ ট্রফি দিয়ে শুরু হয়েছে ভারতের ক্রিকেট মৌসুম, যা শেষ হবে আগামী বছরের আইপিএল দিয়ে। পুরো ক্রিকেট মৌসুমে সারা ভারতে সব পর্যায় মিলিয়ে প্রায় ২২০০টি ম্যাচ হবে। সব ম্যাচের প্রতিটি বল ভিডিও করা হবে, জমা হবে এনসিএর ডেটাবেজে। খেলোয়াড়দের কে কোন পর্যায়ে আছেন, কোথায় যাবেন, সেখানে যেতে কী করতে হবে, তা বিশ্লেষণ হয় এনসিএর ডেটাবেজ থেকে। কোনো ক্রিকেটার যখন বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের প্রতিটি ধাপ পেরিয়ে জাতীয় দলে আসেন, তখন তাঁর আগের ৬-৭ বছরের সব ম্যাচের তথ্য থাকে নির্বাচকদের হাতে। বিসিসিআই এনসিএর এই সুবিধা শুধু জাতীয় দলের আশপাশে থাকা ক্রিকেটারদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেনি, প্রতিটি রাজ্যের খেলোয়াড়েরা নিজের অ্যাসোসিয়েশনের চিঠি নিয়ে এলেই এনসিএর সুবিধা পান।

দুলীপ ট্রফি দিয়ে শুরু হয়েছে ভারতের ক্রিকেট মৌসুম। ভারত ‘এ’ দলের দুলীপ ট্রফি জয়ের পর ছবিটি তোলা
বিসিসিআই

অবশ্য শুধু ভিডিও ফুটেজ আর স্কোরকার্ডই একজন খেলোয়াড়ের মাপকাঠি হতে পারে না। আবার সব সময় মাঠে নির্বাচক পাঠানোও সম্ভব হয় না। বিসিসিআইয়ের নির্বাচকেরা সেসব ক্ষেত্রে ম্যাচ রেফারির সাহায্য নিয়ে থাকেন। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড আয়োজিত প্রতিটি ম্যাচে ম্যাচ রেফারিকে একটি করে ‘পারফরম্যান্স চার্ট’ দেওয়া হয়, যা দেখে নির্বাচকেরা কোন খেলোয়াড় ম্যাচের কোন মুহূর্তে রান করছেন, তার একটা প্রাথমিক ধারণা পেয়ে থাকেন। এরপর প্রয়োজনবোধ করলে ওই নির্দিষ্ট একজনের খেলা দেখতে মাঠে নির্বাচক পাঠানো হয়। ম্যাচ বা টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান, সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি বোলারদের নিয়ে দল নির্বাচনের সহজ প্রক্রিয়া এখন ভারতীয় ক্রিকেটে অতীত। আইপিএল দলগুলোর স্কাউটরা তো আরও গভীরে গিয়ে ক্রিকেটারদের খুঁজে বের করেন। তাঁরা আম্পায়ার, ম্যানেজার, স্কোরারদের সঙ্গেও কথা বলেন।

আরও পড়ুন

আইপিএল আর বিসিসিআইয়ের টুর্নামেন্টের পাশাপাশি ভারতের আঞ্চলিক টুর্নামেন্টগুলোও এখন খেলোয়াড় তৈরির দারুণ মঞ্চ হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রতিটি রাজ্যেরই ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট আছে। তামিলনাড়ু ও কর্ণাটক প্রিমিয়ার লিগ শুরু হলে যেমন আইপিএল স্কাউটদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। বরুণ চক্রবর্তী, টি নটরাজনরা জাতীয় দলে এসেছেন আঞ্চলিক টি-টোয়েন্টিতে নজর কেড়েই।

আইপিএল স্কাউট, বিসিসিআই নির্বাচন প্রক্রিয়া মিলে এখন দেশটিতে এমন একটা কাঠামো দাঁড়িয়েছে, ভারতের কোনো অজপাড়াগাঁয়েও যদি কেউ ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটারে বল করে, তাঁকেও খুঁজে পাবে ভারতের ক্রিকেট।

বিশ্ব ক্রিকেটের সেরা দলগুলোর মধ্যেই অন্যতম ভারত। হয়তো এ সময়ের সেরাও। তবু দলের গভীরতা ও বৈচিত্র্যে নিজেদের ছাড়িয়ে যাওয়ার নেশা তাদের। আর সে জন্যই দেশটির ক্রিকেট এমন এক অবকাঠামো তৈরি করেছে, প্রতিভা আর সামর্থ্য থাকলে ভারতীয় ক্রিকেট আপনাকে খুঁজে নেবেই।