সাকিবের জুলাই থেকে অক্টোবর: নীরবতা, হত্যা মামলা...দেশে আসতে মানা
জুলাইয়ের দ্বিতীয় ভাগে দেশজুড়ে ছাত্র আন্দোলন যখন তুঙ্গে ওঠে, সাকিব আল হাসান তখন যুক্তরাষ্ট্রে। খেলছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ ক্রিকেটে। ওই সময় দেশের শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটারদের অনেকে ‘সহিংসতা বন্ধ’ ও ‘শান্তির সপক্ষে’ পোস্ট দিলেও সাকিবের দিক থেকে কোনো বক্তব্য ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রে খেলে সাকিব গ্লোবাল টি–টোয়েন্টি খেলতে যান কানাডায়। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও ৬ আগস্ট দ্বাদশ সংসদ ভেঙে দেওয়ার সময়ও কানাডাতেই ছিলেন তিনি।
সেই থেকে এখনো পর্যন্ত দেশে পা পড়েনি সাকিবের। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মিরপুর টেস্ট খেলতে আজ ঢাকায় আসার কথা ছিল তাঁর। যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুবাই পর্যন্ত চলেও এসেছিলেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর দেশে আসা হচ্ছে না বাংলাদেশ দলের সাবেক অধিনায়কের। জুলাই থেকে অক্টোবর—এই সময়ে প্রায় প্রতিদিনই নানা কারণে খবর হয়েছেন সাকিব আল হাসান। সেসবই ফিরে দেখা—
৩০ জুলাই
কানাডার ব্রাম্পটনে বাংলা টাইগার্স-টরন্টো ন্যাশনালস ম্যাচ শেষে গ্যালারি থেকে এক প্রবাসী বাংলাদেশি সাকিবের কাছে জানতে চান, দেশের উত্তাল পরিস্থিতিতে তিনি (সাকিব) নীরব কেন। সাকিব সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘দেশের জন্য আপনি কী করেছেন?’
২ আগস্ট
টরন্টোতে পরিবার নিয়ে সাফারিতে যান সাকিব। তাঁর স্ত্রী উম্মে আহমেদ শিশির ইনস্টাগ্রাম পোস্টে সন্তান কোলে নিয়ে হাস্যোজ্জ্বল সাকিবের ছবি পোস্ট করে লেখেন, ‘আ ওয়েল স্পেন্ট ডে ইন টরন্টো।’
১১ আগস্ট
আওয়ামী লীগ সরকারের সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য হিসেবে সাকিব আল হাসানকে ডাকা হবে কি না, এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে তাঁকে রেখে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের দল ঘোষণা করে বিসিবি।
১২ আগস্ট
প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন সাকিবকে পাকিস্তান সিরিজে রাখা নিয়ে বলেন, ‘অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেছেন। কারণ, সে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। আমরা সেটা নিয়ে ভেবেছি। কিন্তু তার নির্বাচনটা হয়েছে মেধার ভিত্তিতে। প্রত্যেকটা খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রেই এটা হয়। ভবিষ্যতেও মেধাটাকেই গুরুত্ব দেব।’
২৩ আগস্ট
ঢাকার আদাবর থানায় সাকিবের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা। পোশাককর্মী মো. রুবেল হত্যা মামলায় ১৫৬ জনের মধ্যে ২৮ নম্বর আসামি করা হয় সাকিবকে।
২৪ আগস্ট
হত্যা মামলায় নাম আসা সাকিবকে জাতীয় দল থেকে বাদ দিয়ে মামলার তদন্তের স্বার্থে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বিসিবিকে আইনি নোটিশ পাঠান মোহাম্মদ রাফিনুর রহমান নামের এক আইনজীবী।
তিন দিন আগে বিসিবি সভাপতি হওয়া ফারুক আহমেদ বোর্ডের অনানুষ্ঠানিক সভা শেষে বলেন, ‘তাঁর বিরুদ্ধে কিন্তু চার্জ গঠন হয়নি। এর আগে সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব কঠিন। কিছুদিন আগে বিশাল গন্ডগোল হয়েছে, অনেক প্রাণ নষ্ট হয়েছে। সহমর্মিতা এখনো আছে আমাদের, আমরা কিন্তু ভুলে যাইনি। এই মুহূর্তে (পাকিস্তানের বিপক্ষে) টেস্ট ম্যাচ চলছে। বিসিবির সঙ্গে সাকিবের সঙ্গে সম্পর্ক খেলোয়াড় এবং এমপ্লয়ি বলতে পারেন। কালকের দিনের পর দেখে সিদ্ধান্ত নিতে পারব।’
২৫ আগস্ট
সাকিবের বিরুদ্ধে মামলাটিকে ‘মিথ্যা মামলা’ উল্লেখ করে ফেসবুক পোস্ট দেন মুমিনুল হক। পরে সাকিবের পাশে থাকার বার্তা নিয়ে পোস্ট দেন মুশফিক, রুবেলসহ অন্যরাও। বিবৃতি দিয়ে তাঁর প্রতি সমর্থন জানায় ক্রিকেটারদের সংগঠন কোয়াবও।
২৭ আগস্ট
বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ বলেন, ‘সাকিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ এখনো এফআইআর পর্যায়ে আছে। এরপরও অনেকগুলো ধাপ আছে। যতক্ষণ না তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে, ওকে আমরা খেলাব।’ বিসিবির কাছ থেকে এই মামলায় সাকিব আইনি সহায়তাও পাবেন বলে তিনি জানান, ‘ও আমাদের চুক্তিভুক্ত ক্রিকেটার। প্রয়োজনে তাকে আমরা আইনগত সহায়তাও দেব।’
২৮ আগস্ট
সাকিবের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা নিয়ে দেশে–বিদেশে আলোচনা চলছে জানানো হলে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটাও আওয়ামী লীগই তো শুরু করেছে, ঠিক না? আমিনুল যে ফুটবলার, সাকিব তো আর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য কিছু বয়ে আনে নাই। সাকিব নিজেই অনেক কিছু অর্জন করেছে। আমিনুল তো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য পুরস্কার বয়ে এনেছিল। এনেছিল না?’
