মারো না হয় মরো, ম্যাককালামের ইংল্যান্ডের এটাই দর্শন

ব্রেন্ডন ম্যাককালাম (ডানে) ও বেন স্টোকস, ইংল্যান্ডের অনুশীলনের ফাঁকেরয়টার্স

দুই বছর আগে মে মাস। ব্রেন্ডন ম্যাককালামকে টেস্ট দলের কোচ বানাল ইংল্যান্ড। বেন স্টোকস তখন টেস্ট দলের অধিনায়ক। দুজনের অধীনে ইংল্যান্ড টেস্টে আক্রমণাত্মক খেলতে শুরু করে। তা দেখে ক্রিকেটভিত্তিক ওয়েবসাইট ইএসপিএনক্রিকইনফোর যুক্তরাজ্য সম্পাদক অ্যান্ড্রু মিলার সেই খেলার ধরনের নাম দিলেন ‘বাজবল।’ ম্যাককালামের ডাকনাম ‘বাজ’, ‘বাজবল’ নামটা সেখান থেকেই রাখা।

ধীরে ধীরে নামটি জনপ্রিয় হয়ে উঠল। আলোচনা কিংবা সমালোচনাও হতে শুরু করল। ম্যাককালামের ইংল্যান্ড টেস্ট হারলেই রব উঠত, গেল! গেল! বাজবল গেল!
এমন নিন্দা কিংবা কটূক্তি ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু তাতে কি ‘বাজবল’ খেলার কিছু যায় আসে? ম্যাককালাম ইংল্যান্ড টেস্ট দলের কোচ হন ২০২২ সালের ১২ মে।

তারপর থেকে এই সময় পর্যন্ত ৩০টি টেস্ট খেলেছে ইংল্যান্ড। জিতেছে ২০টি, হার ৯টি এবং ড্র মাত্র ১টি। সেই একটি ড্রও গত বছর ম্যানচেস্টারে অ্যাশেজ সিরিজের চতুর্থ টেস্টে এবং বৃষ্টির বড় ভূমিকা ছিল তাতে। বাকিটা দেখে কি বোঝা যায়? এই যে ‘বাজবল’ নিয়ে এত এত কথা, বলা হয় টেস্টের ফল বের করতেই এমন খেলা, হয় মারো না হয় মরো—তা, ম্যাককালামের ইংল্যান্ড কি কথা রাখতে পারছে?

আরও পড়ুন

ইংল্যান্ডের কোচ হিসেবে কিউই কিংবদন্তির পরিসংখ্যান যেহেতু ওপরে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে আগেই, তাই এই প্রশ্নই সম্ভবত অবান্তর। আর এই মরা কিংবা মারার পথে, আরও খোলাসা করে বললে ৩০ ম্যাচের এই সংক্ষিপ্ত পথেই ম্যাককালামের ইংল্যান্ড এমন সাতটি জয়ের জন্ম দিয়েছে, টেস্ট ইতিহাসেই যেগুলো বিশেষ জায়গা নিয়ে থাকবে। বলতে পারেন, সর্বকালের সেরা জয়গুলোর তালিকায় ওই সাতটি জয় থাকবে।

এই ইংল্যান্ড অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে
এএফপি

তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? ঠিক ধরেছেন, রোমাঞ্চকর। ম্যাককালামের এই ইংল্যান্ডের টেস্ট খেলা দেখাও আনন্দের। টেস্ট খেলার প্রথাগত যে ধীরলয় ধাঁচ—যা কারও কারও কাছে বিরক্তিকরও হয়ে উঠেছিল, তাঁরাও এখন হয়তো বলতে বাধ্য হবেন, ইংল্যান্ডের টেস্ট ‘অ্যাডভেঞ্চার’ উত্তেজনায় ঠাসা কোনো টি–টোয়েন্টি ম্যাচের চেয়েও রোমাঞ্চকর।

বেশি পেছানোর প্রয়োজন নেই। মুলতানেই তাকানো যাক। ৫৫৬ রান তুলে দ্বিতীয় দিনে তৃতীয় সেশনে অলআউট হয়েছিল পাকিস্তান। হিসাবটা কি তখনই সেরে ফেলেছিলেন ম্যাককালাম? এই টেস্টে তখন হাতে ছিল তিন দিনের কিছু বেশি সময়। ম্যাচে তখনো তিনটি ইনিংস বাকি। মুলতানের তক্তা পিচে তখনই উঁকি দিচ্ছিল ড্র।

আরও পড়ুন

কিন্তু ম্যাককালামের ইংল্যান্ডের টেস্ট–দর্শন তো সেটা নয়। দর্শন যা, সেই পথেই হেঁটেছে ইংল্যান্ড। ১৫০ ওভার ব্যাট করে ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংসে ৭ উইকেটে ৮২৩ তুলে ডিক্লেয়ার করেছে ওভারপ্রতি গড়ে ৫.৪৮ করে তুলে। টেস্ট ইতিহাসে যে চারটি ৮০০ + দলীয় স্কোর রয়েছে, সেখানে ওভারপ্রতি রানের হিসাবে এটিই দ্রুততম।

প্রথম ইনিংসে ৫০০‍+ রান তোলার পরও পাকিস্তানকে জিততে দেয়নি ইংল্যান্ড
এএফপি

কেন? ওই যে জয়ের একটা পথ বের করতে দ্রুত বড় লিড নিয়ে সময় বাঁচানো, যেন পাকিস্তানকে তাঁদের দ্বিতীয় ইনিংসে দ্রুত অলআউট করে নিজেরা পরে সহজ লক্ষ্য পায়। ব্যাপারটা যে চাইলেই হয়ে যাবে, মোটেও তা নয়। সামর্থ্য, দক্ষতা ও সাহস লাগে। সেই সামর্থ্য ও দক্ষতার কোপানলে পড়ে তক্ত পিচেও পাকিস্তান নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে দাঁড়াতে না পারায় ইংল্যান্ডকে আর ব্যাটিংয়ে নামতে হয়নি।

একটি তক্তা পিচে প্রতিপক্ষ প্রথম ইনিংসে ৫০০‍+ রান তোলার পর, সেখান থেকে এভাবে জয়ের পথ বের করাকে কী বলা যায়? ওই তো বাজবল!

