সূচি নিয়ে তালগোল
ভারত–বিশ্বকাপে শুরুর আগেই তামাশা
এক-দুই ম্যাচের সূচি বদলাতে গিয়ে রীতিমতো বড়সড় ‘ধাক্কা’ই লেগেছে বিশ্বকাপের আগে-পরের ম্যাচগুলোতে।
সেদিন প্রশ্নটা শুনে কিছুটা অপ্রস্তুতই হয়ে পড়েছিলেন জিওফ অ্যালারডাইস।
জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ, ওভালে চলছিল ভারত–অস্ট্রেলিয়া বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল। দিন দশেক আগে বিসিসিআই সচিব জয় শাহ যা বলেছিলেন, তাতে ওই সময়ই ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপের সূচি ঘোষণা করার কথা। কিন্তু আইসিসির প্রধান নির্বাহী এ নিয়ে চুপ। বিবিসির পক্ষ থেকে জিজ্ঞেস করা হলে অ্যালারডাইসের মুখে ছিল অসহায়ত্বের জবাব, সূচি তাঁর হাতেই পৌঁছায়নি তখনো! কেন বিলম্ব, আর কবেই–বা চূড়ান্ত সূচি ঘোষণা করা যাবে, তা–ও বলতে পারছিলেন না আইসিসির প্রধান নির্বাহী।
অ্যালারডাইসের সেই অপেক্ষার সূচি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় জুনের শেষ সপ্তাহে। বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচের ঠিক ১০০ দিন আগে। কিন্তু লম্বা সময় নিয়ে তৈরি করা সূচিটাও শেষ পর্যন্ত ‘চূড়ান্ত সূচি’ হয়ে থাকেনি। একটি ম্যাচের সূচি পরিবর্তনের অনুরোধ এল আহমেদাবাদ থেকে, আরেকটির কলকাতা থেকে। এই এক–দুই ম্যাচের সূচি বদলাতে গিয়ে রীতিমতো বড়সড় ‘ধাক্কা’ই লেগেছে বিশ্বকাপের আগে–পরের ম্যাচগুলোয়। যে ধাক্কা সামাল দিতে গিয়ে একটি–দুটি নয়, পরিবর্তন আনতে হয়েছে ৯টি ম্যাচে। তবে এই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি, বিশ্বকাপ শুরুর ৫৫ দিন আগে সর্বশেষ সূচিকেও ‘চূড়ান্ত’ বলাটা প্রায় ঝুঁকিপূর্ণ। আরও বদল যে চোখ রাঙানি দিচ্ছে! ব্যাপারটা অনেকটা এমন—বিশ্বকাপের সূচি এখন ‘বাটারফ্লাই ইফেক্টের’ কবলে।
আকারে, ঐতিহ্যে আর আয়োজনের ব্যাপ্তিতে ওয়ানডে বিশ্বকাপই ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আয়োজন। এ নিয়ে পরিকল্পনা, প্রস্তুতি চলে বেশ আগে থেকেই। যার বেশির ভাগেই আবার দর্শক আর অংশগ্রহণকারী দলগুলোর সংযুক্তি থাকে না। দলগুলোর যুক্ততা সবচেয়ে ভালোভাবে তৈরি হয় প্রতিপক্ষ চূড়ান্ত হওয়ার মাধ্যমে। আর দর্শকেরা যুক্ত হন টিকিট কিনে। দুটিই এবার তালগোল পাকিয়েছে বেশ।
বিশ্বকাপের লিগ পর্ব যেহেতু রাউন্ড রবিন পদ্ধতির, প্রতিপক্ষের নাম সবার আগে থেকেই জানা। কিন্তু কন্ডিশনটাও বিবেচ্য বলে কোন মাঠে কবে খেলা, সেটিও ক্রিকেটে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে দলগুলোর সুবিধার্থে ২০১৯ বিশ্বকাপের সূচি ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছিল ১৩ মাস আগে। কিন্তু ভারতে হতে যাওয়া এবারের বিশ্বকাপের সূচি পেতে একপ্রকার ‘হাপিত্যেশ’ই করতে হয়েছে দলগুলোকে। এ নিয়ে এপ্রিলের শেষ দিকে আক্ষেপও শোনা গেছে বাংলাদেশ দলের কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের মুখে। সিলেটে বাংলাদেশ দলের ক্যাম্পের পর হাথুরুসিংহে বলেছিলেন, সূচি প্রকাশে বিলম্বের প্রভাব সবার ওপরই পড়ে, আগে ঘোষণা করলে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়।