গ্রেপ্তারের সম্ভাবনা নিয়ে বলেন, ‘মামলা হওয়া বা এফআইআর হওয়া মানেই তো গ্রেপ্তার না। আমার বিশ্বাস, আমাদের মানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে উদ্যোগ নেওয়া হবে, যাতে কেউ অতি উৎসাহিত হয়ে গ্রেপ্তার না করতে যায়। আমি আশা করি, সাকিব গ্রেপ্তার হবে না।’
একই দিনে সাকিবের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) আবেদন করেন একজন আইনজীবী। একই দিনে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) শুভেচ্ছাদূত থেকে সাকিবকে বাদ দেওয়া হয়।
২ সেপ্টেম্বর
সাকিবকে হয়রানি না করার অনুরোধ জানিয়ে জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক ও বিএনপির ক্রীড়া সম্পাদক আমিনুল হক বলেন, ‘আমি ১৫ বছর ধরে যে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছি, সেটি যেন আর কারও প্রতি না হয়। সাকিবের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে, কিন্তু এই মামলার সূত্র ধরে তাঁকে যেন কোনো প্রকার হয়রানি না করা হয়, আমি এটাই চাই।’
২৩ সেপ্টেম্বর
ভারত সফরে থাকা সাকিব দেশের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ খেলতে আসতে পারবেন কি না প্রশ্নে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে বিসিবির ক্রিকেট অপারেশনস ইনচার্জ শাহরিয়ার নাফীস সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাকিব আল হাসানের ব্যাপারে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, মাননীয় আইন উপদেষ্টা এবং মাননীয় ক্রীড়া উপদেষ্টা খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন। বাংলাদেশ সরকার থেকেও পরিষ্কার বার্তা আছে, যে মামলাগুলো হয়েছে, সেগুলোতে কাউকে অন্যায়ভাবে হেনস্তা করা হবে না। সাকিবের ব্যাপারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের অবস্থান খুব সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছে। চোটের সমস্যা না থাকলে এবং নির্বাচনজনিত কোনো ইস্যু যদি না থাকে, এখন পর্যন্ত সাকিব আল হাসানের হোম সিরিজে না খেলার কোনো কারণ আমি দেখি না।’
২৪ সেপ্টেম্বর
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বিমা খাতের কোম্পানি প্যারামাউন্ট ইনস্যুরেন্সের শেয়ার নিয়ে কারসাজির দায়ে সাকিবকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি)।
২৬ সেপ্টেম্বর
কানপুরে টেস্ট থেকে অবসরের ঘোষণা দিতে গিয়ে সাকিব বলেন, ‘ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে ও নির্বাচকদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। যদি সুযোগ থাকে, আমি যদি দেশে যাই, খেলতে পারি, তাহলে মিরপুর টেস্ট হবে আমার জন্য শেষ। সেই কথাটা বোর্ডের সবার সঙ্গে বলা হয়েছে। তাঁরা চেষ্টা করছেন কীভাবে সুন্দরভাবে আয়োজন করা যায়।’
বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ বোর্ড সভা শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘নিরাপত্তার বিষয়টি আমাদের হাতে নেই। তাকেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বোর্ড থেকে এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না। নির্দিষ্ট একজনকে ব্যক্তিগতভাবে নিরাপত্তা দেওয়ার সামর্থ্য নেই বিসিবির। নিরাপত্তার বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে আসতে হবে। বিসিবি কোনো এজেন্সি না, পুলিশ না, র্যাব না। সরকারের তরফ থেকে নিরাপত্তার ব্যাপারটি আসতে হবে।’
২৯ সেপ্টেম্বর