তাহলে শুনুন আরও একটি রোমাঞ্চকর ব্যাপার। যা শুনে কিংবা দেখে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে ৫০০ রান তোলার আগে প্রতিপক্ষ এখন দ্বিতীয়বার ভাবতে পারে! ম্যাককালাম কোচ হয়ে আসার পর এই আড়াই বছরে প্রতিপক্ষ দল তিনবার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৫০০‍+ রান করে প্রতিবারই হেরেছে।

প্রথম দুবার ২০২২ সালে। সে বছর ১০ জুন ট্রেন্ট ব্রিজে শুরু হওয়া টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৫৫৩ করেছিল নিউজিল্যান্ড। পাকিস্তানের মতো সেই একইভাবে, দ্বিতীয় দিনের তৃতীয় সেশনে অলআউট হয়।

ইংল্যান্ড এরপর ১২৮.২ ওভারে ৫৩৯ তুলে অলআউট হয় চতুর্থ দিন লাঞ্চের আগে। এরপর সেই মুলতানের মতোই ফর্মুলা—টেস্টের তৃতীয় ইনিংসে নিউজিল্যান্ডকে মাত্র ২৮৪ রানে অলআউট করে জয়ের জন্য শেষ দিনে লাঞ্চের আগে ২৯৫ রানের লক্ষ্য পেয়েছিল ইংল্যান্ড।

লাঞ্চের আগে ৯ ওভার ব্যাটিংয়ের পর হাতে ছিল দুই সেশন কিংবা ৬০ ওভারের কিছু কম। জয়ের পেছনে ছোটা ঝুঁকি জেনেও ম্যাককালামের ইংল্যান্ড সেই লক্ষ্য তাড়া করে জিতেছিল ৫০ ওভারে (৫.৯৮ রানরেট)। এই যে জয়ের পিছু ছুটে হারের ভয়কেও জয় করার চেষ্টা—তাতে সফলতা আসুক কিংবা না আসুক, ইংল্যান্ডের এই তরিকাই নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছে টেস্ট ক্রিকেটে।

আরও পড়ুন

ট্রেন্ট ব্রিজ—রোমাঞ্চের মাঝে পাঁচ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর ডিসেম্বরে রাওয়ালপিন্ডিতেও দেখা গেল একই ঘটনা। এবার ইংল্যান্ড আগে ব্যাট করে প্রায় সাড়ে তিন সেশনে তুলল ৬৫৭। পাকিস্তান চতুর্থ দিন লাঞ্চের আগে অলআউট হওয়ার আগে তুলল ৫৭৯। স্টোকস–ম্যাককালামের ইংল্যান্ড তারপরও কিন্তু জয়ের হিসাব কষেছে।

কীভাবে? চতুর্থ দিন লাঞ্চের আগে ব্যাটিংয়ে নেমে টি–টোয়েন্টি মেজাজে (ওভারপ্রতি রান ৭.৩৬) ৩৫.৫ ওভারে ৭ উইকেটে ২৬৪ তুলে ইনিংস ঘোষণা করেন স্টোকস। জয়ের জন্য ৩৪৩ রানের লক্ষ্য পায় পাকিস্তান, হাতে এক দিনের বেশি সময়। ইংল্যান্ড কিন্তু পারত আরও বেশি সময় ব্যাট করে হারের শঙ্কা এড়াতে। কিন্তু তা না করে জয়ের পিছু ছোটার চ্যালেঞ্জ নিয়ে সেবারও জিতেছিল ম্যাককালামের এই ইংল্যান্ডই। অলআউট হয়েছিল পাকিস্তান।

মুলতান টেস্টে ইংল্যান্ডকে নেতৃত্ব দেন ওলি পোপ
এএফপি

সেই পাকিস্তানকে আজ একই মানসিকতায় হারানোর পর ধারাভাষ্যকার ও সাবেক ক্রিকেটার রমিজ রাজাকে একটি কথা বলেছেন ইংল্যান্ড অধিনায়ক ওলি পোপ, ‘তারা যদি ৪০০ রানও করত, তবে আমরা ছোট্ট একটি রান তাড়ার জন্য প্রস্তুত হতাম।’ অর্থাৎ পাকিস্তান নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে (২২০ রানে অলআউট হওয়ায় হেরেছে ৪৭ রানে) ৪০০ রান করলে জয়ের জন্য ১৩৩ রানের লক্ষ্য পেত ইংল্যান্ড। তখন হয়তো এক সেশন কিংবা তারও কম সময় হাতে থাকত। ইংল্যান্ড এর মধ্যেই জয়ের চেষ্টা করত।
ম্যাককালামের এই ইংল্যান্ড যেন ভাঙবে, তবু জয়ের পণ ছাড়বে না!

আরও পড়ুন