ডেভ হোয়াটমোরের ‘অর্ধেক জীবন’ এবং...

ডেভ হোয়াটমোরের সঙ্গে কথা বলার রাতে তাঁর পরনে ছিল নীল শার্ট। পরের দিন সকালে প্রথম আলোর আলোকচিত্রীও ওই শার্ট গায়েই ছবি তুলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটি তখন হোটেলের লন্ড্রিতে। নীল শার্টের ডেভ হোয়াটমোরের বদলে ছবিতে তাই কালচে রঙের টি–শার্ট পরা ডেভ হোয়াটমোর। যে টি–শার্টটি আবার তাঁর জন্যই বিশেষভাবে বানানো। বুকে DW লেখাটা কি দেখতে পাচ্ছেন?শামসুল হক

‘ডেভ, বয়স তো মনে হয় দিন দিন কমছে, রহস্য কী?’

ডেভ হোয়াটমোর হাসেন। নীল রঙের একটা শার্ট পরেছেন। জিনসের প্যান্ট। দেখে আসলেই বোঝার উপায় নেই, ৭০তম জন্মদিন দুয়ারে সমাগত। আগাম সেই শুভেচ্ছা জানাতেই ফিসফিস করে বললেন, ‘আস্তে বলুন। কেউ আমার বয়স জিজ্ঞেস করলে আমি এমন ফিসফিস করেই তা বলি।’ বলেই হাসতে হাসতে চোখ টিপলেন।

আমি একটু আগেই বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। একদমই ঠিক হয়নি।
ডেভ হোয়াটমোর, বাংলাদেশ দলের সাবেক কোচ

প্রায় ৭০ বছরের এই জীবনের ৩৫ বছরের মতোই কেটেছে কোচিংয়ে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম শোনার প্রশ্নই নেই, তারপরও তাঁর উদাহরণ দিয়েই বললাম, ‘কোচিং ক্যারিয়ার নিয়ে এখন কোনো বই লিখলে সেটির নাম দিতে পারেন অর্ধেক জীবন।’

ডেভ হোয়াটমোর আবারও হাসেন, ‘তা-ই তো! এভাবে তো ভাবিনি। একদম ঠিক, জীবনের অর্ধেকটা কোচিংয়েই কেটে গেল।’ 

রানাতুঙ্গার নেতৃত্বে শ্রীলঙ্কা ১৯৯৬ বিশ্বকাপ জিতেছিল ডেভ হোয়াটমোরের কোচিংয়ে
এএফপি

সেই কোচিং ক্যারিয়ারের মুকুটে সবচেয়ে বড় পালক ১৯৯৬ বিশ্বকাপ জয়। এর আগের বছরই জন্মভূমি শ্রীলঙ্কার কোচ হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। জন্মভূমি কথাটা বলতে হচ্ছে, ছেলেবেলায় পরিবারের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমানো হোয়াটমোরের শ্রীলঙ্কান আর অস্ট্রেলিয়ান পরিচয় একাকার হয়ে যাওয়ায়। খেলোয়াড়ি জীবন অস্ট্রেলিয়াতেই, যাদের হয়ে খেলেছেন ৭টি টেস্ট ও ১টি ওয়ানডে। ৭টি টেস্টই ১৯৭৯ সালে, একমাত্র ওয়ানডেটি ১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে। প্যাকার–বিধ্বস্ত সেই অস্ট্রেলিয়া দলের হয়ে পারফরম্যান্স এমন বলার মতো কিছু নয়। টেস্টে দুটি হাফ সেঞ্চুরি আছে, সর্বোচ্চ ৭৭।  

তামিম–মুশফিকের মতো সাকিবের আন্তর্জাতিক অভিষেকও তাঁর সময়েই। আর শ্রীলঙ্কার কোচ থাকার সময় খেলোয়াড় হিসেবে পেয়েছেন হাথুরুকে। পরে দেখেছেন কোচ হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশের দিনগুলোতেও।

কোচিং বায়োডাটা সে তুলনায় অনেক বেশি উজ্জ্বল। যাতে টেস্ট খেলুড়ে দেশই চারটি। দুই দফায় শ্রীলঙ্কা। বাকি তিনটি বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও জিম্বাবুয়ে। এর বাইরে নেপাল ও সিঙ্গাপুরের মতো উঠতি দেশ যেমন আছে; তেমনি ল্যাঙ্কাশায়ার, কেরালা ও বরোদার মতো প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট দলও। আইপিএল, বিপিএল ও কানাডা গ্লোবাল লিগে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের অভিজ্ঞতাও।