হাথুরুসিংহে আর অন্য কোচদের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বকাপ সূচি ঘোষণা করা হয় ২৭ জুন। ৫ অক্টোবর শুরু হয়ে ১৯ নভেম্বর শেষ, উদ্বোধন ও সমাপনী দুটিই আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে। আসনসংখ্যায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই স্টেডিয়ামে রাখা হয় ১৫ অক্টোবরের ভারত–পাকিস্তান ‘হাই ভোল্টেজ’ ম্যাচটিও। পাকিস্তান আহমেদাবাদে খেলতে চায় না জানানোয় সূচি ঘোষণার আগে থেকেই এই ম্যাচ ঘিরে প্রচুর পাল্টাপাল্টি কথা হয়েছে।
কিন্তু সূচি প্রকাশের পর দেখা গেল, ‘হাই ভোল্টেজ’ ম্যাচটির ‘টাইমিং’ হয়ে গেছে অসময়ে। একই দিন আহমেদাবাদে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ৯ দিনের নবরাত্রি উৎসব শুরু বলে সূচি বদলের অনুরোধ আসে স্থানীয় পুলিশের পক্ষ থেকে। ধর্মীয় উৎসবের কারণ দেখিয়ে সপ্তাহ দুয়েক পর আরেক অনুরোধ যায় কলকাতা থেকে, এবার ১২ নভেম্বরের পাকিস্তান–ইংল্যান্ড ম্যাচ।
কিন্তু এক–দুটি ম্যাচের সূচি পরিবর্তনই তো সব নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে দলগুলোর অপর ম্যাচের সূচির সঙ্গে বিরতির কম–বেশ, ভ্রমণ সূচির ওলটপালট, অনুশীলনের পর্যাপ্ত–অপর্যাপ্ততার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আছে আগাম হোটেল বুক করা দর্শকের বিপত্তি আর সম্প্রচারকদের কর্মী ব্যবস্থাপনা ও প্রচারণাসংক্রান্ত জটিলতাও। যে কারণে অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক জিওফ লেমন বিসিসিআইকে ‘অযোগ্য ক্রীড়া সংস্থা’ বলেও তীব্র সমালোচনাও করেন।
শেষ পর্যন্ত সব দিক বিবেচনা করে এই ‘সূচি–জটিলতা’ সামাল দেওয়া হয় নয়টি ম্যাচের দিনক্ষণে পরিবর্তন এনে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ‘ভুক্তভোগী’ বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইংল্যান্ড। তিন দলের তিনটি করে ম্যাচের সূচিতে পরিবর্তন আসে। ৯ আগস্ট প্রকাশিত এই সূচিকে বলা হচ্ছে বিশ্বকাপের ‘চূড়ান্ত সূচি’। কিন্তু ভারত ও পাকিস্তানের গণমাধ্যমগুলোর খবরের যা সারমর্ম, তাতে বিশ্বকাপ সূচিতে পরিবর্তন আসতে পারে আরও। প্রথমত, বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের বিষয় নিশ্চিত করলেও নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে রেখেছে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি)। পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের ম্যাচের ভেন্যুগুলোয় নিরাপত্তা দল পাঠানোর কথা। সেই নিরাপত্তা দল যদি কোনো ভেন্যু নিয়ে আপত্তি তোলে, তা কি সরাসরি এড়িয়ে যেতে পারবে আইসিসি?
এদিকে পরিবর্তিত সূচিতে ভারত–নেদারল্যান্ডস ১১ নভেম্বরের হায়দরাবাদের ম্যাচ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে পরদিন। ওই দিনই আবার দিওয়ালি। আহমেদাবাদে নবরাত্রি আর কলকাতায় কালীপূজার কারণে যদি সূচি বদলানো হয়, সেই ‘সুযোগ’ তো থাকছে দিওয়ালির কারণেও! প্রসঙ্গটা টেনেছে ভারতের সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া।
শেষ পর্যন্ত সে রকমই হলে এবারের বিশ্বকাপটা পরিণত হতে পারে তামাশায়। অবশ্য এখন পর্যন্ত যা হয়েছে, সেটাই–বা তামাশার চেয়ে কম কী!