‘ইমরান খান’ হতে পারলেন না বাবর আজম
সুপার টুয়েলভে প্রথম দুই ম্যাচ হেরে পাকিস্তান দলের করাচি–লাহোরের বিমান টিকিট প্রায় নিশ্চিতই মনে হচ্ছিল। ভারত ও জিম্বাবুয়ের কাছে হেরে নিজেদের গ্রুপ থেকে সেমিফাইনালে পৌঁছানোর ভাবনাটাই মনে হচ্ছিল বাড়াবাড়ি। আক্ষরিক অর্থেই কঠিন হয়ে পড়েছিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের সেমিফাইনাল–যাত্রা। সুপার টুয়েলভ পর্বের গ্রুপ ২–এ থাকা দক্ষিণ আফ্রিকা আর ভারত থাকাতে অতি আশাবাদী পাকিস্তান সমর্থকও সেমিফাইনালে যাওয়ার আশা বাদ দিয়েছিলেন।
পাকিস্তান তৃতীয় ও চতুর্থ ম্যাচে নেদারল্যান্ডস ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে নিজেদের কাজটা এগিয়ে রেখেছিল ঠিকই। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে নেদারল্যান্ডসের কাছে দক্ষিণ আফ্রিকা হেরে যাওয়ার পর পাকিস্তানের সেমিফাইনালে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়ে যায়। শেষ ম্যাচে বাংলাদেশকে হারানোর দরকার ছিল, আর সেটি করেই খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে শিরোপার দৌড়ে প্রত্যাবর্তনের গল্পটা লেখেন বাবর আজমের দল।
এর পর থেকেই ১৯৯২ সালটা বারবার ফিরেছে পাকিস্তান প্রসঙ্গে। আজ থেকে ৩০ বছর আগেও যে এভাবেই প্রত্যাবর্তনের অবিশ্বাস্য গল্প লিখেছিল পাকিস্তান। ’৯২ বিশ্বকাপে যেখানে শুরুর বাজে পারফরম্যান্স পাকিস্তানকে রাউন্ড রবিন লিগ থেকেই বিদায় করে দিচ্ছিল, সেখানে তারা জিতেছিল শিরোপা। ধুঁকতে ধুঁকতে পথ পেয়ে গেলে পাকিস্তান দলটা ভয়ংকর হয়ে ওঠে—এই মিথই পাকিস্তান সমর্থকদের ২০২২ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ নিয়ে আশায় বুক বাঁধিয়েছিল। সেমিফাইনালে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে নিউজিল্যান্ডকে হারানোর পর সেই প্রত্যাশা আকাশও ছুঁয়েছিল।
এবারের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের ভাগ্যের সঙ্গে ১৯৯২ বিশ্বকাপে পাকিস্তান দলের ভাগ্য এমনভাবে মিলে যাচ্ছিল, তাতে আশাবাদটা ছড়িয়ে পড়াই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই মেলবোর্নেই ৩০ বছর আগের গল্পটা নতুন করে লিখতে ব্যর্থ পাকিস্তান। ’৯২ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে ২২ রানে হারিয়েই এসেছিল পাকিস্তান ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় গৌরব। কিন্তু আজ সেই ইংল্যান্ডের কাছে ৫ উইকেটে হেরে ইতিহাসের ফিরে আসার গল্পটা হয়ে থাকল অপূর্ণতারই।
সুনীল গাভাস্কার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন বাবর আজমকে নিয়ে। ১৯৯২ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে শিরোপা জেতানোর পর রাজনীতিতে এসেছিলেন ইমরান খান। ২৮ বছরের রাজনৈতিক পথচলায় তিনি বসেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্বের আসনেও।
এবার অস্ট্রেলিয়াতে ১৯৯২ বারবার ফেরায় গাভাস্কার বলেছিলেন, টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতলে বাবর আজম কি ২০৪৮ সালে বাবর আজম কি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন! যেভাবে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়েছে, তাতে এমন কিছু কেউ বলতেই পারেন। ইমরান খান যদি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, তাহলে বাবর আজমের হতে অসুবিধা কী! শেষ পর্যন্ত বাবর আজম যে ‘ইমরান খান’ই হতে পারেননি।
পাকিস্তান ক্রিকেটের ট্র্যাজিক হিরো হয়েই রইলেন বাবর। গত বছর সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপেও সেমিফাইনালে উঠেছিল পাকিস্তান। কিন্তু মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়ার মতো করেই এক ম্যাথু ওয়েডের বীরত্বে অস্ট্রেলিয়ার কাছে সেমিফাইনালে হেরে গিয়েছিল পাকিস্তান। তিনি ‘ইমরান খান’ না হতে পারেন, অন্তত আরেকজন ‘ইউনিস খান’ (২০০৯ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপজয়ী পাকিস্তানের অধিনায়ক ছিলেন ইউনিস) হওয়ার দ্বারপ্রান্তেই দাঁড়িয়ে ছিলেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হতে পারেননি। এবার আচমকাই ‘ইমরান খান’ হওয়ার সুযোগের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে স্ফটিকের ট্রফি হাতে ইমরানের সেই আইকনিক ছবির পাশে নিজের ছবি যোগ করতেই পারতেন।
কিন্তু ভাগ্য সবার জন্য সমান নয়। ২০২২ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ১৯৯২ বিশ্বকাপের অনেক কিছুরই পুনরাবৃত্তি হতে পারে। কিন্তু মেলবোর্নের ফাইনালে বিজয়ী দলের নামটা বদলই গেল শেষ পর্যন্ত।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কখনোই পুরোপুরি ঘটে না। ইতিহাস কিছু না কিছু নিজের হাতে রেখে দেয়।