ডেভ হোয়াটমোর যখন বাংলাদেশের কোচ ছিলেন
এএফপি

সময়ের ক্রমানুসারে এক এক করে দলগুলোর নাম বলার সময় ‘বাংলাদেশ’ আসতেই একটু থমকে গিয়ে বলেছেন, ‘আমি একটু আগেই বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। একদমই ঠিক হয়নি।’ ছেড়ে গিয়েছিলেন চার বছর কাটিয়ে। ২০০৩ বিশ্বকাপে ভরাডুবির কিছুদিন পর দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশকে জিততে শিখিয়েছেন। ছেড়ে গেছেন ২০০৭ বিশ্বকাপের পরপরই দেশের মাটিতে ভারতের বিপক্ষে সিরিজ শেষে। বিশ্বকাপে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলকে হারিয়ে তুমুল আলোড়ন তোলার পর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড তাঁকে ধরে রাখতেই চেয়েছিল। হোয়াটমোরই থাকতে চাননি। বিশ্বকাপ–ব্যর্থতার পর গ্রেগ চ্যাপেলকে বিদায় করে দিয়ে ভারত তখন নতুন কোচ খুঁজছে। হোয়াটমোরের মনে হয়েছিল, তাঁকেই খুঁজছে বিসিসিআই।

সেই মনে হওয়াটা ভুল ছিল। কোথায় ভারতের জাতীয় দল, আর কোথায় সে দেশের জাতীয় ক্রিকেট একাডেমি! প্রথমটির দায়িত্ব নিতে চেয়ে বিফলমনোরথ হোয়াটমোরকে একটু মন খারাপ করেই দ্বিতীয়টিতে যোগ দিতে হয়েছিল। হোয়াটমারের সেই ক্ষতে আর নুন না ছিটিয়ে দ্রুতই তাই বর্তমানে ফিরে আসা। সেই বর্তমান মানে বিপিএল। যেটিতে এবারের চ্যাম্পিয়ন ফরচুন বরিশালের কোচ, সরি টিম ডিরেক্টর ডেভ হোয়াটমোর। এই দলের কোচ, এটা জেনে ঢাকায় এসে দেখেন, তাঁর পরিচয় বদলে গেছে। তা নিয়ে একটু অসন্তোষও কি প্রকাশ পেল এই কথায়, ‘এই টিম ডিরেক্টরের কাজটা কী, আমি বোঝার চেষ্টা করছি। দলের অনেক সিদ্ধান্তেই আমার কোনো ভূমিকা নেই। তবে দল যতক্ষণ ভালো করে, আপত্তি নেই।’

এবারের বিপিএলে চ্যাম্পিয়ন বরিশালের টিম ডিরেক্টর ছিলেন হোয়াটমোর
প্রথম আলো

‘দল’ শুধু ভালোই করেনি, চ্যাম্পিয়নই হয়ে গেছে। ডেভ হোয়াটমোরের সঙ্গে বনানীর টিম হোটেলে আড্ডার রূপ নেওয়া এই কথোপকথন গত ২৭ ফেব্রুয়ারি, রংপুর রাইডার্সের সঙ্গে বরিশালের দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ার ম্যাচের আগের রাতে। সেই ম্যাচ জিতেছে বরিশাল, পরে ফাইনালও। হোয়াটমোর তাই আরেকটি শিরোপা জয়ের আনন্দ নিয়েই ঢাকা ছেড়েছেন। গন্তব্য কলম্বো। করোনাকালে নতুন উপলব্ধি থেকেই কিনা অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে স্ত্রীকে নিয়ে কলম্বোয় স্থায়ী হয়েছেন তিন বছর আগে। 

আট বছর আগেও একবার এসেছিলেন বিপিএলে। সেবারও দলের নাম ছিল বরিশাল। এবার শুরুতে ‘ফরচুন’, সেবার শেষে ছিল ‘বুলস্‌’। বিপিএলে দুবারই বরিশাল দলের সঙ্গে, একবার তো তাহলে বরিশাল থেকে ঘুরে আসা উচিত, গেছেন কোনো দিন? ‘না। তবে বরিশালের এত মানুষ ঢাকায় থাকে জেনে আমি খুবই অবাক। গ্যালারিতে আমাদের এত সমর্থক, এটা ভাবতেই পারিনি’—হোয়াটমোরকে সত্যি অবাক দেখায়। তারকাপ্রথার বাংলাদেশ ক্রিকেটে এই সমর্থনের কিছুটা হয়তো তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহর জন্যও হতে পারে। ব্যাখ্যাটা হোয়াটমোরের মনে ধরল।