সাকিবের নিরাপত্তার বিষয়ে ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘খেলোয়াড় সাকিবের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই আছে। তবে ফ্যাসিস্ট সরকারের সংসদ সদস্য সাকিব আল হাসানের বিপক্ষে জনমনে তৈরি হওয়া ক্রোধের বিপরীতে নিরাপত্তা দেওয়ার নিশ্চয়তা চাওয়া অবান্তর।’ সেদিন সচিবালয়ে সাকিবকে ছাত্র আন্দোলনের বিষয়ে অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে জানিয়ে ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘আমার মনে হয়, ওনাকে (সাকিব) ওনার জায়গাটা পরিষ্কার করা প্রয়োজন, রাজনৈতিক জায়গা থেকে। ওনার যে রাজনৈতিক অবস্থান, সেটা নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। মাশরাফি বিন মুর্তজা মনে হয় এরই মধ্যে সে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। জনগণের পক্ষ থেকে যদি নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকে, সে নিরাপত্তা কেউ কাউকে আসলে দিতে পারবে না। শেখ হাসিনাকেও নিরাপত্তা দেওয়া যায়নি। তাঁকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে। তো সে জায়গা থেকে রাজনৈতিক বিষয়টা (সাকিবের) পরিষ্কার করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।’
২ অক্টোবর
ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাকিব ও তাঁর স্ত্রী উম্মে রোমান আহমেদ ও তাদের কোম্পানি বা সংগঠনের নামে থাকা বিভিন্ন হিসাবের তথ্য দিতে বলেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
৩ অক্টোবর
সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজায় নারী টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দেখতে গিয়ে ক্রীড়া উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, ‘তিনি (সাকিব) এমন একজন খেলোয়াড়, যাঁর দেশের জন্য অনেক অবদান রয়েছে। তিনি যেহেতু বাংলাদেশে নিজের শেষ টেস্ট খেলতে চান, আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই সেই সুযোগ তিনি পান।’
৯ অক্টোবর
ছাত্র আন্দোলনে নিজের নীরবতায় দুঃখ প্রকাশ ও রাজনীতিতে নামার ব্যাখ্যা দিয়ে ফেসবুক পোস্টে দীর্ঘ পোস্ট লেখেন সাকিব আল হাসান। দেশের মাটিতে সর্বশেষ টেস্টে সবাইকে পাশে থাকার আহ্বান করে লেখেন ‘আমি আশা করি, শুধু আশা না বিশ্বাস করি—এই বিদায়বেলায় আপনারা সবাই আমার সঙ্গে থাকবেন।’
১৪ অক্টোবর
মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম পরিদর্শনে গিয়ে ক্রীড়া উপদেষ্টা সাকিবের দেশে এসে নির্বিঘ্নে ফিরে যাওয়া নিয়ে বলেন, ‘একজন ক্রিকেটার, তিনি খেলবেন এবং তিনি বাংলাদেশের নাগরিক। আসার ব্যাপারে তো আমি কোনো বাধা দেখি না।’
১৬ অক্টোবর
সাকিবকে রেখে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মিরপুর টেস্টের জন্য ১৫ সদস্যের দল ঘোষণা নির্বাচকদের। সাকিবের মিরপুরে ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট খেলার ইচ্ছা পূরণ হতে যাচ্ছে জানিয়ে নির্বাচক হান্নান সরকার বলেন, ‘আমরা সবাই জানি, এটা একটা সরকারি ইস্যু ছিল, বিসিবির ইস্যু ছিল। ক্রিকেট বোর্ড থেকে আমরা যখন গ্রিন সিগন্যাল পেলাম, সাকিবকে দলে রাখা যাবে, স্বাভাবিকভাবেই আমরা তাকে দলে রেখেছি। এটা আমাদের জন্য একটা বিশাল আনন্দের ব্যাপার যে আমাদের এ রকম একজন কিংবদন্তি খেলোয়াড়, সে মিরপুর থেকে, যেটাকে আমরা আমাদের হোম অব ক্রিকেট বলি, সেখান থেকে বিদায় নিচ্ছে। এটা শুধু সাকিবের জন্যই নয়, বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের সবার জন্যই পাওয়া।’
১৭ অক্টোবর
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকায় আসার পথে দুবাই ট্রানজিট ছিল সাকিবের। দুবাইয়ে থাকতেই তাঁকে দেশে আসতে বারণ করা হয়েছে বলে জানান সাকিব। দুপুরে মিরপুর স্টেডিয়ামে সাকিবকে না খেলানোর দাবিতে মিরপুরের ছাত্র–জনতার ব্যানারে বিক্ষোভ হয়। বিসিবি সভাপতি বরাবর স্মারকলিপিও দেওয়া হয়।