বরিশালের অধিনায়ক তামিম ইকবালের সঙ্গে হোয়াটমোর। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তামিমের অভিষেক হয়েছিল হোয়াটমোরের হাত ধরেই
প্রথম আলো

ওই তিনজনের মধ্যে তামিম আর মুশফিকের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ডেভ হোয়াটমোরের সময়েই। ২০০৫ সালে ইংল্যান্ড সফরে মুশফিকের নাটকীয়ভাবে টেস্ট অভিষেক হওয়ার সেই স্মৃতিচারণা করে বললেন, ‘সাসেক্সের বিপক্ষে শেষ প্রস্তুতি ম্যাচে অমন একটা সেঞ্চুরির পর মুশফিককে লর্ডস টেস্টে না খেলানোর কোনো উপায় ছিল না। ওর ব্যাটিংয়ে কবজির মোচড় ওই সময়ে যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে। বাংলাদেশ দলে অনেক দিন ধরে খেলছে, তাই না?’ তামিম ইকবালকে নিয়েও মুগ্ধ। বেশি মুগ্ধ ২০০৭ সালে দেখা ছোট্ট তামিমের নেতৃত্বগুণে। ‘মানসিকভাবে খুব শক্তিশালী। কথাবার্তাতেও দারুণ। ও যখন কথা বলে, তখন সবাই তা মন দিয়ে শোনে। বাংলাদেশের অধিনায়ক হিসেবে কেন ও এত সাফল্য পেয়েছে, এবার কাছ থেকে দেখে তা পরিষ্কার বুঝতে পারছি’—হোয়াটমোরের শেষ কথাটার সূত্র ধরেই তামিমের হঠাৎ অবসর–ফিরে আসা, বিশ্বকাপে খেলতে না–পারা এসব এল। তামিম কিছু বলেননি তাঁকে? বলে থাকলেও তা গোপনই রাখতে চাইলেন, তবে বিশ্বকাপের আগের ওই বিতর্ক সম্পর্কে যে তিনি ভালোই অবগত, তা বুঝে নেওয়ার মতো অনেক কিছুই বললেন। কবে পাওয়া যাবে নিশ্চিত না জেনেও বিশ্বকাপে অনেক দলই যে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়কে দলে রেখেছে—এটা মনে করিয়ে দিয়েই বুঝিয়ে দিলেন, তামিমের ক্ষেত্রেও এমন কিছু করার সুযোগ ছিল। বাংলাদেশের ক্রিকেটে ওই সময়টা এমনই গোলমেলে যে সব বলতে গেলে রাত পার হয়ে যাবে বলে সেই চেষ্টা থেকে বিরত থাকাই ভালো বলে মনে হলো। বিন্দুতে সিন্ধু ধরার মতো করে সংক্ষেপে তা বলার সময় অবধারিতভাবেই সাকিব আল হাসান এলেন, চন্ডিকা হাথুরুসিংহেও। 

২০০৭ সালে সাকিবের সঙ্গে বাংলাদেশের সাবেক কোচ হোয়াটমোর
এএফপি

দুজনকেই হোয়াটমোর খুব ভালো চেনেন। তামিম–মুশফিকের মতো সাকিবের আন্তর্জাতিক অভিষেকও তাঁর সময়েই। আর শ্রীলঙ্কার কোচ থাকার সময় খেলোয়াড় হিসেবে পেয়েছেন হাথুরুকে। পরে দেখেছেন কোচ হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশের দিনগুলোতেও। হাথুরুর ক্রিকেট–মস্তিষ্ক সম্পর্কে শ্রদ্ধা আছে। নিজে যা ঠিক মনে করেন, যেকোনোভাবেই তা করতে চাওয়ার মানসিকতা সম্পর্কেও সম্যক অবগত। বললেন আরও অনেক কিছুই, তবে বিতর্ক এড়াতে তার কোনো কিছুই ‘অন রেকর্ড’ না। মজা করে বললাম, এসব প্রকাশ হলেই বা সমস্যা কী, আপনার অবসর নেওয়ার বয়স তো হয়েই গেছে।

ডেভ হোয়াটমোর কপট রাগে কপাল কুঁচকে বললেন, ‘কী বলছেন এসব—এখনই কিসের অবসর? একটু আগেই না বললেন, দিন দিন আমার বয়স কমছে!